Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

শব্দ দূষণ নীরব ঘাতক

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৫ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০২ এএম

আমাদের চারপাশে হট্টগোল এতই বেড়েছে যে বিজ্ঞানীদের অভিমত প্রতি ছয় বছরে হট্টগোল বা নয়েজের মাত্রা দ্বিগুণ হারে বাড়ছে, এতে আমাদের শ্রবণশক্তি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিশেষজ্ঞদের মতে ২০২৫ সালের মধ্যেই ১০ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে অনেকে স্বাভাবিক শ্রুতিশক্তির অধিকারী থাকবে না। শব্দ প্রতিরোধে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গড়ে উঠেছে যার নাম ‘অরগ্যানাইজেশন ফর ইকনোমিক কো-অপারেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট’। সংস্থাটির কাজ হল ইউরোপ ও এশিয়ার ২৬টি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। অবাঞ্চিত শব্দ প্রতিরোধ ইত্যাদি তাদের কাজের অন্তর্গত। তারা ২৪টি দেশে ২০ বছর সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন সে সব দেশে ইতিমধ্যে মনুষ্যকৃত শব্দ বেড়েছে দ্বিগুণ-এর কারণ মুখ্যত বিমান ও যন্ত্রচালিত যান বৃদ্ধি। এছাড়া এক সময় যেখানে গ্রামাঞ্চল ছিল সেখানে নগরায়নের ফলে শব্দের উপদ্রব বেড়েছে। প্রকৃতির স্নিগ্ধ পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, পশু পাখির সংখ্যা কমছে বাড়ছে মানুষ।

শ্রবণশক্তি একটি আশীর্বাদ। দূরে পড়া বাজের শব্দ, ঘন্টাধ্বণি, মাইকের আওয়াজ, পাখির কলতান, বাদ্যযন্ত্রের মূর্ছনা এ সব শোনা সম্ভব হয় শ্রবণশক্তির কারণে। ঐতিহাসিকরা বলেন, মানুষের আবির্ভাবের অনেক পূর্বে এ শক্তি প্রাণীদের ছিল। প্রায় ৪ মিলিয়ন বছর পূর্বে স্তন্যপায়ী সদৃশ সরীসৃপ পেলিকোসার শ্রবণ শক্তির অধিকারী ছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডা. হেনশেল নামের জনৈক বিজ্ঞানীর মতে, বিরক্তিকর শব্দ ঠিক প্রতিকুল আবহাওয়ার মতই স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। অনবরত বিকট শব্দ মানষিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, রক্তচাপ বৃদ্ধি করে, আশঙ্কা দেখা দেয় আকস্মিক হৃদরোগের, শ্রবণ শক্তির যথেষ্ট ক্ষতি করে। আমেরিকার সিনসিনাটি শহরের এক বিশেষ সংস্থা ডাঃ হেনশেলের নেতৃত্বে জনসাস্থ্য ক্ষেত্রে শব্দের প্রভাব নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা করেছেন।

ফিসফিস করে কথা বলার দিন শেষ হয়ে গেছে বলে তার মত অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন। বর্তমানে যন্ত্রযুগে, হইচই নানা গন্ডগোলের জন্য চড়া স্বরে কথা না বললে কেউ শুনতে পায় না। ভবিষ্যতে এমন দিন আসবে যখন কন্ঠস্বর সর্বোচ্চ মাত্রায় না তুললে হয়ত যেসব অপরের শ্রুতিগোচর হবে না। কথাটা মাত্রাতিরিক্ত হলেও মার্কিন বিজ্ঞানীদের মতে, গত কয়েক দশকে পৃথিবীর সর্বত্র যানবাহন, কল-কারখানা ইত্যাদির শব্দ প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁদের গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, পৃথিবীতে প্রতি বছর শব্দের পরিমাণ গড়ে এক ডেসিবেল করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফিসফিস করে মানুষ যখন কথা বলে, তখন যে শব্দ উৎপন্ন হয়, তার পরিমাপ প্রায় ৩০ ডেসিবেল। এভাবে শব্দের জোর বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাস্তায় মোটর গাড়ি, লরি ইত্যাদি যান চলাচলের শব্দ প্রায় ৬০-৭০ ডেসিবেল আকাশে ওড়ার ঠিক আগে বিমান থেকে যে শব্দের সৃষ্টি হয়, তার পরিমান ১২০ ডেসিবেল বা তার কাছাকাছি হয়। তাহলে মানুষের কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে বা মানুষ চির বধিরত্ব লাভ করতে পারে। পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, ১৭৫ ডেসিবেলের শব্দ শুনে ইঁদুর সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ হারায়।

মানুষের জীবনে শব্দের এ সমস্যা হ্রাস পাওয়ার কোন সম্ভাবনাতো নেই বরং দিনে দিনে এ সমস্যা ত্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গাড়ি, কলকারখানার শব্দ তো আছেই তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে প্রতিনিয়ত হাজার রকমের অবাঞ্চিত শব্দ। যানবাহনের, ঢাক-ঢোলের আওয়াজ, মাইক্রোফোনের আওয়াজ, দোকানে লাগানো লাউড স্পিকারের আওয়াজ এসব আজ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে এক অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধুমাত্র শহরে নয়, সুদুর গ্রামাঞ্চলও আজ এ শব্দ দূষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। কৃষি যন্ত্রপাতি, ট্রাক্টর, লরির শব্দ আজ শান্ত গ্রামের পরিবেশকেও দূষিত করে তুলছে। এমন অনেক অফিস আছে যেখানে টাইপ মেশিন, বাতানুকুল যন্ত্র ইত্যাদির শব্দের জন্য সাধারণ মানুষের কথাবার্তা ঠিক মত শোনা যায় না। বাড়িতে ওয়াশিং মেশিনের শব্দ, টিভির শব্দ, জেনারেটরের শব্দও আজকাল বাড়ির শান্ত ও নিস্তব্ধ পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। যে শব্দ প্রাণে সাড়া জাগায় না, তাই বিরক্তিকর। হয়ত রেডিওর সামনে বসে একজন তন্ময় হয়ে গান শুনছে উপভোগ করছে,কিন্তু তার পাশে বসা একজন ছাত্র বা নিদ্রিত ব্যক্তির কাছে ওই মধুর সঙ্গীতই বিরক্তিকর। সাময়িকভাবে বিরক্তিকর শব্দ নিয়ে গবেষকরা চিন্তিত নন। কিন্তু যে সব শব্দ মানুষের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে বা যে শব্দ মানুষের শরীর ও মনকে পীড়িত বা ক্লান্ত করে তোলে, সে শব্দ দমন করার ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা বিশেষভাবে চিন্তিত।

বিরক্তিকর শব্দ মানুষের শরীরে স্নায়ুবিক দুর্বলতা বাড়ায়। মনকে করে তোলে ক্ষিপ্ত বা উত্তেজিত। শব্দের দাপটে ঘুম না ভাঙলেও নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটে এবং তার ফলে হ্রাস পায় কর্মদক্ষতা। ভুলভ্রান্তি ঘটে কাজকর্মে। সৃজনশীল প্রতিভার ব্যাঘাত হয় এবং শরীর হয়ে পড়ে অবসাদগ্রস্ত। পরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রচন্ড শব্দে মানুষের শরীরের বেশ কিছু ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, রাস্তায় চলাচলকারী ভারী যানবাহন বা আকাশে বিমানের শব্দে গবাদি পশুর বা হাঁস-মুরগীর উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে। বয়সের সঙ্গে যদি শ্রবণশক্তির ধার কমে আসে, বৃদ্ধদের কথা শোনাতে জোরে কথা বলতে হয়। একথা সত্যি, এ শক্তিহানির কিছু অংশ ঘটে দৈনন্দিন শব্দ দানব যেভাবে আমাদের কানের উপর অত্যাচার করছে শ্রবণশক্তি হ্রাসের জন্য? এ ব্যাপারে অবশ্য সমীক্ষা করলে বোঝা যেত। অনেক দেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, স্বাভাবিক জনসংখ্যাতে বেশ শ্রবণ শক্তিহানি ঘটছে। শব্দদূষণ যে মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যা, তা বিজ্ঞানীদের স্বীকার্য বিষয়। আমাদের স্বাস্থ্য ও সামাজিক পরিবেশ এতে বিঘিœত হচ্ছে। নয়েজ যা অনাকাঙ্খিত শব্দ বা হট্টগোল। এর সময়কাল মাপা যায় সময় সংকেতে, পৌনঃপুনিকতা মাপা হয় হার্জ-এ এবং তীব্রতা মাপা হয় ডেসিবেলে। হট্টগোলের প্রকৃতি নানা রকম অনবরত হতে পারে, থেমে থেমে হতে পারে অথবা জোর নির্ঘোষে হতে পারে। উঁচু ফ্রিকোয়েন্সি শব্দ নিচু ফ্রিকোয়েন্সি শব্দ অপেক্ষা বেশি বিরক্তিকর। পরিচিত হট্টগোল থেকে অপরিচিত হট্টগোল অধিকতর অপ্রীতিকর।শব্দদূষণের ফলে যে ক্ষতি হচ্ছে শরীরে, তা মোটামুটি অখন্ডনীয়। এ হচ্ছে চিন্তার বিষয়। বিজ্ঞানীরা শব্দ দূষণের উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখেছেন শিল্প কারখানা, যানবাহন এবং গোষ্ঠিগত কার্যকলাপ, বিনোদন এবং নির্মাণ কার্যের শব্দ। এছাড়া অবাঞ্চিত শব্দ কারখানায় শ্রমিকের কার্যক্ষমতা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে, হট্টগোলের কারণে যানবাহন দুর্ঘটনা হয়। একজন বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড, সি, হিউজের মতে, অপ্রীতিকর শব্দ এমনকি অত্যন্ত জোরে প্রীতিকর শব্দ যদি কর্মক্লান্ত দিনের শেষে কাউকে দীর্ঘদিন আহত করে তাহলে তা গুরুতর মানসিক গোলযোগ এমনকি আক্রমনাত্মক আচরণ সৃষ্টি করতে পারে। অতিরিক্ত মদ্যপান, নেশার ঔষধ গ্রহণ, প্রশান্তিদায়ক ও ঘুমের ঔষধ গ্রহণের জন্য হট্টগোল আংশিকভাবে দায়ী। এ জন্য অনিদ্রা ও মানসিক ভঙ্গুরতা সৃষ্টি হতে পারে। হট্টগোলের জন্য প্রান্তীয় রক্তবাহকগুলোর সংকোচন ঘটতে পারে হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, হট্টগোলের মধ্যে অনবরত কার্যরত শ্রমিকদের রক্তের কোলেস্টেরল বেড়েছে। হট্টগোলের ফলে পেপটিক আলসার, হাঁপানি রোগ এবং একজিমা জাতীয় চর্মরোগের প্রকোপ বাড়ে। বিজ্ঞানী ডা. ক্রাইটার এবং জনমারির মতে, হট্টগোলের সম্মুখীন হবার মানে হল অতিরিক্ত চাপ বা পীড়নের সম্মুখীন হওয়া। মানবেতর প্রাণীতে দেখা গেছে, হট্টগোল ক্ষুদ্র রক্তবাহগুলোর সংকোচন ঘটে, হরমোন এ ড্রিনালিন উৎসারিত হয়। ৯০ ডেসিবেলের অধিক শব্দ কার্যক্ষমতা হ্রাস করতে সক্ষম। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক দীর্ঘদিন হট্টগোলের মধ্যে থাকলে শ্রুতিশক্তি হানি ঘটতে পারে। আজকাল রাস্তাঘাটে ভারী লরী, যানবাহন বেশী চলছে, রাস্তা চওড়া হয়েছে, শব্দ শোষণের জন্য দু’ধারের গাছপালা সাফ হচ্ছে ফলে শব্দ দূষণ বাড়ছে। রেলস্টেশন এবং এয়ারপোর্টে অবাঞ্চিত শব্দ বেড়েছে, কারখানায় বেড়েছে হট্টগোল। যেসব স্থান নিঃশব্দ হওয়া উচিত যেমন-হাসপাতাল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেগুলো আজকাল কোলাহল মুখর। সর্বত্র যেন হাটবাজার। আমাদের সামাজিক কাজ-কর্ম, বিয়ে, অন্যান্য অনুষ্ঠানে ড্রাম ও মাইকের শব্দে দূষণ কম নয়। রেষ্টুরেন্টে উচু ভলিউমে ক্যাসেট বাজালে শব্দ দূষণ মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পায়।ফিসফিস করে কথা বলার মধ্যে যে মাধুর্য ছিল তা আমরা হারাতে বসেছি। অন্তরঙ্গ আলাপ হয়ত ভবিষ্যতে হবে বিরাট হাকডাক করে। কুটনিপনা হবে উচু গ্রামে। এমন মন্তব্য লসএঞ্জেলসের শব্দ বিজ্ঞানী ডাঃ ভার্ন ও নুভসেনের।কারখানায় পুরানো যন্ত্রপতি বদলে নতুন যন্ত্রপাতি আনতে হয়। লক্করমার্কা যন্ত্রের হট্টগোল বেশী। কারখানার অবাঞ্চিত শব্দের উৎস যেমন জেনারেটর দূরে বসাতে হবে। কর্মচারীর ইয়ার মাফ ব্যবহার করতে হবে। শব্দ ৯০ ডেসিবেলের বেশী হলে কারখানার চতুর্পাশ্বে বৃক্ষরাজি লাগাতে হবে এতে শব্দ শোষিত হবে, কাজের পরিবেশ আসবে, থাকবে শান্ত পরিবেশ। শ্রমিকদের শ্রবণশক্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। জোরে হর্ণ বাজানো এবং হাসপাতালের কাছে শব্দ করা নিষিদ্ধ করতে হবে শুধুমাত্র আইন করে নয়, কার্যে পরিণত করে। এজন্য চাই জনগণের সহযোগিতা। শব্দের দৌরাত্ম এবং শব্দ দূষণের বিষময় ফল সম্বন্ধে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। লোকালয় থেকে অনেক দূরে এরোড্রাম থাকবে। অন্ততঃ এসব স্থানে মনুষ্যকৃত শব্দ ও হট্টগোল আমরা নিজেরা ইচ্ছা করলে কমাতে পারি। যেখানে জনসমাবেশ হয় সেখানে হট্টগোল কমাতে হবে। অযথা লাউডস্পিকার ব্যবহার, উচু ভলিউমে বাদ্যবাদন, পটকা ফোটানো বন্ধ করতে হবে। শুধু আইন করে বা উপদেশ বিতরণ করে এ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। এজন্য জনগণের সহযোগিতা চাই। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে শব্দ দূষণ রোধে এগিয়ে আসতে পারেন। কিভাবে শব্দ দূষণ এড়ানো যায় সে সম্বন্ধে ব্যাপক জনশিক্ষার প্রয়োজন। শব্দ মানুষেরই সৃষ্টি। আর এ শব্দ দানব হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। দূষিত করছে পরিবেশ। এ থেকে রেহাই পেতে আমাদের নিজেদেরকে অনর্থক হট্টগোল সৃষ্টির পথ থেকে দূরে চলে আসতে হবে। কারণ উৎকট শব্দে আজ আমরা পরিশ্রান্ত। মনে হয় বলি, দাও ফিরে সে অরণ্য লহ হে নগর।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন