Inqilab Logo

রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

খোঁড়াখুঁড়ির শেষ কবে

রাজধানীর দিলকুশা সড়ক

সায়ীদ আবদুল মালিক | প্রকাশের সময় : ২৬ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০২ এএম

রাজধানীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা মতিঝিল, দিলকুশা ও ফকিরাপুলের বিভিন্ন সড়কে একযোগে চলছে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। সড়কজুড়ে রাখা হয়েছে সাড়ে পাঁচ ও তিন ফুট ব্যাসের পাইপ। খুঁড়ে তোলা মাটি ও পিচ-পাথরের বড় বড় খন্ড সড়কেই স্তূপ করে রাখা হয়েছে। বৃষ্টির মৌসুমে অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ এই সড়কগুলোতে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সৃষ্টি হয়েছে চরম জনদুর্ভোগ। এ নিয়ে ঢাকার এসব এলাকার বিভিন্ন অফিসের লোকজন, দোকানি, যানবাহনের আরোহী ও পথচারীদের বিরক্তির শেষ নেই।

দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা রাজধানীর মতিঝিল। তারই পাশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দিলকুশার প্রধান সড়কটি উন্নয়ন কাজের নামে কেটে অসমাপ্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে প্রায় ৪ মাসের বেশি সময়। ফলে এই সড়ক দিয়ে চলাচলকারীরা পড়েছে দুর্ভোগে। প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ দীর্ঘায়িত হওয়ায় বৃষ্টি হলে কাদা-পানি আর রোদ উঠলে বাতাসে ধূলিকণা ছড়িয়ে পড়ছে। এতে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি বৃষ্টির পানি জমে সৃষ্টি হয় বিপজ্জনক পরিস্থিতির। সড়কজুড়ে মাটি স্তূপ করে রাখায় ব্যাহত হচ্ছে যানবাহন চলাচল। এ কাজ কবে শেষ হবে সে ব্যাপারে কারোই কিছু জানা নেই।

এ চিত্র শুধু মতিঝিল দিলকুশা এলাকার নয়। রাজধানীজুড়েই চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। নগরীর এমন কোনো সড়ক বা অলিগলি নেই, যেখানে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে না। এর মধ্যে দু-একটি সড়ক দিয়ে কোনো রকম চলাফেরা করা গেলেও অনেক রাস্তায় এখন চলাচল কষ্টসাধ্য। সিটি কর্পোরেশন ড্রেনেজ ব্যবস্থার কাজ, মেট্রোরেলের কাজ, ওয়াসা, তিতাস, ডেসকোসহ সবাই মিলে প্রতিদিনই কোনো-না-কোনো সড়ক, অলিগলি খুঁড়ছে। আজ এই প্রতিষ্ঠান কাটছে তো কাল কাটছে আরেক প্রতিষ্ঠান। এমনকি এক প্রতিষ্ঠান কাজ শেষ করে চলে যাওয়ার পরদিন আরেক প্রতিষ্ঠান এসে নতুন করে খুঁড়ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এমন সমন্বয়হীনতায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন রাজধানীবাসী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশাসনের ব্যর্থতা বা দুর্বলতার জন্যই নগরীর এই বেহাল দশা।

নিয়ম অনুযায়ী বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ঢাকার রাস্তা খনন করা যায় না। সিটি কর্পোরেশন থেকে এই নিয়ম করা হয়। অথচ খোদ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) অসময়ে রাস্তা খননের কাজ করছে। বলা হচ্ছে, পানিবদ্ধতা কমাতে পাইপ বসানোর জন্য এই খোঁড়াখুঁড়ি।

গতকাল রোববার দুপুরে দিলকুশায় গিয়ে দেখা যায়, পিপলস ইনস্যুরেন্স ভবনের কাছে বড় বড় গর্ত করা হয়েছে। খোঁড়ার পর মাটি এবং পিচ-পাথরের বড় বড় খন্ড এলোপাতাড়িভাবে রাস্তার ওপরই রাখা হয়েছে। পিপলস ইনস্যুরেন্স ভবন থেকে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) ভবন হয়ে প্রায় ২০০ মিটার পশ্চিমে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস কার্যালয় পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ ফুট ব্যাসের অনেকগুলো পাইপ রাখা। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে দেখা যায়, এভাবে খোঁড়াখুঁড়ি করা এবং পাইপ রাখার কারণে পুরো এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণত অফিস ছুটি হলে বিসিআইসি ভবনের সামনে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার বাসের কারণে যানজট লেগে থাকে। বর্তমানে তা আরো তীব্র হয়েছে। গর্ত আর বড় বড় পাইপ রাখায় গতকাল সেখানে পাশাপাশি দু’টির বেশি বাসও রাখা যাচ্ছিল না। সেসব বাসের কয়েকটি দাঁড়ায় বঙ্গভবনের সীমানাদেয়ালের পার্শ্ববর্তী রাস্তায়। এর ফলে আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকের পাশে মতিঝিল এলাকায়, ইসলামী ব্যাংক ভবনের কাছে দিলকুশা এলাকায়, এমনকি রাজউক ভবনের দক্ষিণ দিকের রাস্তায়ও যানবাহন প্রায় স্থবির হয়ে ছিল। বিসিআইসি ভবনের কাছে ফলমূল আর সবজির বাজার বসে। কিন্তু এখন তা বসছে বিচ্ছিন্নভাবে। অনেকে পাইপের ভেতরে পণ্যসামগ্রী রেখেছেন। সেখানে ছোট ছেলেদের পাহারায় বসানো হয়েছে।

ছুটির পর যানজট আর পথচারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হাঁটার জায়গাও থাকে না। অফিস শেষে বিসিআইসির কর্মকর্তা আমির হোসেন রাস্তায় নেমেই বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, কথা নেই, বার্তা নেই বৃষ্টির সময় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করেছে। সিটি কর্পোরেশনের কি কোনো কান্ডজ্ঞান নেই? একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা বিলকিস আঞ্জুমান নারিন্দা যাবেন। রিকশা খুব কম। একটি রিকশা যেতে রাজি হলে দরদাম না করেই উঠে পড়েন। পরে দেখা গেল, রিকশা সামনে এগোতেই পারছিল না। বিরক্ত হয়ে নেমে তিনি হাঁটা শুরু করলেন। তিনি একটু জোরের সঙ্গেই খেদোক্তি করেন, আর কতদিন এ ভোগান্তি ও কষ্ট সহ্য করতে হবে আমাদেরকে।

ফকিরাপুলে পানির ট্যাংকের বিপরীত দিকে প্রায় ১৫০ মিটার রাস্তা খোঁড়া হয়েছে। একটু পর পর বিশাল গর্ত। সেখানেও গর্তের মাটি আর রাস্তার ভাঙা অংশ যথেচ্ছভাবে রাখা হয়েছে। এতে ওই সড়কে যানজট বেড়ে গেছে। জের পড়েছে একদিকে দৈনিক বাংলার মোড় এলাকায়, অন্যদিকে নয়াপল্টন ও পুরানা পল্টন কালভার্ট রোডে। যে অংশে খেঁাঁড়া হয়েছে তার কাছেই বাসাবোসহ ঢাকার পূর্বাঞ্চলীয় কয়েকটি এলাকার টেম্পো চলাচল করে। এখন চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে। স্থানীয় পদ্মা গ্লাসের কর্মচারী রফিকুল ইসলাম ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, দুই বছর আগেও এই সড়কে সিটি কর্পোরেশন খোঁড়াখুঁড়ি করেছে। পাইপ বসানোর ছয় মাস পর সড়ক মেরামত করা হয়। বর্তমানে যেখানে খোঁড়া হচ্ছে, সে সময় তা বাদ রাখা হয়েছিল। এখন এই অংশ খুঁড়ে নতুন করে দুর্ভোগের সৃষ্টি করা হয়েছে।

ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট ২ নম্বর অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ বলেন, দিলকুশা ছাড়াও মতিঝিল, ফকিরাপুল, নয়াপল্টনসহ আশপাশের এলাকার পানিবদ্ধতা কমাতে পাইপ বসাতে হচ্ছে। অফিসিয়াল কিছু সমস্যার জন্য কার্যাদেশ পেতে দেরি হয়েছিল। যে জন্য কাজটি শুরু করতে একটু দেরি হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা হবে বলে তিনি জানান। তবে কত দিনের মধ্যে খনন ও পাইপ বসানোর কাজ শেষ করা হবে, তা তিনি নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি।

এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-৫ এর মানিকনগর বিশ্বরোড থেকে বালুর মাঠ সড়কে গত ৬ মাসে ৩ বার কার্পেটিং করেছে। বর্তমানে রাস্তাটির অবস্থা এমন আকার ধারণ করেছে যে, কোনো সুস্থ মানুষ এ রাস্তা দিয়ে দু’বার যাতায়াত করার পর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। এছাড়াও রাস্তাটির বেশ কয়েক স্থানে ম্যানহোলের ওপর স্লাব ব্যবহার করতে হয়। সেই স্লাবের দশাও করুণ। এ স্লাবগুলো কি ইট-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি, নাকি কাদা-মাটি দিয়ে তৈরি। তা নিয়েও জনমনে প্রশ্নের দেখা দিয়েছে। ম্যানহোলের মুখে স্লাব বসিয়ে যাওয়ার দুয়েক দিনের মাথায় এগুলো ভেঙে ঝুরঝুরে মাটির মতো হয়ে দেবে যায়। এতে করে এই পথ দিয়ে চলাচলকারীদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। প্রতিদিন দেড় কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথেই বসে থাকতে হয়।

এছাড়া খোঁড়াখুঁড়ি চলছে রাজধানীর পান্থপথে স্কয়ার হাসপাতালের কাছ থেকে পশ্চিমে গ্রিন রোড মোড়েও। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পুরো সড়কে যানজট। গর্ত খোঁড়ায় স্কয়ার হাসপাতাল, শমরিতা হাসপাতালসহ স্থানীয় সব হাসপাতালে রোগী এবং তাঁদের নিকটজনদের যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছে। শমরিতা হাসপাতালের সামনের সড়ক সবচেয়ে বেশি খোঁড়া হয়েছে। রাখা হয়েছে তিন ফুট ব্যাসের পাইপ। এমনিতেই এলাকার সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল রাখা নিষেধ। এখন গর্ত থাকায় গাড়ি থামানোও যাচ্ছে না। যেসব ব্যক্তি হাসপাতালে আসছেন, তাদের অনেক দূরে নামতে হচ্ছে।

খোঁড়াখুঁড়ির ব্যপারে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে নেই কোনো তদারকি। ঠিকাদাররা যে যেমন খেয়ালখুশি মতো কাজ করছেন। একটু বৃষ্টিতেই কাদা-পানিতে একাকার হয়ে রাস্তায় চলাচলের উপায় থাকে না। রাস্তার মাঝখানে যখন তখন বিকল হয়ে যাচ্ছে গাড়ি। প্রতিনিয়তই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। অফিস আদালত ও কর্মমুখী মানুষ এবং স্কুল, কলেজ, মাদরাসার শিক্ষার্থীরা সকালে ঘর থেকে বের হয়েই পড়ছে চরম ভোগান্তিতে। নগরজুড়ে অসহনীয় যানজটে পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। আবার কোথাও বা যানবাহনের সঙ্কটে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সামান্য বৃষ্টি হলে ইচ্ছা থাকলেও ময়লা, কাদা-পানি ও খানাখন্দে ভরা রাস্তায় পায়ে হাঁটা সম্ভব হয় না। আবার রোদ উঠলে বাতাসে ধুলাবালি উড়ে চোখ-মুখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাসের সাথে ধুলাবালি নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট ও অ্যাজমাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়ক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ