Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আত্মহত্যার প্রতিকার জরুরি

| প্রকাশের সময় : ২৯ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

দেশে আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষত কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে একদিকে অপরাধ প্রবণতা, গ্যাং কালচারের বিস্তৃতি অন্যদিকে আত্মহত্যার প্রবণতা পুরো সমাজের জন্য উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশু-কিশোররা জাতির ভবিষ্যত। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ২০.৫ ভাগের বেশি বা প্রায় সাড়ে তিন কোটির বয়েস ১২ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান যারা স্কুল-মাদরাসায় যাওয়ার সুযোগ পায় না বা ড্রপ-আউটদের বাদ দিলে শিশু কিশোরদের সবাই স্কুল-মাদরাসার শিক্ষার্থী। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ‘বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ’ নামের একটি সংস্থার সাম্প্রতিক জরিপ উল্লেখ করে বলা হয়, দেশে বর্তমানে বছরে গড়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করছে। আত্মহত্যার হারে পুরুষের চেয়ে নারীদের সংখ্যা বেশি এবং বয়েসের স্তর হিসেবে কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যাই বেশি। একেক সমাজে ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আত্মহত্যার কারণ ও ধরণ একেক রকম। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের কৃষকদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, এনজিও ও মহাজনী ঋণে জর্জরিত হয়ে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে হতাশায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার কথা জানা যায়। এ ধরনের বাস্তবতা কমবেশি আমাদের সমাজেও আছে। সেই সাথে পারিবারিক কলহ, নির্যাতন ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে জজর্রিত হয়ে এবং অবৈধ সম্পর্কের কারণে সামাজিকভাবে হেয় ও অপমানিত হয়ে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে থাকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আত্মহত্যার কারণ অনেকটাই বদলে গেছে। তথ্যপ্রযুক্তি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সাইবার জগতের সাথে অতিরিক্ত সম্পৃক্ততা বিশেষত কিশোর-তরুনদের জীবন ধারা ও চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

মানব সম্পদই হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। এ সম্পদ গড়ে ওঠার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টি হচ্ছে কৈশোরকাল। শিশু-কিশোরদের সত্যিকার মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষাই যথেষ্ট নয়। মূলত পারিবারিক বন্ধন, শৃঙ্খলা, মাতা-পিতা ও আত্মীয় পরিজনদের স্নেহ পরিচর্যা ও ধর্মীয়-সামাজিক মূল্যবোধের উপর গড়ে ওঠে মানুষের উন্নত নৈতিক চরিত্রের ভিত্তি। ভ্রান্ত শিক্ষানীতি, স্যাটেলাইট টিভি এবং ফেইসবুক-ইউটিউব চ্যানেলের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তির প্রভাব আমাদের নতুন প্রজন্মকে পরিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ থেকে ক্রমেই দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। হিন্দি সিরিয়ালের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সিরিয়ালের চরিত্রের মত পোশাক কিনতে না পারার ব্যর্থতায় আত্মহত্যা করা। ফেইসবুকে আবেগি পোস্ট দেয়া এবং লাইভ সম্প্রচারে এসে আত্মহত্যার মত চরম ক্লাইমেক্সের সাথে আমাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার চাইতে সাইবার বাস্তবতাই বেশি সম্পৃক্ত। একশ্রেণীর কিশোর তরুণ বিদেশি ছবির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গ্যাংস্টার হয়ে উঠতে চাইছে, তারা এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চারিজম, অসহিষ্ণুতাসহ মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় ভুগে সামাজিক অস্থিতিশীলতার কারণ হচ্ছে। পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল বা পারিবারিক কারণে কেউ কেউ স্কুল-কলেজে ড্রপ-আউট হয়ে অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠছে অথবা অবসাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আবার কেউ কেউ স্কুল-কলেজের সামনে ইভটিজিংয়ে লিপ্ত হচ্ছে এবং তাদের ইভ টিজিংয়ের যন্ত্রনা সইতে না পেরে আরেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। আমাদের সমাজদেহে এ যেন মনস্তাত্তি¡ক সংকটের এক দুষ্টচক্র।

আত্মহত্যা অপরাধ প্রবণতা ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়ে সমাজে অনেক উদ্বেগ ও আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও অবস্থার পরিবর্তনে এর মূলে কেউ হাত দিচ্ছে না। স্কুল-কলেজে নৈতিক শিক্ষার অনুপস্থিতি, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে আত্মহত্যা ও অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে, এটা জানা কথা। এ থেকে উত্তরণে পারিবারিক বন্ধনকে আরো দৃঢ় করাসহ সামাজিক সচেতনতার পরামর্শ দেন মনস্তত্ত্ববিদরা। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা। শিশু-কিশোরদের পাঠ্যপুস্তক, মোবাইল ফোন ও স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ও হিন্দি সিরিয়ালের বাইরে নিয়ে যেতে খেলাধুলা, সহশিক্ষা কার্যক্রম, সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক বিনোদন এবং সামাজিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। পরিবারে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ শিশু-কিশোরদের মননশীলতা বিকাশের উপযোগি করে গড়ে তুলতে হবে। এক রিপোর্টে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেড়ে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে গত ৩ বছরে ১১শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। কৈশোর পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রী পাওয়ার পরও এমন মনস্তাত্তি¡ক বিপর্যয়ের কারণ সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তেমন কিছুই করছে না। সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা এসব সামাজিক সংকট সম্পর্কে উদাসীন। ঢাবির ৩৮ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ‘ছাত্র-নির্দেশনা ও পরামর্শদান দপ্তর’ নামে একটি দপ্তর এবং সেখানে একজন মাত্র কাউন্সিলর বা পরামর্শক রয়েছেন বলে জানা যায়। এই দপ্তরের পরিসর এবং কার্যক্রম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া এখন সময়ের দাবী। পাশ করার পরও চাকুরী না পাওয়া, নিরাপত্তাহীনতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতাও তরুন-তরুনীদের আত্মহত্যার আরেকটি কারণ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। কিশোর-তরুনদের আত্মহত্যা, অপরাধ প্রবণতা, বেপরোয়া ও অপরিনত উচ্ছ্বাস, মাদকাসক্তি এবং পারিবারিক-সামাজিক সহিংসতা বৃদ্ধির সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো দূর করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন