Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাংগঠনিক দুর্বলতা নিরসনে বিএনপির উদ্যোগ

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ২৯ আগস্ট, ২০১৯, ৫:৪৫ পিএম | আপডেট : ১২:৩৬ এএম, ৩০ আগস্ট, ২০১৯

কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে কমিটি নির্বাচন ছাত্রদলের কমিটি গঠনের পর পর্যায়ক্রমে সব কমিটির নির্বাচন হবে


সাংগঠনিক দুর্বলতা দূর করে রাজপথে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলাই বিএনপির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ উত্তোরণে দল পুনর্গঠনের লক্ষে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বিএনপি। আর এবার কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে দলের সর্বস্তরের কমিটি গঠন করার প্রস্তুতি চলছে। উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া কমিটি আর গঠিত হবে না।

আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর বিএনপির অন্যতম সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কাউন্সিলে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনের এ প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। ছাত্রদলের কাউন্সিলে নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা নির্বাচন প্রক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন হলে পরে যুবদল, কৃষকদল, শ্রমিকদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলসহ বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক জেলাতেও সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে নেতা নির্বাচিত হলে দলে গণতান্ত্রিক চর্চা যেমন হয় তেমনি সঠিক নেতৃত্বও উঠে আসে। এ প্রক্রিয়ায় কমিটি হলে যোগ্য ও ত্যাগীরাই নেতৃত্বে আসবেন। শুধু তাই নয়, এ প্রক্রিয়ায় সঠিক নেতৃত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে সাংগঠনিক কর্মকাÐ গতিশীল হবে। পাশাপাশি সর্বস্তরেই দল সিন্ডিকেট বা গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত হবে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. এমাজউদ্দিন আহমদ বলেন, সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে জনপ্রিয়তা থাকার পরও বিএনপি রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না। তাই সাংগঠনিক দুর্বলতা দূর করতে দল পুনর্গঠনের কোন বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে যদি কমিটি গঠন করা হয় তাহলে সঠিক নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে। আর তাতে সকল দুর্বলতা কাটিয়ে সংগঠন অত্যন্ত গতিশীল হবে এবং রাজপথেও জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সকল পর্যায়ে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকট। বিভিন্ন জেলা পর্যায়ের কমিটির যেমন বেহাল অবস্থা তেমনি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিরও নাজুক অবস্থা। ২০১৬ সালে দলের ষষ্ঠ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত। কাউন্সিল হওয়ার প্রায় সাড়ে চার মাসের বেশি সময় পর বিএনপি নতুন নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করে। ঘোষিত এ কমিটিতে ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির মধ্যে ১৭ সদস্যের নাম, ৭৩ জন উপদেষ্টা, ৩৫ জন ভাইস চেয়ারম্যানসহ মোট ৫০২ সদস্যের বিশাল কমিটি ঘোষণা করা হয়। তবে এত বিশাল বড় কমিটি করার পরও সাংগঠনিক কর্মকাÐ গতিশীল হয়নি। বর্তমানে এই কমিটির অবস্থা বড়ই নাজুক। দলের স্থায়ী কমিটির ১৯ সদস্যের মধ্যে চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাইরে, ৬ জন মৃত্যুবরণ করেছেন এবং অসুস্থ ৪ জন সদস্য। এর মধ্যে মাত্র ২ জনকে নতুন করে স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয়েছে। ফলে ১০ জন সদস্য দিয়ে বর্তমানে নীতি-নির্ধারণী কর্যক্রম চলছে। চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদ, ভাইস চেয়ারম্যানসহ দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির অন্যান্য পদ-পদবিতেও প্রায় একই রকম চিত্র। এদের মধ্যে কেউ মারা গেছেন, অনেকে অসুস্থ, আর অধিকাংশই নিষ্ক্রিয়। এ অবস্থায় দলকে গতিশীল করতে সাংগঠনিক পুনর্গঠন অত্যন্ত জরুরি বলে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা মনে করেন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চরম ভোট জালিয়াতি ও অনিয়মের কারণে বিএনপির পরাজয়ের পর শীর্ষ নেতারা দল পুনর্গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তৃণমূল পর্যায়ে অর্থাৎ অনেক জেলা-উপজেলায় নতুন কমিটি গঠন শুরু হলেও তা বিভিন্ন কারণে থমকে গেছে। এতে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় দলের নেতাকর্মীরা। সম্প্রতি দেশের কয়েকটি বিভাগীয় শহরের বিএনপির জনসভায় ব্যাপক উপস্থিতিতে দলের জনপ্রিয়তা আবার প্রমাণ হয়েছে। দেশব্যাপি প্রচুর জনসমর্থন থাকার পরও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে কোনো ইস্যুতেই দলটি কার্যকর গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না।

বিএনপির অনেক নেতাকর্মী বলেন, বর্তমান সরকারের দমন-পীড়ন তথা স্বৈরাচারী আচরণ, নেতাকর্মীদের কারাভোগ এবং তাদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা-হামলায় অনেকে ঘর ছাড়া। এ ছাড়া নানা বৈরী পরিবেশ, কালাকানুনসহ নেতৃত্বের সাহসী পদক্ষেপ ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতায় সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠছে না। তারা মনে করেন কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে দ্রæত সাংগঠনিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে দলকে চাঙ্গা করে আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব।

এ বিষয়ে দলের কয়েকজন প্রবীণ নেতা অত্যন্ত দু:খের সাথে বলেন, ১৯ জন স্থায়ী কমিটির সদস্যের মধ্যে ৬ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। ৪ জন অসুস্থ। তার স্থলে মাত্র দু’জনকে নতুন করে স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয়েছে। স্থায়ী কমিটির অবশিষ্ট পদ এবং ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা মÐলীর শূন্যপদগুলো কেন দ্রæত পূরণ করা হচ্ছে না? জাতীয় নির্বাহী কমিটিরও শূন্যপদগুলোতে কো-আপ বা দ্রæত পূরণ করা উচিত।

তারা বলেন, দলে অনেক যোগ্য ও ত্যাগী নেতা আছেন। তারা দলের জন্মলগ্ন থেকে দলের সাথে সম্পৃক্ত আছেন। অথচ তাদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন না করায় অনেকে এখন অভিমানে অনেকটা চুপচাপ বসে আছেন বা নিষ্ক্রিয়। অথচ তাদেরকে দলের যথাযথ পদে জায়গা করে দিলে দলের কর্মকাÐ অনেক গতিশীল হবে। নেতাকর্মীরাও তাদেরকে পাশে পেলে আরও উজ্জীবিত হবে।

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ১৯ সদস্য বিশিষ্ট বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম তথা স্থায়ী কমিটি রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে কাউন্সিলের পর এই ১৯ সদস্যের মধ্যে ১৭ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। এর কিছুদিন পর আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয়। ১৯ জন স্থায়ী কমিটির সদস্যের মধ্যে দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রæয়ারি থেকে কারাবন্দি। পদাধিকার বলে স্থায়ী কমিটির সদস্য দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে। ইতোমধ্যে মারা গেছেন, ড. আর এ গণি, মো: তরিকুল ইসলাম, এম শামসুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ, এমকে আনোয়ার ও সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরী।

এ ছাড়া ভারতে বিচারাধীন এক মামলার আসামি হিসাবে আছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে যারা কার্যক্রম চালাচ্ছেন তারা হলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী।

তাদের সাথে সম্প্রতি ২ জন নতুন সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং বেগম সেলিমা রহমান যুক্ত হয়েছেন। এসব নেতাদের মধ্যে ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিঞা অসুস্থ থাকায় বেশিরভাগ সময় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থিত হতে পারেন না। এ অবস্থায় মাত্র ১০ জন সদস্য দিয়ে বর্তমানে স্থায়ী কমিটির কার্যক্রম চলছে।

যে কোনো বিষয়ে দ্রæত সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের কর্মকাÐ গতিশীল করতে স্থায়ী কমিটির শূন্যপদ দ্রæত পূরণ করা উচিত বলে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী মনে করেন। দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা যাদেরকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করা যেতে পারে বলে মনে করেন তারা হলেন, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আব্দুল্লাহ আল নোমান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহাবুব হোসেন, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর (বীর উত্তম), মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (বীর প্রতীক), আব্দুল আউয়াল মিন্টু, ডা: এ জেড এম জাহিদ হোসেন, শফি বিক্রমপুরী, মিজানুর রহমান মিনু, তৈমুর আলম খন্দকার প্রমুখ। এ সব নেতাদের মধ্যে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ছাড়া অন্য সবাই ৩৫-৪০ বছর যাবৎ দলের সাথে সম্পৃক্ত থেকে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ছাত্রদলের কাউন্সিল শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য কমিটির নির্বাচনও এভাবেই সম্পন্ন করা হবে। আর আমাদের দলের কাউন্সিল আগামী অক্টোবর-নভেম্বর মাসের করার প্রস্তুতি চলছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিএনপি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ