Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

কাশ্মীর ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়

সপ্তম কিস্তি

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ৩:০৬ পিএম | আপডেট : ৩:০৮ পিএম, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

বিজেপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কাশ্মীরের বিষয়টি একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে অন্য কোনো দেশের সম্পর্ক নেই। পক্ষান্তরে পাকিস্তান এর বিরোধিতা করেছে। চীনও বিরোধিতা করেছে। পাকিস্তান অবশ্যই কাশ্মীর ইস্যুর একটা পক্ষ। তাকে বাদ রেখে কাশ্মীরের ব্যাপারে ভারত একা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ভারত পক্ষ হিসেবে পাকিস্তানকে উপেক্ষা বা অস্বীকার করেছে। চীনকেও গণনায় আনেনি। খোদ কাশ্মীরিদেরও বেতোয়াক্কা করেছে। কাশ্মীরে প্রশাসনিক পরিবর্তন আনা হচ্ছে, সংবিধান থেকে তার মর্যাদা ও সুযোগ রহিত করা হচ্ছে অথচ কাশ্মীরিদের সঙ্গে কোনো আলোচনা বা তাদের সম্মতি নেয়ার প্রয়োজন দেখানো হয়নি। কাশ্মীরি জনগণের প্রতি এ ধরনের উগ্র আচরণ, আগ্রাসী চিন্তা ও সিদ্ধান্তেরই ফল।
১৯৪৭ সালে যখন কাশ্মীর ইস্যু সৃষ্টি হয় তখনই এটি বহুপক্ষীয় ইস্যু। এর এক পক্ষে ভারত তো ছিলই, সেই সঙ্গে অন্য পক্ষে ছিল কাশ্মীরি জনগণ এবং পাকিস্তান। কাশ্মীর ভারতভুক্ত হবে না পাকিস্তানভুক্ত হবে, নাকি স্বাধীন থাকবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার রাজা হিসেবে হরি সিংয়ের থাকলেও জনগণের মতামত ও উপেক্ষণীয় ছিল না। হরি সিং হয়তো প্রথম দিকে স্বাধীনই থাকতে চেয়েছিলেন। আবার ভারতে বা পাকিস্তানে যোগদান করার সম্ভাবনার বিষয়টিও তিনি খতিয়ে দেখেছেন। তিনি জিন্নাহ ও নেহরুর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেন। তবে নানাদিক থেকে চাপ আসতে থাকায় শেষ পর্যন্ত তিনি ভারতে যোগদান করতে মনস্থির করেন। এদিকে ১৪-১৫ আগস্টের পর জন্মু ও কাশ্মীর জুড়ে সাম্প্রদায়িক হানাহানি দেখা দেয়। এই দাঙ্গা বাধায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের পাÐারা। জম্মুতে হিন্দুর সংখ্যা বেশি হওয়ায় দাঙ্গা সেখানে ভয়াবহ আকার ধারণ করে এবং প্রধানত মুসলমানরাই নিহত হয়। কাশ্মীরে মুসলমানরা ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকায় সেখানে দাঙ্গাবাজরা সুবিধা করতে পারে না। সেখানে ব্যাপক উদ্বেগ ও বিক্ষোভের ঢেউ ওঠে এবং জনগণের মধ্যে পাকিস্তানে যোগদান ছাড়া যে বিকল্প নেই, এই ধারণা নিরঙ্কুশ শক্তি অর্জন করে। প্রত্যক্ষদর্শী ও ঐতিহাসিকদের অনেকে দাবি করেন, জম্মুতে দাঙ্গা ও মুসলিম গণহত্যার জন্য রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের সশস্ত্র সদস্যরা যেমন দায়ী তেমনি রাজার বাহিনীও কম দায়ী নয়। তারাও গণহত্যায় অংশ নেয় ও দাঙ্গাকারীদের সহযোগিতা করে। কেউ কেউ স্পষ্ট বলেছেন, এ গণহত্যায় রাজা স্বয়ং প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ও দায়ী ছিলেন। কত মুসলমান এই দাঙ্গায় নিহত হয়, তার পরিসংখ্যান নিয়ে কিছু মতভেদ থাকলেও সকলেই একমত, অন্তত, দুই থেকে আড়াই লাখ মুসলমান এই দাঙ্গায় নিহত হয়। অনেকে প্রাণভয়ে বর্তমান আজাদ কাশ্মীর অঞ্চলে পালিয়ে যায়।
ঘটনাপ্রবাহের এই প্রেক্ষাপটে ২২ অক্টোবর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পাঠানরা তাদের কাশ্মীরি ভাইদের সুরক্ষা ও হিন্দু দাঙ্গাবাজদের প্রতিহত করতে কাশ্মীরে প্রবেশ করে বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে নেয়। এমন পরিস্থিতিতে হরি সিং ২৫ অক্টোবর প্রায় ১০০টি ট্রাকে করে যাবতীয় নিজস্ব সম্পদসহ কাশ্মীর ছেড়ে যান। ২৬ অক্টোবর তিনি ভারতে যোগদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন এবং যোগদান সংক্রান্ত চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এই যোগদানচুক্তি স্বাক্ষরের পর ভারতীয় বাহিনী কাশ্মীর দখলে নিয়োজিত হয়। পাঠানরা কাশ্মীরের অভ্যন্তরে যে অংশ অধিকার করেছিল তার বিরাট অংশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কিছু অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে, যা এখন আজাদ কাশ্মীর হিসেবে পরিচিত। দু’পক্ষের এই সংক্ষিপ্ত লড়াইয়ের প্রেক্ষিতে নেহরু বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করেন। দুই তরফেই তাদের স্ব স্ব নিয়ন্ত্রিত এলাকা খালি করে দিয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গণভোটের প্রস্তাব দেয়। জাতিসংঘে এ প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। আগেই বলা হয়েছে, এ প্রস্তাব আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
দুই পক্ষের দখলকৃত অংশের সীমানা ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ হিসেবে এখন পরিচিত। এটি একটি কৃত্রিম সীমান্ত। এর পক্ষে আন্তর্জাতিক কোনো সমর্থন নেই। এযাবৎ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধগুলোর পরও এই লাইন অব কন্ট্রোল বহাল আছে। ১৯৭২ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে স্বাক্ষরিত সিমলা চুক্তিতে লাইন অব কন্ট্রোলকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কার্যত কাশ্মীরে এটাই দুই দেশের রাষ্ট্র সীমারেখা। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ এই সিমলা চুক্তিকে আর এখন মান্য করতে রাজি নন। কিছুদিন আগে তিনি পার্লামেন্টে বলেছেন, প্রাণ দিয়ে হলেও তিনি পাকিস্তানভুক্ত কাশ্মীরের অংশ এবং চীনের অধিকৃত অংশ উদ্ধার করে কাশ্মীরের সঙ্গে সংযুক্ত করবেন। জবাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যুদ্ধ বাধলে তার পরিণত কী হবে তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আজাদ কাশ্মীরের দিকে হাত বাড়লে উপযুক্ত জবাব দেয়া হবে বলে পাকিস্তান হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। কাশ্মীর নিয়ে ফের যুদ্ধ বাধতে পারে এ আশঙ্কা অনেকেই উড়িয়ে দিতে চান না। সে যুদ্ধ যে অতীতের মতো হবে না তা অবশ্য না বললেও চলে। যুদ্ধ পরমাণু যুদ্ধে গড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। তেমন যুদ্ধের অবতারণা হলে কেবল ভারত বা পাকিস্তান নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় তার মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে বাধ্য। অমিত শাহরা সাম্প্রদায়িক উন্মাদনায় এতটাই দিশাহারা হয়ে পড়েছেন যে, যুদ্ধের ক্ষতি ও ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা তাদের কল্পনায়ও আসছে না। এটা অনুমান করা যায়, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধলে এই দুই দেশের মিত্ররা তাদের পক্ষাবলম্বন করতে পারে। সে ক্ষেত্রে এ যুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ায় বাইরেও ছড়িয়ে পড়া বিচিত্র নয়।

ষষ্ঠ কিস্তি



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলামী বিশ্ব


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ