Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বিদ্যুৎ খাতের ভুলের খেসারত

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

বর্তমান সরকারের যে দু’চারটি সাফল্য রয়েছে, তার অন্যতম বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি। সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ২০৪১ সাল পর্যন্ত একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, ২০৪১ সালের জন্য ৬১,৬৮১ মেগাওয়াট। আর এটির পর্যালোচনায় গঠিত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৪১ সালের জন্য ৮২,২৯২ মেগাওয়াট। বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ২১ হাজার মেগাওয়াট বলে সরকার দাবি করে। কিন্তু এই দাবি অনুযায়ী উৎপাদন হচ্ছে না। বিদ্যুৎ বিভাগের গত ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্যানুযায়ী, বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ১৩,৩০৬ মেগাওয়াট। চাহিদা ১২.৫ হাজার মেগাওয়াট দৈনিক। গত ১৪ সেপ্টেম্বর উৎপাদন ছিল ৯,২১০ মেগাওয়াট থেকে সর্বোচ্চ ১২,০৩৮ মেগাওয়াট। সাধারণ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে বিশ্বের মধ্যে যে কয়টি দেশ অগ্রগামী, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ‘ট্র্যাকিং এসডিজি ৭ : দি এনার্জি প্রোগ্রেস রিপোর্ট ২০১৯’ মতে, ‘২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে দ্রæত বিদ্যুৎ সুবিধা প্রদানকারী ২০টি দেশের শীর্ষে রয়েছে কম্বোডিয়া। গত আট বছরে গড়ে ৮.৩০% হারে জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসে। ২০১৭ সাল শেষে দেশটির ৮৯.১০% জনগোষ্ঠি বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় রয়েছে। এ তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আফগানিস্তান। এরপর ক্রমান্বয়ে কেনিয়া, তৈমুর-লিস্টা, সেন্টমার্টিন (ফ্রান্সের অংশ), কিরিবাটি, পাপুয়া নিউগিনি, বাংলাদেশ, নেপাল ও সলোমন আইল্যান্ড। উক্ত সময়ে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ গ্রাহক বেড়েছে প্রতি বছর প্রায় ৪.৭% হারে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ৮৮% মানুষ বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়েছে। বর্তমানে আরও দ্রæতগতিতে বাড়ছে। সরকারের দাবি মতে, বর্তমানে দেশে ৯৩% মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। সরকারের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে সকলের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া। সরকার দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে মিয়ানমার, ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আনার ব্যবস্থা করছে। তন্মধ্যে ভারত থেকে মোট আমদানি হবে ২,৯৯৬ মেগাওয়াট। এ জন্য গ্রিড লাইন নির্মাণের ব্যয় অনুমোদিত হয়েছে গত ১৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একনেকের সভায়। নেপালের সাথেও একটি সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। এমনকি ভুটানে পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দেশে আনার চেষ্টা চলছে।

বিদ্যুৎ খাতের এই ব্যাপক উন্নতির বিপরীতে কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। যেমন: দেশে যে হারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সে হারে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। ফলে আগের ব্যবস্থা দিয়েই বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হচ্ছে। এতে সরবরাহে চরম ব্যাঘাত ঘটছে। লোড শেডিং চলছেই। এটা শহরের চেয়ে গ্রামেই বেশি। অথচ বিদ্যুতের মোট গ্রাহকের ৭৬% আইবি’র অধীনেই। কিন্তু নিরবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ না পাওয়ার কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়া ছাড়াও শিল্পের চরম ক্ষতি হচ্ছে। বিনিয়োগও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই শিল্পপতিরা ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। এসব নিয়ে গত ১৪ সেপ্টেম্বর সরকার ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তাতে উভয় পক্ষ খোলামেলা আলোচনা করে, যার সারাংশ হচ্ছে: ‘সভায় সরকারি পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও শিল্প মালিকরা নিজস্ব ক্যাপটিভ বিদ্যুতে প্রয়োজন মেটাচ্ছেন। এতে গ্রিডের অনেক বিদ্যুৎ অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। এ নিয়ে এখন সরকারের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। সরকার দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, শিল্পে এ বিদ্যুৎ ব্যবহার করা গেলে সংকট সামাল দেয়া সহজ হতো। অপরদিকে, ব্যবসায়ীরা বলেছেন, দেশব্যাপী দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার কারণে বিতরণ কোম্পানিগুলো শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে পারছে না। আগামী ১০ বছরেও এ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন ঠিক করা সম্ভব হবে না। সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের অবস্থা এতটাই খারাপ যে, একটু ঝড়-বৃষ্টি হলেই লাইন ট্রিপ করে। গাছের ডালপালার আঘাত, এমনকি ছোটখাটো পাখির ডানা ঝাপটানোয়ও ট্রিপ করছে গ্রিড লাইন। এ কারণে ব্যবসায়ীরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা চাইছেন। এটি এখনও সরকারের পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।’ সভায় একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যে কমিটি একটি সুপারিশ পেশ করবে। স্মরণীয় যে, দেশে চাহিদা মাফিক বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কমপক্ষে এক লাখ কোটি টাকা দরকার বলে জানা গেছে। আরও জানা গেছে, উৎপাদন অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারার কারণে সক্ষম বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। যে কোন পণ্যের উৎপাদন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তার মার্কেটিংয়ের ব্যবস্থাও করা জরুরি। তবুও দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকেই শুধুমাত্র গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরবরাহের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি মোটেও। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। এই অবস্থা চরম অদূরদর্শিতার কারণেই হয়েছে, যার খেসারত দিতে হচ্ছে জাতিকে। বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করতে আরইবি বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় সম্ভাব্যতা জরিপ শুরু করছে, যা শেষ হবে আগামী ডিসেম্বরে। এ কাজ নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হবে কি-না, হলেও তার বাস্তবায়ন হবে কবে তা বলা কঠিন। যা’হোক, বিদ্যুৎ খাতের আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের বিদ্যুৎ ক্রয় না করার এবং ত্রিপুরা থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু, শীতকালে ভারতে বিদ্যুৎ রফতানির চেষ্টা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতের দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, মূল্য অত্যধিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স¤প্রতি জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘আমাদের বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ২৬ টাকা মেগাওয়াট। কিন্তু বিক্রি করা হয় ৩-৪ টাকা মেগাওয়াট।’ দেশে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির কারণগুলোর অন্যতম হচ্ছে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের বিদ্যুৎ ক্রয়। কারণ, এর মূল্য ১৯-২০ টাকা মেগাওয়াট। আর সরকারি খাতের উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্য এর অর্ধেকেরও কম। এছাড়া, দেশে বিদ্যুৎ প্লান্ট নির্মাণের ব্যয় বেশি। উপরন্তু সিস্টেম লস এখনো ১০% এর বেশি, যার বেশিরভাগ চুরি। সর্বত্রই প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করতে পারলে বিদ্যুতের চুরি ও অপচয় অনেক হ্রাস পেত। সর্বোপরি দেশে মজুদকৃত গ্যাস প্রায় শেষ হয়ে আসছে। ফলে আমদানিকৃত এলপিজি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। তাতে করে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। গ্যাসের প্রতি ঘনমিটারের দাম দেশীয় ৫ টাকার কম, আর আমদানি করা এলপিজির দাম পড়ছে ৩২.৩১ টাকা। অবশ্য, রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের বিদ্যুৎ ক্রয় বন্ধ করা হলে বিদ্যুতের ভর্তুকি হ্রাস পাবে। সব মিলে বিদ্যুৎ খাতের লোকসান ব্যাপক। ২০০৯-১০ অর্থবছরে পিডিবি’র লোকসান ছিল ৩৯৬ কোটি টাকা, আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ সংস্থাটির লোকসানের পরিমাণ ৬,২০৮ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত গত ১০ বছরে পিডিবি’র লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। স্মরণীয় যে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ তার আগের বছরের চেয়ে আরও বেশি হবে। বিদ্যুৎ খাতের এই ব্যাপক লোকসানের প্রধান কারণ হচ্ছে, ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ ক্রয়। তবুও স্বল্প মূল্যের সরকারী বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের সংস্কারের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে তিনগুণ বেশি মূল্যে ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ ক্রয়ের দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বারবার প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তা উপেক্ষা করা হয়েছে। কেন এটা করা হয়েছে, তার কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

বিদ্যুৎ খাতের বিপুল লোকসানের আর একটি বড় কারণ হচ্ছে, প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি। পিডিবিকে ভাগ করে কয়েকটি টুকরো করা হয়েছে। ফলে প্রত্যেকটি টুকরোতেই প্রশাসনিক ব্যয় ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ভাগের সুফল তেমন নেই। এছাড়া, ব্যাপক দুর্নীতিও লোকসানের বড় কারণ। অন্যদিকে দেশের বিদ্যুৎ খাতের ঋণের পরিমাণ ব্যাপক। গত ১১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত মুডি’সের পর্যবেক্ষণ মতে, পিডিবি’র ঋণের পরিমাণ বাংলাদেশের মোট জিডিপি’র ৩%। ভঙ্গুর আর্থিক অবস্থা ও সীমিত সক্ষমতার কারণে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানটির প্রয়োজনের সময় ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা হিসাবে দেখা দিতে পারে।’

বিদ্যুৎ খাতের ভবিষ্যৎ সমস্যা হচ্ছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া। অথচ প্যারিস জলবায়ু চুক্তি-২০১৫ অনুযায়ী বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ জ্বালানি ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করে দিয়ে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। ইতোমধ্যেই চীন, ভারতসহ অনেক দেশ কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বন্ধ করেছে। ২০৩০ সাল থেকে তারা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করে দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এই অবস্থায় আমরা বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছি, যার অনেকগুলো চরম বিতর্কিত। সর্বোপরি সে কয়লা আমদানিকৃত। অথচ দেশে আবিষ্কৃত পাঁচটি কয়লা খনিতে প্রায় ৭৯৬ কোটি টন কয়লা মজুদ আছে। তা উত্তোলন না করে আমদানির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে এবং বর্তমানেও বিপুল কয়লা আমদানি করা হচ্ছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোর নির্মাণের অগ্রগতিও আশানুরূপ নয়। তাই ঘটনা প্রবাহে প্রতীয়মান হচ্ছে, দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণ শেষ হওয়ার কিছুদিন পরই কয়লার ব্যবহার নিষিদ্ধ হতে পারে বিশ্বে। আর সেটা হলে বিশাল ব্যয় গচ্চা যাবে। তাই সময় থাকতেই এ ব্যাপারে সাবধান হওয়া আবশ্যক।

বিদ্যুৎ খাতের আরেক সমস্যা হচ্ছে, ২০১০ সালের পরিকল্পনা অনুযায়ী উৎপাদিত মোট বিদ্যুতের ১০% নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদনের যে টার্গেট ছিল, সে মতে বর্তমানে জাতীয় গ্রিডে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ যোগ হওয়ার কথা ২ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু গত ১০ বছরে এ খাত থেকে যোগ হয়েছে মাত্র ৩৩০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সৌর বিদ্যুৎ ২৮৬ মেগাওয়াট। অবশ্য, সোলার প্যানেল ব্যবহারে বাংলাদেশ শীর্ষ রয়েছে বিশ্বে। এখানে প্রায় ৬০ লাখ সোলার প্যানেল ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু এর বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয় না। ব্যবহারকারীরা নিজস্ব পারিবারিক চাহিদার কিয়দংশ পূরণ করছে। অর্থাৎ সোলার প্যানেল ব্যবহারে বিশ্বের শীর্ষস্থান অর্জন করলেও এর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ সেরূপ নয়। কারণ, দেশে ব্যবহ্নত েেসৗর প্যানেলের উৎপাদন ক্ষমতা খুবই কম। বিশ্বের চেয়ে ২১ ভাগ কম। অপরদিকে, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে দেশে। ২০১৬ সালে প্রণীত জাইকার পরিকল্পনা মতে, বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত থেকে মোট ৩,৬৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব (সৌর শক্তি ২,৬৮০, বায়ু বিদ্যুৎ ৬৩৭ ও বায়োগ্যাস থেকে ২৮৫ মেগাওয়াট), কিন্তু সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করা হচ্ছে না। তাই দেশের বিদ্যুতের মাস্টারপ্ল্যান ২০১৬ মতে, মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে যে ১০% নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সে মতে, ২০৪১ সালে নাগাদ ৮ হাজার মেগাওয়াটের বেশি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা। কিন্তু এ খাতের যে অগ্রগতি তা বহাল থাকলে এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে বলে মনে হয় না। অথচ সারা বিশ্বেই নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া, বিশ্বে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপকরণের মূল্য অনেক হ্রাস পেয়েছে। তাই বিনিয়োগ ব্যাপক বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউএন এনভায়রনমেন্ট’র ‘রিনিউঅ্যাবলস ২০১৯ গেøাবাল স্ট্যাটাস’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, ‘২০১৮ সালে সৌর বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ১৩৯.৭ বিলিয়ন ডলার (আগের বছরের চেয়ে ২২% কম), বায়ু বিদ্যুতে বিনিয়োগ ২% বেড়ে হয়েছে ১৩৪.১ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া বায়োমাস ও বর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরিতে বিনিয়োগ ৫৪% বেড়ে হয়েছে ৮.৭ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালে বৈশ্বিক বিনিয়োগের ৩২% চীন (বিনিয়োগের পরিমাণ ৯১.২ বিলিয়ন ডলার), এর পর ক্রমান্বয়ে ইউরোপ ২১%, যুক্তরাষ্ট্র ১৭%, ভারত ৫%, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা ৫%। চীন ছাড়া উন্নয়নশীল বিশ্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ ৬% বেড়ে হয়েছে ৬১.৬ বিলিয়ন ডলার, যা রেকর্ড সর্বোচ্চ।’ গত ১৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত বিশেষজ্ঞদের একটি আন্তর্জাতিক গ্রæপের ‘এক্সপোনেনসিয়াল রোডম্যাপ প্রতিবেদন’-এ বলা হয়েছে, ‘সৌর ও বায়ুশক্তি এখন অনেক অঞ্চলে জীবাশ্ম জ্বালানির তুলনায় সস্তা। কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিপরীতে সৌরশক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন অর্ধেক হয়ে যাবে। আমাদের দেশেও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। যেমন: সমুদ্রের বিশাল এলাকা, যাতে অনায়াসে সৌর, বায়ু ও ঢেউ থেকে বিপুল পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। এমনকি এখন সমুদ্রে ভাসমান পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে চীন ও রাশিয়া। রাশিয়া তো এর উৎপাদন শুরু করেছে। এছাড়া, দেশের প্রায় সর্বত্রই সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সুযোগ রয়েছে। এমনকি মৎস্য খামারেও পিলার বসিয়ে তার উপর সৌর প্যানেল স্থাপন আর নিচ দিয়ে মৎস্য চাষ করা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন স¤প্রতি। যা’হোক, আধুনিক যুগে দেশে নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা অপরিহার্য। তাই দেশের বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ীই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উৎপাদনের যে টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে, সে অনুযায়ী আধুনিক সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তোলা আবশ্যক। ব্যবহৃত সব সৌর প্যানেল যেন বিশ্ব মানের উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন হয়, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। দ্বিতীয়ত বিশ্বের বহু দেশে বিদ্যুৎ লাইন মাটির নিচ দিয়ে স্থাপন করা হয়েছে। কারণ, এটা নিরাপদ। তাই ঢাকার মিরপুরেও বিদ্যুতের লাইন মাটির নিচ দিয়ে স্থাপন করা হচ্ছে। এই ব্যবস্থা সারা দেশেই করা জরুরি। এ ব্যাপারে বুয়েট’র অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন এর অভিমত হচ্ছে, আমাদের দেশে যেভাবে ঝড় হয়, সেখানে ভূগর্ভস্থ লাইন নির্মাণ ছাড়া কোনভাবে মানসম্মত বিদ্যুৎ দেয়া সম্ভব নয়। এছাড়া আমাদের সাব স্টেশনগুলোও আন্তর্জাতিক মানের নয়। তাই এসব বিষয়ে এখন নজর দেয়া উচিত। অন্যদিকে, সর্বত্রই প্রয়োজনীয় প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করা দরকার। তাহলে বিল সংক্রান্ত ঝামেলা যেমন বন্ধ হবে, তেমনি বিদ্যুতের চুরি বন্ধ হয়ে সিস্টেম লস সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে। দেশে বিদ্যুৎ খাতে দক্ষ লোকের প্রচÐ অভাব রয়েছে। তাই প্রয়োজনীয় দক্ষ লোক গড়ে তোলার দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া বিদ্যুৎ খুবই মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় পণ্য। তাই এর অপচয় ও অপব্যবহার বন্ধ করা দরকার এবং এর জন্য সব ক্ষেত্রেই সাশ্রয়ী ইলেকট্রিক্যাল গুডস ব্যবহার করা প্রয়োজন। সেন্সর ব্যবহার করা হলে এসিতে বিদ্যুৎ ব্যবহার অনেক হ্রাস হবে। বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে বেশি বিদেশ নির্ভর হলে যে কোন সময় মহাসংকট দেখা দেওয়া অমূলক নয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিদ্যুৎ খাত
আরও পড়ুন