Inqilab Logo

বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নীলসাগরে সবুজের সমারোহ

নজির হোসেন নজু, সৈয়দপুর (নীলফামারী) থেকে | প্রকাশের সময় : ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

নীলও না, সাগরও না। জানা-অজানা বাহারি গাছগছালি ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমন্ডিল বিশাল এক দিঘীর নাম নীলসাগর। এর চারদিকে সবুজের সমারোহ, পর্যটন ক্ষেত্রে অপার সম্ভাবণাময় নীলফামারীর একমাত্র পিকনিট স্পট তথা বিনোদন কেন্দ্র নীলসাগর নানা সমস্যার আবর্তে। খাবার পানি সংকট, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা, সংস্কার ও দেখভালের অভাবসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে আজকাল নীলসাগরমুখি হতে চান না অনেকেই। শত সমস্যার পরও জেলার একমাত্র দর্শনীয় স্থান বা পিকনিক স্পট কিংবা বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে দিন দিন বাড়ছে নীলসাগরের জনপ্রিয়তা। নীলফামারী জেলার বিনোদন পিপাসু মানুষ হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটাতে নীলসাগরের ওপরই নির্ভরশীল। উজ্জ্বল সম্ভাবণাময় এ নীলসাগরকে আধুনিকায়ন করে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুললে পরিবর্তন হবে এখানকার আর্থসামাজি অবস্থা।

দেশের সম্ভাব্য পর্যটন কেন্দ্রের তালিকায় ১৯ নম্বরে রয়েছে নীলসাগরের নাম। এখানকার মানুষের দাবি, পুকুর খনন, আধুনিক সৌন্দর্য্য উপকরণ সরবরাহ এবং সরকারিভাবে নীলসাগরকে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে ঘোষণা করা।
নীলফামারী জেলা সদরের গোড়গ্রাম ইউনিয়নের ধোবাডাঙ্গা মৌজায় ৫৩.৯০ একর জমির ওপর নীলসাগরের অবস্থান। নীলসাগরে ৩২.৭০ একর পুকুর/পানির অংশ, রয়েছে ৮.৭০ উত্তর ও পূর্ব পাড়ে .৫৪ একর পশ্চিম পাড়ে এবং ১১.৯৬ একর দক্ষিণ পাড়ে। নীলফামারী জেলা শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান।
কথিত আছে, অষ্টদশ শতাব্দীতে রাজার অগনিত গরু-মহিষের পানির চাহিদা মেটাতে প্রায় ৫৪ একর জমিতে খনন করা হয় দীঘিটি। মেয়ে বিন্নাবতীর নামানুসারে নাম দেয়া হয় বিন্নাদীঘি। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের উদ্যোগে এবং স্থানীয় ব্যক্তিদের সমন্বয়ে বিন্নাদীঘির নাম পরিবর্তন করে ‘নীলসাগর’ নামকরণ করা হয়।
নীলসাগরের বিশাল দীঘির চারদিকে রয়েছে নানা প্রজাতির গাছ- গাছালির সমাহার। পানি আর সবুজ মিলে সে এক অপরুপ দৃশ্য ছায়া ঘেরা দীঘির চারপাশ বাঁধানো। শান বাঁধানো দীঘির চারপ্রান্তে রয়েছে সিঁড়ি। এসব সিঁড়ি গোসল করার ঘাট হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া দীঘির পাড়ে পাকা রাস্তার কিছুদুর পর পর দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে সুদৃশ্য বিশ্রামাগার, ছাতা প্রকৃতির বসার স্থান। এখানে শিশুদের জন্য সীমিত আকারে দোলনা, নাগরদোলার ব্যবস্থা রয়েছে। শীতকালে সাইবেরিয়াসহ শীতপ্রধান দেশগুলো থেকে আসা অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। এটিই মুলত নীলসাগরের প্রধান আকর্ষণ। মাঝপুকুরে বসে ভিনদেশী হাজার পাখির মেলা। দীঘিতে ফোটে শাপলা। শাপলার পাতায় পাখির অস্তিত্ব অসাধারণ ও প্রাকৃতিক দৃশ্যে যোগ করে ভিন্ন মাত্রা। প্রকৃতির অপূর্ব দৃশ্য দেখতে শীতকালে এখানে ছুটে আসেন নানা বয়সের মানুষ। কল্পকাহিনী ঘেরা নীলসাগরে প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিতে বসে ‘বারুনীলা’ মেলা। মেলায় থাকে মানুষের উপচেপড়া ভিড়। এখানে এসে পাওয়া যায় প্রকৃতির নিবিড় ছোঁয়া, শত ব্যস্ততার যান্ত্রিকতা এড়াতে ও কান্তি দূর করতে মানুষ ছুটে আসেন এখানে। শুধু নীলফামারীই নয়, আশেপাশের কয়েকটি জেলা থেকেও বিপুল সংখ্যক মানুষ এখানে বেড়াতে, আসেন। এখানে ছোট চিড়িযাখানাও রয়েছে। তবে তাতে কোন জীবজন্তু নেই।
জনশ্রুতি রয়েছে, ১৯৯৩ সালে সংস্কারের সময় দীঘির তলদেশে পাওয়া গিয়েছিল স্বর্ণ, রৌপ্য এবং কষ্টি পাথরের মূল্যবান মূর্তি। তবে মজার ব্যাপার হলো, মাটির তলদেশে মন্দিরের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও সেখানে বাস করতো বিশাল আকৃতির দুটি মাছ। ডুবুরিরা এই মন্দিরের ভেতরে যেতে পারেননি। কারণ, তাদের নাকি অলৌকিকভাবে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল। কথিত আছে, এক সময় নাকি নীলসাগরের পানি শুকানোর জন্য অনেকগুলো মেশিন বসানো হয়েছিল। কিন্তু পানির উচ্চতার কোনো পরিবতৃন হয়নি। লোকমুখে শোনা যায়, অতীতে গ্রামের লোকজন বিন্নাদীঘির পানিতে গাভীর প্রথম দুধ উৎসর্গ করতেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দুধ চক্রাকারে ঘুর্ণায়মান অবস্থায় দীঘির মাঝখানে চলে যেত। তাদের বিশ্বাস ছিল, এতে গাভীর দুধ বেশি হবে এবং অনিষ্টকারীর দৃষ্টি থেকে গাভীটি রক্ষা পাবে। সত্য-মিথ্যা যাই হোক, দিন দিন মানুষের আনাগোনা বৃদ্ধি এবং জনপ্রিয়তা বাড়ায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে নীলসাগরে।
এ ব্যাপারে নীলফামারী জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্র জানায়, ১৯৯৮-২০০১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে নেওয়া প্রকল্পে ৮০ লাখ ৫ হাজার টাকা ব্যয়ে নীলসাগরের ভূমি উন্নয়ন, সীমানা প্রাচীর, আরসিসি বেঞ্চ, গার্ডশেড, রেস্ট হাউস, টিনসেড ঘরসহ সেড, নলকূপ, অভ্যন্তরীণ সড়ক, পার্কিং এলাকা, আসবাবপত্র, ক্রোকারিজ, বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা, মৎস্য চাষ ও পরিচর্যাসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়েছে।
নানা সমস্যার পরও নীলসাগর জেলার একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র। দর্শনার্থী বাড়লে এবং সরকার একটুখানি আন্তরিক হলে এখানকার সমস্যাগুলো সমাধান হবে অনেকাংশে। তাই, এখানে সবুজ গাছের ছায়ায় অবসর সময় কাটানো, পিকনিক, পার্টি দেওয়াসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন ঐতিহাসিক নীলসাগর।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ