Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সউদীর শ্রমবাজারে বিপর্যয়

নতুন দিকনির্দেশনায় ৬৩০ এজেন্সি বিপাকে

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

সউদী আরবে জনশক্তি রফতানিতে চলছে ভাটার টান। ব্যাপক কূটনৈতিক উদ্যোগের অভাবে সউদীর শ্রমবাজার সম্প্রসারণে গতি বাড়ছে না। ঢাকাস্থ সউদী দূতাবাস দুই ক্যাটাগরিতে বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিকে বিভক্ত করে নতুনভাবে মৌখিক নির্দেশনা জারি করেছে। এতে ৬৩০টি মহিলা গৃহকর্মী প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সি বিপাকে পড়েছে। এসব এজেন্সি আর কোম্পানির পুরুষ কর্মীদের ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা দিতে পারবে না। আজ রোববার থেকে এই নতুন বিধি কার্যকর হবার কথা। এতে সউদী শ্রমবাজারে বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সউদীর শ্রমবাজার নিয়ে নতুন সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে গতকাল শনিবার বায়রা মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান ইনকিলাবকে বলেন, আজ রোববার সউদী দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে সৃষ্ট সঙ্কট নিরসন হবে বলে আশা করছি।

বিগত ৯ মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশি কর্মী ফেরত এসেছে। এর মধ্যে অর্ধেকই এসেছে সউদী আরব থেকে। একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার বাংলাদেশি সউদী আরব থেকে দেশে ফিরেছে। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে সাড়ে চার হাজার, ওমান থেকে প্রায় তিন হাজার, মালয়েশিয়া থেকে আড়াই হাজার, কাতার থেকে দেড় হাজার এবং মালদ্বীপ থেকে ফিরেছে এক হাজার বাংলাদেশি কর্মী।

ঢাকাস্থ সউদী দূতাবাস অনৈতিক কর্মকা-ের দরুন প্রায় দুইশ’ বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির সার্ভার ব্লক করে রেখেছে। এসব এজেন্সির শত শত ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। সউদীতে জনশক্তি রফতানি হ্রাস পাওয়ায় বায়রা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জনশক্তি রফতানির এই সর্ববৃহৎ শ্রমবাজার ধরে রাখতে না পারলে রেমিট্যান্স খাতে বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে। একাধিক জনশক্তি রফতানিকারক এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। অতিসম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইমরান আহমদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সউদী আরব সফরকালে সউদী কর্তৃপক্ষের সাথে একাধিক বৈঠকে বাংলাদেশি কর্মীদের সৃষ্ট সঙ্কট নিরসন ও আরো বেশি কর্মী নিয়োগের অনুরোধ জানায়।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, বর্তমানের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ অভিবাসী কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করছে। তারা ২০১৮ সালে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অধিক রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছে, যা জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম সহায়ক শক্তি। সরকার রেমিট্যান্স আয় ২০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সরকার শ্রম অভিবাসনকে আরো মর্যাদাপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে যেতে ৬০ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় শ্রম অভিবাসন ফোরাম গঠন করেছে। কিন্তু এ ফোরামের উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। সউদীর সর্ববৃহৎ শ্রমবাজারে প্রায় ২০ লাখ পুরুষ-নারী গৃহকর্মী কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। কিন্তু পুলিশি ধরপাকড় ও নিয়োগকর্তার হাতে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে পুরুষ-মহিলা গৃহকর্মীরা খালি হাতে দেশে ফিরছে দফায় দফায়। রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষ নির্যাতনের শিকার নারী গৃহকর্মীদের সঙ্কট নিরসনে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। নির্যাতনের শিকার মানসিক ভারসাম্যহীন দু-একজন নারী গৃহকর্মীও মাঝে মধ্যে দেশে ফিরছে। নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত সউদী নিয়োগকারীদের আইনের আওতায় আনার বিষয়টি এখনো উপেক্ষিত রয়েছে। ফলে সউদীতে প্রবাসী বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনাও দিন দিন বাড়ছে। অনেক সময়ে নিয়োগকর্তাদের নির্যাতন সইতে না পেরে এবং ৪-৫ মাস বেতন না পাওয়ায় বহু নারী কর্মী পালিয়ে দূতাবাসের সেইফ হোমে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। সউদী নিয়োগকর্তারা সেইফ হোমে পালিয়ে আসার নারী কর্মীদের বিরুদ্ধে অহেতুক মোবাইল ও রিয়াল চুরির মামলা দিচ্ছে। এসব মামলার অধিকাংশই মিথ্যা বলে দাবি করেছেন দেশে ফেরত আসা নারী কর্মীরা। সউদী আরবের রিয়াদসহ বিভিন্ন অঞ্চলের সেইফ হোম ও সফর জেলে এখনো বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি পুরুষ-মহিলা গৃহকর্মী দেশে ফেরার জন্য প্রহর গুনছে। এদের মধ্যে অনেকেরই বৈধ আকামাও রয়েছে। সফর জেলে আটককৃত কর্মীরা রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষের যথাযথ সহযোগিতা পাচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠছে।

বিএমইটির একটি সূত্র জানায়, বিনা অভিবাসন ব্যয়ে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের বিড়ম্বনার শিকার হওয়ায় মহিলা গৃহকর্মীদের বিদেশে যাওয়ার সংখ্যাও দিন দিন কমছে। গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সউদী আরবে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৭১ জন পুরুষ-মহিলা কর্মী চাকরি লাভ করেছে। এর মধ্যে ৪৪ হাজার ৭১৩ জন মহিলা গৃহকর্মী সউদী গেছে। একই সময়ে জর্ডানে গেছে ১১ হাজার ৫৭ জন আর ওমানের গেছে ৭ হাজার ৯২৭ জন মহিলা গৃহকর্মী। গত আট মাসে সউদীসহ বিভিন্ন দেশে ৭১ হাজার ৯৪৫ জন মহিলা গৃহকর্মী বিদেশে কর্মসংস্থান লাভ করেছে। ২০১৮ সনে সারা বিশ্বে ৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৮১জন পুরুষ-মহিলা গৃহকর্মী চাকরি লাভ করেছে। এর মধ্যে ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৫ জন মহিলা গৃহকর্মী বিদেশে চাকরি লাভ করেছে। এ সময়ে শুধু সউদী আরবেই ৭৩ হাজার ৭১৩ জন মহিলা গৃহকর্মী চাকরি লাভ করেছে।

পুলিশ ক্লিয়ারেন্স হাতে পেতে সউদী গমনেচ্ছু কর্মীরা সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে। এতে দেশটিতে কর্মী গমনের সংখ্যাও দিন দিন কমছে। ঢাকাস্থ সউদী দূতাবাস কর্তৃপক্ষ বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ২৪ ঘণ্টায় হাতে পেতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস স্থাপনের ওপর তাগিদ দিয়েছে। সউদী কর্তৃপক্ষ দেশটিতে মহিলা গৃহকর্মী নিয়োগে নতুন করে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স বাধ্যতামূলক করেছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বিদেশ গমনেচ্ছুদের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স হাতে পেতে দেড় থেকে দুই মাস সময় লেগে যাচ্ছে। বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দীর্ঘ দিন লাগায় সউদী নিয়োগকারীরা বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। এতে সউদীর জনশক্তি রফতানির বাজার হাতছাড়া হবার উপক্রম হচ্ছে।

সউদীর শ্রমবাজারকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস স্থাপনের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টায় বিদেশ গমনেচ্ছুদের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ইস্যুর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার জন্য প্রবাসী মন্ত্রী ইমরান আহমদ গত ২৫ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছেন। অদ্যাবধি এ বিষয়ে কোনো কার্যকরী উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
বায়রার সভাপতি বেনজীর আহমেদ বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ইস্যুতে দেড়-দুই মাস বিলম্ব হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, সউদী দূতাবাসে ভিসার জন্য কর্মীদের পাসপোর্ট জমা দিলে ২৪ ঘণ্টায় ভিসা দিচ্ছে। কিন্তু কর্মীর পুলিশ ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়ায় সউদীর শ্রমবাজার হাতছাড়া হচ্ছে। সউদীসহ মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রফতানি হ্রাস পাচ্ছে। বায়রা সভাপতি বলেন, সিন্ডিকেট চক্রের কারণে বিমানের টিকিটের দাম দ্বিগুণ বাড়ছে। এতে বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের নাভিশ্বাস উঠছে। বিমান ভাড়া বৃদ্ধি রোধকল্পে ওপেন স্কাই নীতি দ্রুত ঘোষণা করতে হবে।

এদিকে, গত সপ্তাহে ঢাকাস্থ সউদী দূতাবাস কর্তৃপক্ষ বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে দুই ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করে (এ-ক্যাটাগরি ও বি-ক্যাটাগরি) আজ রোববার থেকে একজন মহিলা গৃহকর্মীর পাসপোর্টের সাথে একজন পুরুষ কর্মীর পাসপোর্ট জমা দেয়ার মৌখিক নির্দেশনা জারি করেছে। এতে ৬৩০টি মহিলা গৃহকর্মী পাঠানোর রিক্রুটিং এজেন্সি (এ-ক্যাটাগরি) বিপাকে পড়েছে। নতুন এ বিধিনিষেধ-এর জন্য এসব মহিলা গৃহকর্মীর রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো কোনো কোম্পানির পুরুষ কর্মীর ভিসার জন্য দূতাবাসে পাসপোর্ট জমা দিতে পারবে না। বি-ক্যাটাগরির রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোই শুধু কোম্পানির পুরুষ কর্মীর ভিসার জন্য দূতাবাসে আবেদন করতে পারবে। দূতাবাসের এ ধরনের বিধিনিষেধ কার্যকর হলে সউদীর শ্রমবাজারে বিপর্যয় নেমে আসবে। ফিমেল ওয়ার্কার রিক্রুটিং এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ফোরাব) সভাপতি টিপু সুলতান এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ফোরাব সভাপতি বলেন, গত দুই বছরে মহিলা গৃহকর্মী পাঠানোর সুবাদে এযাবৎ সউদীতে প্রায় ১০ লাখ কর্মীর কর্মসংস্থান লাভ করেছে। তিনি সউদী দূতাবাসের মৌখিক নির্দেশনা অবিলম্বে প্রত্যাহার করে পূর্বের চলমান প্রক্রিয়া চালু রাখার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বায়রা কর্তৃপক্ষের আশুহস্তক্ষেপ কামনা করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বায়রার সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব-১ ইনকিলাবকে বলেন, বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে এ-ক্যাটাগরি ও বি-ক্যাটাগরিতে বিভক্তীকরণের সউদী দূতাবাসের কোনো এখতিয়ার নেই। এসব রিক্রুটিং এজেন্সি দীর্ঘ দিন ধরে সউদী ও বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ বিধিমালা অনুসরণ করেই জনশক্তি রফতানি করে আসছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সউদী


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ