Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রংপুর-৩ উপনির্বাচন- অস্তীত্ব রক্ষায় মরিয়া জাপা

রংপুর সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২ অক্টোবর, ২০১৯, ৭:৫৩ পিএম | আপডেট : ৭:৫৫ পিএম, ২ অক্টোবর, ২০১৯

প্রায় তিন দশক পর এই প্রথম এরশাদ বিহীন জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে জাতীয় পার্টি। তিন দশক ধরে দখলে থাকা জাতীয় পার্টির দূর্গ হিসেবে খ্যাত রংপুর-৩ আসনের উপ-নির্বাচনে জয়ী হয়ে অস্তিত্ব রক্ষা ছাড়াও দূর্গ টিকিয়ে রাখতে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে জাতীয় পার্টি। আর তাই আগামী ৫ অক্টোবর রংপুর-৩ আসনের উপ নির্বাচনকে ঘিরে দলটির মধ্যে শুরু হয়েছে ব্যাপক তোড়জোড়। চলছে শেষ মুহুর্তে এসেও চলছে কেন্দ্রীয় নেতাদের দৌড়-ঝাঁপ এবং জমজমাট প্রচার-প্রচারণা। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে প্রার্থীসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা কর্মীদের নিয়ে ছুটছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। দিচ্ছেন নানা উন্নয়নের প্রতিশ্র“তি। ৩০ বছর দখলে থাকা এ আসনটিতে শেষ পর্যন্ত জাপার অবস্থান কী হয়-তা দেখতে মাত্র দু’টি দিনের অপেক্ষা।

জাতীয় পার্টির (জাপা) দুর্গ হিসেবে পরিচিত রংপুর। ৯১’ এর নির্বাচনের পর প্রত্যেকটি জাতীয় নির্বাচনে সবক’টি আসন জাতীয় পার্টির দখলে থাকলেও ২০০১ সালে জোটবদ্ধ নির্বাচনের পর থেকে আসন আসন হারাতে থাকে দলটি। বিগত সময়ের নির্বাচনী ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে রংপুর বিভাগের ৩৩টি আসনের বেশির ভাগই পেয়েছিল জাপা। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে এ অঞ্চলে জাপার আসন উলে­খযোগ্য হারে কমে যায়।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে রংপুর বিভাগের ৩৩ আসনের মধ্যে জাপা ১৭টি, আওয়ামী লীগ ৯টি, বিএনপি ১টি, সিপিবি ৩টি, জামায়াত ১টি, বাকশাল ও ন্যাপ ১টি করে আসন পায়। সে বছর জাপা প্রার্থীদের জয়ে ভোটের ব্যবধানও ছিল অনেক। এরশাদ ‘সেন্টিমেন্ট’ এ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও বেশ ভালো করে জাতীয় পার্টি। সে বছর দলটি পায় ২১টি আসন। আর আওয়ামী লীগ ৮, বিএনপি ৩ ও জামায়াত ১টি আসন পায়। পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৯৬ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আসন কম পেলেও এ অঞ্চলে সুবিধা করেছিল জাপা ও বিএনপি

কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচন থেকে এ অঞ্চলে জাপার ছন্দপতন ঘটতে থাকে। ওই নির্বাচনে ২১টি থেকে কমে ১৪টি আসন পায় জাপা। আওয়ামী লীগ ৬টি, বিএনপি ৯টি এবং জামায়াত পায় ৪টি আসন। এসময় সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে জাতীয় পার্টি।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-জাপার সমন্বয়ে গঠিত হয় মহাজোট। এতে বিএনপি-জামায়াত কোণঠাসা হলেও সুবিধা করতে ব্যার্থ হয় এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে জোটবদ্ধভাবে অংশ নিয়েও এ অঞ্চলে জাতীয় পার্টি পায় ১৩টি আসন। আওয়ামী লীগ পায় ২০টি আসন। এ সময়টাতে অনেকটা অস্তীত্ব সংকটে পড়ে জাতীয় পার্টি। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করে সংসদীয় আসনগুলোতে নিজেদের আধিপত্য জানান দিতে থাকে আওয়ামী লীগ।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির আসন আরও কমে গিয়ে তিন দশকের হিসেবে সবচেয়ে কম আসন পায় দলটি। নির্বাচনে মাত্র ৭টি আসন পায় জাপা। আর আওয়ামী লীগ ২৩টি, জাসদ ১টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ১টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী পায় ১টি আসন।
২০১৬ সালে দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন জাপা মনোনীত প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসলেও দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে রংপুরের প্রায় সবখানেই জাপার ভরাডুবি হয়।

সর্বশেষ গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো ৭টি আসন পায় দলটি। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি মহাজোট ছাড়া এককভাবে কোনো আসনে জয়লাভ করতে পারেনি। ওই নির্বাচনে বিএনপি ১টি আসন পেলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল দলটি।
ওদিকে, সাংগঠনিক দুর্বলতার কারনে গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অধিকাংশ জায়গায় প্রার্থীই দিতে ব্যার্থ হয় জাতীয় পার্টি। রংপুরের ৮ উপজেলার মধ্যে শুধু পীরগাছায় জাপা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় সক্ষম হলে বাকি ৭ উপজেলাতেই দলটির শোচনীয় পরাজয় হয়। এর মধ্যে গঙ্গাচড়া, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, মিঠাপকুর ও কাউনিয়া উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে নিজেদের কোনো প্রার্থীই দিতে পারেনি দলটি। এছাড়া বিভাগের অন্য উপজেলাগুলোর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটিতে লাঙল প্রতীকের প্রার্থী থাকলেও কেবল দিনাজপুরের বোচাগঞ্জে তাদের প্রার্থী জয়ী হয়।

জাপার সাবেক চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের পৈতৃক নিবাস রংপুরে। ক্ষমতা হারানোর পরও দীর্ঘ ৩ দশক ধরে রংপুর দলটির দুর্গ হিসেবেই ছিল। বিশেষ করে রংপুর-৩ (সদর) আসনটি এরশাদের আসন হিসেবে বিগত প্রতিটি সংসদ নির্বাচনে বিশাল ভোটের ব্যবধানে দখলে থাকে এরশাদের। গত ১৪ জুলাই দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর শূন্য ঘোষণা করা হয় আসনটি। আগামী ৫ অক্টোবর ইভিএম পদ্ধতিতে এ আসনের উপনির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
জাপার প্রার্থী এরশাদ পুত্র রাহগির আলমাহি সাদ এরশাদসহ ৬ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এবারের উপ নির্বাচনে। এরমধ্যে আলোচনায় রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী এরশাদের ছোট ভাই সাবেক সংসদ সদস্য মোজাম্মেল হোসেন লালুর ছেলে জাপার সাবেক এমপি হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ এবং বিএনপির রিটা রহমান।

গত দু’দিন নির্বাচনী এলাকা ঘুরে সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারে ভোটারদের দাবী স্থানীয় প্রার্থী। সে হিসেবে এরশাদ পরিবারের সন্তান হিসেবে আসিফ শাহরিয়ারের দিকেই মোটামুটি সবার নজর। তাছাড়া, দলের মধ্যে বিরোধ এবং দফায় দফায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের বিষয়টি বিশেষ করে জাপা মহানগর কমিটির সম্পাদক এস,এম ইয়াসিরকে মনোনয়ন দিয়ে পরবর্তীতে তা প্রত্যাহার করার বিষয়টিও সাধারণ ভোটারদের মাঝে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া, একই পরিবার থেকে আসিফ শাহরিয়ারের প্রার্থী হওয়া ও স্থানীয় জাপার একটি অংশ বিপক্ষে থাকাসহ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভোট বর্জনের ঘোষণাও জাপা প্রার্থী সাদ এরশাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী রিটা রহমান। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি ৫৩ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। এমনিতেই এবার এরশাদ নেই, তার ওপর জাপার বিভেদ। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটতে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছেন তিনি।
জাপার একাধিক কর্মী-সমর্থক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, দলের পক্ষ থেকে স্থানীয় ও যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন না দিয়ে বিভিন্ন নির্বাচনে অযোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়ায় নিজ ঘাঁটিতে শোচনীয় পরাজয় হচ্ছে জাপার। এ অবস্থায় জাপার দূর্গ হিসেবে পরিচিত রংপুরে অস্তীত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ছে। যার ফলশ্র“তিতে এবারের উপ-নির্বাচনে জয়ের বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন এবং চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে।

 


 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রংপুর


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ