Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ভারতীয় জি-ফাইভ-এর মাধ্যমে হিন্দি গানের আগ্রাসনে ক্ষুব্ধ সঙ্গীত প্রযোজকরা

বিনোদন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৪ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

দেশে ভারতীয় স্ট্রিমিং অ্যাপ জি-ফাইভ-এর মাধ্যমে হিন্দি গানের প্রচার ও প্রসারের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্ধতা প্রকাশ করেছে সঙ্গীতাঙ্গণের প্রযোজকদের সংগঠন এমআইবি। চলতি বছরের ৩ জুলাই রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে একটি মোবাইল ফোন প্রতিষ্ঠান তাদের গ্রাহকদের জন্য যুক্ত করেছে ভারতীয় জনপ্রিয় স্ট্রিমিং অ্যাপ জি-ফাইভ। যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকরা ছাড়াও ওয়াইফাই দিয়ে নেট চালানো শ্রোতারা এই অ্যাপটির মাধ্যমে অবাধে উপভোগ করতে পারছেন হিন্দি গানসহ বিদেশের বিভিন্ন নাটক, সিনেমা ও ওয়েব সিরিজ। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি বিস্ময় প্রকাশ করছেন সঙ্গীত সংশ্লিষ্টরা। তারা প্রশ্ন তুলে বলেছেন, দেশের উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ অমান্য করে কীভাবে একটি মুঠোফোন প্রতিষ্ঠান এই কাজটি করতে পারে? তবে কি তারা বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি আর সঙ্গীতকে ধ্বংস করে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আবারও হিন্দি গানের বাজার তৈরি করতে চান? এমন উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে এমআইবির (মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনঅব বাংলাদেশ) পক্ষ থেকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর মোবাইল ফোন প্রতিষ্ঠানটি বরাবর একটি উকিল নোটিশ পাঠানো হয়। জানতে চাওয়া হয়, কেন উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ অমান্য করে প্রতিষ্ঠানটি ফের উপমহাদেশের গান-নাটক বিপণন করছেন তারা। এমআইবি’র পক্ষ থেকে বলা হয়, বছর পাঁচেক আগেও দেশের মোবাইল ফোনগুলোর মাধ্যমে ভাইরাসের মতো সংক্রমিত হয়েছিল হিন্দি গান। মুঠোফোনের রিংটোন, ওয়েলকাম টিউনের সূত্র ধরে তখন দেশের বেশিরভাগ উৎসবে, অনুষ্ঠানে, দোকানে, বাসে, ঘরে বাজতো হিন্দি গান। বিপরীতে বাংলা গান ছিল নিজ দেশে পরবাসীর মতো। হিন্দি গানের প্রভাব এতটাই ছিল যে, ২০০৫ সাল থেকে ২০১০ সাল নাগাদ দেশের বেশিরভাগ সঙ্গীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এই সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে, দেশের সংস্কৃতি ও সঙ্গীতকে বাঁচানোর জন্য এবং নিজেদের প্রতিষ্ঠান বাঁচানোর তাগিদে অডিও প্রযোজকদের সংগঠন এমআইবি’র নেতারা দ্বারস্থ হন উচ্চ আদালতের। যার ফলাফল হিসেবে ২০১৫ সালের ৯ জুলাই উচ্চ আদালত থেকে একটি স্থগিতাদেশ দেন। ঐদিন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দ-এর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের রিংটোন ও ওয়েলকাম টিউনে হিন্দি গানের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এমন ঘোষণার পর দেশের সব মোবাইল ফোন থেকে হিন্দি গানের বিপণন রাতারাতি বন্ধ হয়ে যায়। বিপরীতে দেশের অডিও শিল্প, শিল্পী ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো ফেরজেগে ওঠে নতুন আশায়। পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি নতুন অনেক প্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠে গান, নাটক ও সিনেমা প্রযোজনার জন্য। বিশেষ করে গত চার বছরে বাংলাদেশে বাংলা গান ও নাটকের বিস্তার হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলা গান তৈরি ও প্রকাশের জন্য স্বাধীনতার পর এত বেশি ইনভেস্টমেন্ট আগেকখনো হয়নি এ দেশে। যেটা হয়েছে গত চার বছরে। যার পেছনে অন্যতম কারণ, দেশীয় শ্রোতাদেরকে হিন্দি গান থেকে দূরে সরিয়ে বাংলা গানের কাছে নিয়ে যাওয়া। তবে চলতি বছরের ৩ জুলাই সেই সাফল্যে বড় আঘাত হয়ে আসে জি-ফাইভ। দেশাত্মবোধ, বাংলা সংস্কৃতির বিকাশ আর সংগীত ইন্ডাস্ট্রির চলমান উন্নতিকে পেছনে ঠেলে দিয়ে দেশের মোবাইল অপারেটর সিস্টেমে আবারও ঢুকে পড়েছে হিন্দিসহ বিভিন্ন বিদেশি গান। যার মধ্যে বরাবরই দেশের সংগীতের মূল অন্তরায় হিসেবে ধরা দিয়েছে হিন্দি গান। এমআইবি’র সভাপতি ও দেশের অন্যতম প্রযোজনাপ্রতিষ্ঠান লেজার ভিশন-এর চেয়ারম্যান একে এম আরিফুর রহমান বলেন, যে সময়টাতে এসে বাংলা গান ও গান সংশ্লিষ্ট ইন্ডাস্ট্রিটা পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পেল, ঠিক সেই সময়ে এসে একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির ওপর ভর করে বাংলাদেশে আবারও হিন্দি কনটেন্ট প্রবেশ করলো। এখন সবার হাতে মোবাইল। সেই মোবাইলে যদি হিন্দি গান ছড়িয়ে দেয় হয়, তাহলে মানুষ বাংলা গান শুনবে কেন? আবারও আমাদের ঘরে ঘরে বিয়ে, উৎসবে বাজবে হিন্দি আইটেম গান। অথচ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, গত পাঁচ বছরের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় নাচের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বিয়ের উৎসবেও এখন বাংলাদেশের গান বাজে। যেটা বছর পাঁচেক আগে ছিল স্বপ্নের মতো। তারচেয়ে বড় বিস্ময় মোবাইল কোম্পানিটি এই কাজটির মাধ্যমে আমাদের উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশকে উপেক্ষা করেছে। আমরা এর বিচার চাই। দেশের অন্যতম প্রযোজক (ধ্রæব মিউজিক স্টেশন) ও জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ধ্রæব গুহ বলেন, সবার আগে দেশকে রক্ষা করতে হবে। দেশের গান ও সংস্কৃতি রক্ষার মাধ্যমেই সেটি সম্ভব। দেশের সংস্কৃতি বিকিয়ে, হিন্দি গান ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আমাদের রেভিনিউ বাইরে চালান হয়ে যাবে- এটা তো হয় না। বাংলা গান মানে বাংলা ভাষা- এটুকু বোধ আমাদের থাকতে হবে। হিন্দি গান সবসময়ই আমাদের দেশের জন্য বড় হুমকি। সেজন্যই সেটির কথা বলছি। তাই আগেও আমরা এর প্রতিবাদ করে মাহামান্য আদালতের কাছ থেকে একটা স্থগিতাদেশ পেয়েছি। সেই স্থগিতাদেশের সূত্র ধরেই আমরা আবারও বাংলা গানের বিকাশে রাত-দিন কাজ করে চলেছি। সেটি যদি আবারও ব্যাহত হয়, তবে সেটাকে প্রতিরোধ করা উচিত। ব্যাক্তি স্বার্থে নয়, দেশের স্বার্থেই প্রতিটি মানুষের এটার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত। দেশের অন্যতম প্রাচীন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান অনুপম রেকর্ডিং। বিশেষ করে দেশীয় চলচ্চিত্র ও গানের সবচেয়ে বড় আর্কাইভ রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটির সার্ভারে। অনুপম রেকর্ডিংয়ের প্রধান আনোয়ার হোসেন বলেন, চার দশক ধরে চলচ্চিত্রের গানগুলো আমি কিনেছি। মাঝে লম্বা সময় প্রচন্ড হতাশার মধ্যে কেটেছে। কারণ, ইনভেস্টমেন্ট করে বসে আছি কিন্তু গান তো শোনানোর সুযোগ পাইনা। চারদিকে শুধু হিন্দি সিনেমার গানের দৌরাত্ম। অবশেষে আবারও নতুন করে শুরু করলাম। বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে গানগুলো বেশ চলছিল। এরমধ্যেই আবার হিন্দি গান প্রবেশ করলো। আবারও আমরা যদি হিন্দির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হই, তবে তো নিঃশেষ হয়ে যাবো। নতুন গান আর প্রডিউস করতে পারবো না। দেশের আরেক জনপ্রিয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিডি চয়েসের কর্ণধার জহিরুল ইসলাম সোহেল বলেন, শুধু গান নয়, আমার প্রতিষ্ঠান শুরু থেকেই বাংলা সঙ্গীত, নাটক ও সিনেমাকে লালন করে আসছি। আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে বাংলাদেশের পরিচ্ছন্ন বিনোদনমূলক কাজগুলোকে খুব সহজে পৌঁছে দেওয়ার। সেই চেষ্টায় তুমুল সাড়াও পেয়েছি। এখন হুট করে আমার সাজানো ঘরে ভারতীয় কোন প্রতিষ্ঠান কিংবা কনটেন্ট এসে যদি খেয়ে ফেলে- তাহলে কী হবে? আমরা তো পথে বসে যাবো। এই বাংলা নাটক-সিনেমা-গানের বিকাশের জন্য কোটি কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছি আমরা প্রযোজকরা। মাহামান্য আদালতের স্থগিতাদেশও আছে আমাদের বাংলা সংস্কৃতির পক্ষে। অথচ এর সবকিছু তুচ্ছ করে একটি প্রতিষ্ঠান হিন্দি গানের বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছে। আমারা শুধু প্রযোজকরা নই, আমাদের সঙ্গে গীতিকার, সুরকার, নির্মাতা, নাট্যকার, শিল্পী সবাই জড়িত। এটা অনেক বড় একটা চেইন, অনেক বড় ইনভেস্টমেন্ট। ফলে বিকাশমান বাংলা সংস্কৃতির পথে আবারও কোনও বাধা আসলে আমরা ছাড় দিতে রাজি নই। এখানে সবার সাপোর্ট দরকার। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ঈগল মিউজিকের প্রধান কচি আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের গান ও সংস্কৃতি বাঁচানোর জন্য হিন্দির বিরুদ্ধে একটা স্থগিতাদেশ আছে। সেটি দেশে বাস্তবায়নও হয়েছে। মূলত তার উপরে ভিত্তি করেই আমরা আবারও নতুন ইনভেস্টমেন্টে এসেছি। রাত-দিন চেষ্টা করছি নতুন নতুন গান ও ভিডিও প্রকাশের মাধ্যমে শ্রোতা-দর্শকদের মন রক্ষা করার। অথচ এসব বিষয়ে না ভেবে, আদালতের স্টে অর্ডার উপেক্ষা করে মোবাইল প্রতিষ্ঠান ও জি-ফাইভ সাবকন্টিনেন্ট কনটেন্ট বিপণন শুরু করে দিয়েছে। এটা আদালত অবমাননার শামিল। সংগীত প্রযোজকদের সংগঠন এমআইবি’র মহাসচিব ও সিএমভি’র কর্ণধার এসকে সাহেদ আলী এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, বাংলা নাটক, সিনেমা ও গানের ইন্ডাস্ট্রি বাঁচানোর জন্য পুরনো যুদ্ধটা আমাদের আবারও শুরু করতে হচ্ছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে ¯পষ্ট স্থগিতাদেশ পাওয়ার পর, সেটি কার্যকর হওয়ার এত বছর পর আবারও যদি কেউ এ কাজ করে তাহলে আমরা কোথায় যাব। আমরা আবারও আইনের আশ্রয় নেবো। বাংলা গান ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে চলমান এই ষড়যন্ত্রের স্থায়ী সমাধান আমরা চাই। এই বিষয়ে আমরা আর কাউকে একচুলও ছাড় দিতে রাজি নই। আমরা উকিল নোটিশ পাঠিয়েছি মোবাইল কোম্পানিটি বরাবর। নোটিশের কপি দিয়েছি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতেও। এই নোটিশের সদুত্তর না পেলে আমরা শিগগিরই সংবাদ সম্মেলন করবো। একইসঙ্গে আইনের আশ্রয় নেব। দেশের আইনের প্রতি আমাদের সর্বোচ্চ আস্থা আছে। আমরা আশা করছি, আবারও এই অন্যায়ের ন্যায় বিচার পাবো।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ