Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আফগানিস্তান পরাশক্তিগুলোর প্রতিদ্ব›িদ্বতার ক্ষেত্র

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে তালেবানদের সাথে আলোচনা বাতিল করায় যুক্তরাষ্ট্র-আফগান যুদ্ধ একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে গেছে। আর সা¤প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, ট্রাম্প অপ্রয়োজনে অতিরিক্ত ‘কঠোরতা’ দেখানোর কারণে এবং নিজেকে ‘মাস্টার মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে তুলে ধরার প্রবণতার কারণে এখন তিনি নিজেই সমস্যায় পড়ে গেছেন।

ট্রাম্প এবং তার টিম হয়তো ভেবেছিলেন যে তালেবানরা দুর্বল এবং মার্কিন চাপের কাছে তারা নতি স্বীকার করবে, কিন্তু সেটা হয়নি। বরং উল্টোাঁ হয়েছে। সামরিক ও ক‚টনীতিক উভয় ফ্রন্টে তালেবানদের পাল্টা হামলার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখন চোরাবালি থেকে নিজেদের উদ্ধারে ব্যস্ত, নিজেদের কারণেই যেখানে গিয়ে পড়েছে তারা। একদিকে, তালেবানরা তাদের যুদ্ধ তীব্র করেছে এবং অন্যদিকে, তারা ইতিবাচকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী চীন ও রাশিয়ার সাথে যোগাযোগ আরও গভীর করার চেষ্টা করছে। যদিও এই যোগাযোগ নতুন নয়, তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাদের গুরুত্ব আলাদা, যেমনভাবে আফগানিস্তানে মার্কিন-প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সিস্টেমটাও এখন অনেকটা আলাদা হয়ে উঠেছে। সা¤প্রতিক নির্বাচনে পরিস্কারভাবেই এটা দেখা গেছে যে, সেই রাজনৈতিক সিস্টেমটা এখন অনেক নড়বড়ে হয়ে গেছে।

এই নির্বাচন প্রমাণ করেছে যে, আফগানিস্তানে শান্তি ছাড়া সেখানে কোন স্বাস্থ্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

তবে, এটা অবশ্য হতে পারবে না, যদি না তালেবানরা মূলধারায় ফিরে আসে এবং তারা চিরদিনের জন্য অস্ত্র পরিত্যাগ করে।
তালেবানদের সাথে সমঝোতার যে কোন বিকল্প নেই, যুক্তরাষ্ট্র সেটা বোঝে। কিন্তু ট্রাম্পের হঠকারিতা তাকে সমস্যার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বাস্তবতা হলো তালেবানদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা বাতিল করা এবং আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান ও বিমান হামলা জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও অনেকটা চুপে চুপে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছে তারা।

মূলধারার পশ্চিমা মিডিয়ায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র এরইমধ্যে প্রায় দুই হাজার সেনাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে এবং এর মাধ্যমে ১৪ হাজার সেনার সংখ্যা কমে এখন ১২ হাজারে দাঁড়িয়েছে। এই সেনা প্রত্যাহার হয়তো ট্রাম্পের নির্বাচনকালীন প্রতিশ্রুতি প‚রণের অংশ, যেখানে তিনি বলেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ‘অন্তহীন যুদ্ধের’ তিনি ইতি টানবেন – বা এর কাছাকাছি নিয়ে যাবেন – কিন্তু তালেবানরা এখন এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়তো ঠিক সিরিয়া স্টাইলে সেনা প্রত্যাহারের কথা ভাবছেন।

তালেবানদের একজন মধ্যস্থতাকারীর একটি সাক্ষাতকার তাদের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে, যেটা পড়লে বোঝা যায় যে, এ অঞ্চলে মার্কিন ভ‚-রাজনীতির গতি-প্রকৃতির উপর কত নিবিষ্টভাবে নজর রাখছে তারা। ওই সাক্ষাতকারে খাইরুল্লাহ খায়েরখোয়া বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র সব জায়গাতেই তাদের স্বার্থ দেখে, যখন কোন এলাকায় সেটা তারা পায় না, তখন সেটা ছেড়ে যায়”।

খায়েরখোয়া আরও বলেছেন, “এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো সিরিয়ায় কুর্দিদের ছেড়ে যাওয়া। এটা স্পষ্ট যে কাবুল প্রশাসনও ঠিক একই পরিণতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে”।

তালেবানরা সে কারণে পাকিস্তান, চীন ও রাশিয়ার মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোর কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করছে। সিরিয়া স্টাইলে সেনা প্রত্যাহারের সম্ভাব্য পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য তারা প্রস্তুতি শুরু করেছে, যাতে সেনা প্রত্যাহার পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় একটা কৌশল বের করা যায় - যেখানে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের উপর অন্যান্য রাষ্ট্রের সমর্থন থাকবে এবং অন্যান্য পক্ষগুলোর সাথে একটা শান্তি চুক্তি স্থাপিত হবে।

তবে, সিরিয়ায় যেমনটা হয়েছে, আফগান শান্তি প্রক্রিয়ায় তেমনভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র। সে কারণে সেনা সংখ্যা কমানোর মধ্য দিয়ে তালেবানদের শুধু তারা বার্তাই দিচ্ছে না, বরং মস্কোতে অনুষ্ঠিত চারপক্ষীয় আলোচনাতেও অংশ নিচ্ছে তারা। পাকিস্তান, রাশিয়া, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মূলত আলোচনা পুনরায় চালুর জন্যেই এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

কিন্তু আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলো শুধু যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করবে না এখানে। তালেবানরা স¤প্রতি পাকিস্তানে এসেছিল এবং এখন চীন বেইজিংয়ে সম্মেলন আয়োজন করতে যাচ্ছে। এই সম্মেলনের আগে চীনের কর্মকর্তাদের সাথে দোহাতে তালেবানদের একটা আলোচনা হয়েছে, যেটার খবর খুব বেশি ছড়ায়নি। তালেবানদের রাজনৈতিক অফিস দোহাতেই রয়েছে।

চীনারা তাই আফগানিস্তানে একটা বিকল্প শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে গভীরভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে। এর কারণ শুধু এটা নয় যে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যক্রম সম্পর্কে আগাম ধারণা করাাঁ অসম্ভব, বরং আফগানিস্তান ক্রমশই দুটো পরাশক্তির মধ্যে প্রতিযোগিতার একটা অঞ্চল হয়ে উঠছে, যে দুটি দেশ এরই মধ্যে ‘বাণিজ্য যুদ্ধে’ জড়িয়ে পড়েছে।
এটা গত মাসেই স্পষ্ট হয়ে গেছে যখন মার্কিন নীতি নির্ধারকরা চীনের বিআরআইয়ের এবং আফগানিস্তানে তাদের প্রবেশের চেষ্টার সমালোচনা করেছেন।

দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন ভারপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অ্যালিস ওয়েলস এক শুনানিতে কংগ্রেসম্যানদের উদ্দেশে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র আফগান সরকারসহ তাদের অংশীদার দেশগুলোকে সতর্ক করা অব্যাহত রেখেছে যাতে তারা “আগ্রাসী ঋণ বা যে ঋণটা শুধু চীন রাষ্ট্রের উপকারে আসবে, সেটার খপ্পরে না পড়ে”।

চীন অন্যদিকে যুদ্ধ বন্ধ করতে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হওয়ায় জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ি করেছে, যদিও তারা সেখানে ১৯ বছর ধরে বহু ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। পাকিস্তানে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছেন যে, আফগানিস্তানে যে সব চীনা প্রকল্প রয়েছে, নিরাপদ পরিবেশের অভাবে সেগুলোর প‚র্ণ সুফল মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। আর এ জন্য দায়ি হলো যুক্তরাষ্ট্র।

সত্য হলো তালেবানদের সাথে আলোচনা পুনরায় শুরু করতে যুক্তরাষ্ট্রকে চীনসহ আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর উপর নির্ভর করতে হবে। এতে যেটা বোঝা গেছে যে, মার্কিন যুদ্ধ দ্রæত অসমর্থনযোগ্য হয়ে উঠছে। এর আরেকটি অর্থ হলো শান্তি প্রক্রিয়ায় আঞ্চলিক শক্তিগুলোর অন্তর্ভুক্তি আরও বাড়বে এবং এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটা আরও জটিল হয়ে উঠবে - শুধু তালেবানদের সাথে দর কষাকষির ক্ষেত্রে নয় বরং এই সব রাষ্ট্রগুলোর সাথে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রেও।

আলোচনা বাতিলের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ট্রাম্প, সেটা সত্যিকার অর্থেই উল্টা ফল নিয়ে এসেছে। মার্কিন-তালেবান বিনিময়কে একটা বহুপাক্ষিক ইস্যুতে পরিণত করেছে এবং আফগানিস্তানকে পরাশক্তিগুলোর প্রতিদ্ব›িদ্বতার কেন্দ্রে ঠেলে দিয়েছে। সূত্র : এসএএম।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ