Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

দক্ষিণাঞ্চলে কোরবানির চামড়ায় বিপর্যয়ের প্রভাব

এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং বন্ধের উপক্রম

নাছিম উল আলম : | প্রকাশের সময় : ৬ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০০ এএম

কোরবানির পশুর চামড়ার আয় বঞ্চিত দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ২০ হাজার এতিমখানা ও মাদরাসা সংযুক্ত লিল্লাহ বোর্ডিং এবং কয়েক লাখ ছিন্নমূল অভাবী আর এতিমের যথেষ্ট দুরবস্থা শুরু হয়েছে। এসব দুঃস্থ-এতিমের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের একাধিক চামড়া ব্যবসায়ী চক্র। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের উদাসীনতায় হতবাক দক্ষিণাঞ্চলের এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং সংশ্লিষ্টসহ সুবিধা বঞ্চিত মানুষেরাও।
দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকাতেই বিগত কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করতে পারেননি অনেক মানুষ। এমনকি বেশিরভাগ লিল্লাহ বোর্ডিংসহ এতিমখানাগুলো কোন পশুর চামড়া কিনতে সাহস করেনি ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে। যেসব প্রতিষ্ঠান কিনেছে, তাদের চরম বিপর্যয় বরণ করতে হয়েছে। অনেক মাদরাসা ও এতিমখানা বিনামূল্যে কোরবানির চামড়া পেলেও তা বিক্রি করতে না পেরে মহাসঙ্কটে পড়েছে। অনেক দ্বীনি প্রতিষ্ঠান চমড়ায় লবণ দেয়াসহ পরিবহন ব্যয়ের অর্থও তুলতে পারেনি। বেশিরভাগ কোরবানিদাতাই অনেক অনুরোধ করে বিনামূল্যে এসব চামড়া এতিমখানায় দিলেও সেসব প্রতিষ্ঠানও তা নিয়ে চরম সঙ্কটে পড়ে। বেশিরভাগ লিল্লাহ বোর্ডিং ও এতিমখানা অনেক অনুনয় বিনয় করে ১শ’ টাকা দরেও একটি গরুর চামড়া আড়তে বিক্রি করতে পরেনি। বিগত দিনে মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিং ও এতিমখানাগুলো বিনামূল্যে বা প্রতীকি মূল্যে কোরবানির চামড়া কিনে পাইকার বা আড়তদারদের কাছে বিক্রি করে অর্জিত মুনাফা প্রতিষ্ঠানের তহবিলে জমা করত। আর এ খাত থেকে অর্জিত মুনাফা এতিমদের ভরণ-পোষণেই ব্যয় করতেন। কোরবানিদাতারাও পশুর চামড়া বা এর বিক্রিত অর্থ একাধিক এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং ছাড়াও গরীব মিসকিনদের মধ্যেই বন্টন করতেন ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী।
কিন্তু চামড়ার আড়ৎদাররা কারসাজি করে গত আগস্টে কোরবানির দিন মাঠ পর্যায় থেকে নামমাত্র মূল্যে, এমনকি বিনামূল্যেও চামড়া সংগ্রহ করার অভিযোগ ছিল। কোরবানিদাতারা বেশিরভাগ পশুর চামড়া বিনামূল্যেই দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। যার পেছনে ট্যানারি মালিকদের প্রচ্ছন্ন ভূমিকা ছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রকৃত কোন তথ্য প্রশাসনের কাছে ছিল না বলেও জানা গেছে। ফলে সরকার কাঁচা চামড়া রফতানির বিষয়ে সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেনি। সময়মত এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিলে হয়ত বিগত কোরবানিতে পশুর চামড়া নিয়ে বিপর্যয় এড়ানো যেত।
বিগত ঈদুল আযহায় দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলায় ৪ লাখ ৩৪ হাজার পশু কোরবানি হয়েছে বলে জানিয়েছে বরিশাল বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। যা ছিল আশাতীত এবং গত বছরের চেয়ে অন্তত ১৫% বেশি। কোরবানিকৃত পশুর মধ্যে প্রায় ৩ লাখ ষাঁড়, ২৩ হাজার গরু ও বকনা এবং ১ হাজার মহিষ ছাড়াও প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজার ছাগল ও খাসিসহ প্রায় ১২শ’ ভেড়া ও অন্য পশু কোরবানি হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মতে, দক্ষিণাঞ্চলে বছর জুড়ে যত পশু জবাই হয়, তার অর্ধেকই হয়ে থাকে ঈদুল আযহার সময়ে। অধিদফতরের মতে দেশে প্রতিবছর সোয়া দু’কোটি পশু জবাই হয়ে থাকে। এ বছর তা আরো কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত ঈদুল আযহার সময় দক্ষিণাঞ্চলে যে প্রায় ৪.৩৪ লাখ বিভিন্ন ধরনের পশু কোরবানি হয়েছে, তার চামড়ার ন্যূনতম গড় মূল্য ৫শ’ টাকা হিসেব করলেও এতিমখানা, মাদরাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিংসহ গরীব মানুষ অন্তত ২২ কোটি টাকার আয় বঞ্চিত হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ গরীব-মিছকিন ও এতিমদের মুখের সে গ্রাস কেড়ে নিয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের এতিমখানা ও লিল্ল­াহ বোর্ডিংগুলো সারা বছরই কোরবানির পশুর চমড়া বা এর বিক্রিত অর্থের দানের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু এবার এতিম, গরীব আর লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের মত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সে অর্থের প্রায় পুরোটাই চলে গেছে চামড়া ব্যবসায়ীদের পকেটে। গত ঈদুল আযহার দিন থেকে নানামুখী ফন্দি ফিকির করে কোরবানিদাতা এবং মাদরাসা ও এতিমখানাগুলোর কাছ থেকে পশুর চামড়া সংগ্রহ করে আড়তদাররা ট্যানারি মালিকদের কাছে সরকার নির্ধারিত দামেই বিক্রি করে। তবে দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ আড়তদার ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে গত বছরের বকেয়া এখনো আদায় করতে পারেননি বলেও অভিযোগ রয়েছে। কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের সংঘবদ্ধ চক্র নানা পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করে কাঁচা চামড়ার বেশিরভাগই বিনামূল্যে ও কিছু পানির দরে সংগ্রহ করে। এমনকি মাদরাসা ও এতিমখানাগুলোর কাছ থেকে যে নামমাত্র মূল্যে চামড়া সংগ্রহ করেছে আড়তদাররা তাদের বেশিরভাগের টাকাই এখনো পরিশোধ না করারও অভিযোগ উঠেছে। ফলে ওইসব প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সঙ্কট আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে।
দক্ষিণাঞ্চলের চামড়ার সবচেয়ে বড় আড়ত বরিশালে। এ অঞ্চলের সবগুলো জেলা থেকে বেশিরভাগ চামড়া এখানে নিয়ে আসেন মাঠ পর্যায়ের ক্রেতা ছাড়াও মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। এখান থেকে তা ঢাকার বড় আড়ত হয়ে ট্যানারিতে যায়। লবণ দেয়া এসব চামড়ার একটি অংশ কিছু ট্যানারিতেও সরাসরি চলে গেছে। আবার অনেক জেলা থেকে লবণ দেয়া চামড়া সরাসরি ঢাকার আড়তে গেছে। এবার দক্ষিণাঞ্চলের কোন আড়তদারই বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ পাননি বলে অভিযোগ করে পুজির সঙ্কটের অজুহাতে তারা চামড়া না কেনার কথা জানিয়ে বিনামূল্যে বা নামমাত্র দরে কিনেছেন।
এদিকে গত বছর যেসব মাদরাসা ও এতিমখানা স্থানীয় আড়তসহ পাইকারদের কাছে চামড়া বিক্রি করেছিলেন, তার অর্থও এক বছর পার হলেও এখনো পাননি। অথচ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ও তহবিলের টাকা খরচ করে মাদরাসাগুলো চামড়া সংগ্রহ করে আড়তে দিয়েছিল। এক বছর পরে লাভ দূরের কথা, চামড়া কেনার আসল টাকাও তুলতে পারেননি একাধিক মাদরাসা ও এতিমখানা কর্তৃপক্ষ। উপরন্তু সারা দেশের মত দক্ষিণাঞ্চলের বিপুল সংখ্যক অসহায় মানুষও এবার কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এসব চক্রান্তের কারণে। যা ছিল ইসলামের বিধান অনুযায়ী তাদের হক।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ