Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ট্রেন দুর্ঘটনার অনুপুঙ্খ তদন্ত হতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৪ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

ঢাকা চট্টগ্রাম-স্থল যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রুট হচ্ছে রেলপথ। আসলে রাজধানীর সাথে বন্দরনগরীর কানেক্টিভিটির প্রতিটি রুটই সদা সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ। তবে নানা সমীকরণে রেলপথের গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। রেলের প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধির প্রধান কারণই হচ্ছে এর নিরাপত্তা। সড়কপথে প্রতিদিন অসংখ্য দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও রেলে তা অনেক কম। সেই নিরাপদ রেলপথ যেন ক্রমেই অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেটের মত ব্যস্ততম রুটে প্রায়শ বগি লাইনচ্যুতিসহ নানামাত্রিক দুর্ঘটনা-দুর্বিপাকে স্বাভাবিক রেল চলাচল ঘন্টার পর ঘন্টা বাধাগ্রস্ত হতে দেখা যায়। কিন্তু এমন প্রাণঘাতী ভয়াবহ দুর্ঘটনা খুব কম ঘটে থাকে। গত সোমবার গভীর রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের তুর্ণা নিশীথার যাত্রীদের বেশীরভাগই যখন ঘুম অথবা তন্দ্রাচ্ছন্ন, ব্রাহ্মনবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগ এলাকায় সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামি উদয়ন এক্সপ্রেসের সাথে তার সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই ১০ জনের মৃত্যু এবং অন্তত: ৭৫ জন যাত্রী গুরুতর আহত হন। হাসপাতালে নেয়ার পর আরো ৬ জনের মৃত্যু হয়। আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে। প্রাথমিক তথ্য অনুসারে, তুর্ণা নিশীথার চালকের ভুলের কারণে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ১৬জনের প্রাণহানি ও অর্ধশতাধিক মানুষকে আহত হতে হল। তবে ট্রেনের ডেডম্যান প্যাডেল সিস্টেম সক্রিয় থাকায় চালক ঘুমিয়ে থাকলে ডেডম্যান প্যাডেলে চাপ না পড়লে ট্রেন আপনা আপনি থেমে যাওয়ার কথা থাকলেও কসবায় তা হয়নি। এ কারণেই চালকের ঘুমের কারণে দুর্ঘটনার আশঙ্কা যর্থাথ নাও হতে পারে।

জাতীয় উন্নয়নের নিরীখে রেলের পিছিয়ে পড়া, লোকসান, উন্নয়নের সম্ভাবনা ও প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত হচ্ছে। আমাদের মত জনবহুল কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশে রেলের বিদ্যমান অবকাঠামোর উন্নয়নের বিকল্প নেই। উজানে ভারতের বাঁধ নির্মান ও পানি প্রত্যাহগারের কারণে দেশের নৌপথ ক্রমে সঙ্কুচিত হয়েছে। পণ্য পরিবহনে নৌপথের পর সবচেয়ে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হয়ে উঠতে পারত রেলপথ। রেলের অনেক অবকাঠামো জরাজীর্ণ ও অব্যবহৃত হয়ে পড়েছে। অন্যান্য সেক্টরের মত জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে নতুন রেলপথ, রেলস্টেশন, অবকাঠামো, ইঞ্জিন ও বগি বৃদ্ধির মাধ্যমে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর স্বাভাবিক উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সড়কপথে বাড়বাড়ন্তের ডামাঢোলে রেলপথের উন্নয়নকে দীর্ঘদিন অগ্রাহ্য করার মাশুল দিচ্ছে জাতি। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে রেলপথকে ঢেলে সাজানোর তেমন কোনো উদ্যোগই দেখা যায়নি। উপরন্তু রেলের হাজার হাজার একর জমি প্রভাবশালী মহলের হাতে বেদখল হয়েছে। অন্যদিকে সড়কপথ ও সড়ক পরিবহনের উন্নয়নের নামে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি অপচয়ের মাধ্যমে লুণ্ঠিত হয়েছে। গত এক দশকে সরকারের পক্ষ থেকে রেলের উন্নয়নের অনেক প্রতিশ্রুতি শোনা গেছে। রেল যোগাযোগ উন্নয়নে ৩০ বছর মেয়াদী মহাপরিকল্পনাও ইতিমধ্যে গৃহিত হয়েছে। তবে সে পরিকল্পনায় কোথায় যেন শুভঙ্করের ফাঁক রয়ে গেছে। যার কারণে রেলের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়লেও গত এক দশকে রেলের টিকিটের মূল্য দ্বিগুণের বেশি বাড়ার পরও রেলের লোকসান কমেনি। ই-টিকিটিং হলেও সেবার মান বা নিরাপত্তা বাড়েনি।

গত এক দশকে রেলের উন্নয়নে প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এর বিপরীতে রেলপথ থেকে আয় হয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যয়ের ১৫ শতাংশও উঠে আসেনি। অথচ রেলের প্রতি সব শেণীর মানুষের আগ্রহ বাড়ার পাশাপাশি রেল যাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি হলেও এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা কাজে লাগানোর তেমন কোনো বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ না থাকায় লোকসান বাড়ছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে নতুন ইঞ্জিন ও কোচ সংগ্রহ, অটোমেশন ও আধুনিকায়নের নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও রেলের জনবল সংকট নিরসন এবং দক্ষ জনবল বৃদ্ধির কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় দুর্ঘটনা, শিডিউল বিপর্যয় এবং নিরাপত্তার সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এক রিপোর্টে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে সারাদেশে ২০৯টি রেল দুর্ঘটনায় ২০৯জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। চালকের ভুলে ট্রেন দুর্ঘটনা একটা অস্বাভাবিক ও বিরল নজির। প্রয়োজনীয় দক্ষ চালক ও জনবলের সংকট থাকায় চালকদের উপর বাড়তি চাপের কারণে হয়তো চলন্ত ট্রেনের চালক ঘুমিয়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়। এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রথমেই জনবল সংকট নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে। ট্রেন চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রামসহ জীবন যাপনের স্বাভাবিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ও সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ দেখা যায় না। কসবা রেল দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৫টি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তদন্ত কমিটির সক্ষমতা, দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তদন্ত রিপোর্ট অনুসারে রেলের নিরাপত্তা ও উন্নয়নের রূপরেখা বাস্তবায়ন করা। রেলের বেদখল হওয়া হাজার হাজার এক জমি পুনরুদ্ধার, হাজার হাজার শূন্যপদ পুরণ এবং দুর্নীতি-অনিয়ম রোধ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে রেলওয়েকে দেশের উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। দুর্ঘটনা ও নিরাপত্তাহীনতা দুর করার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে উপযুক্ত ক্ষতিপুরণ দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন