Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

গৃহিণীদের থু থু কর্মসূচি ... সমুদ্র পথে কাল আসছে ২৫০০ টন পেঁয়াজ

টিসিবির পণ্য কিনতে দীর্ঘ লাইন

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৫ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০৩ এএম | আপডেট : ১২:৪২ এএম, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৯

মশলাজাতীয় পণ্য পেঁয়াজ এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। ৩০ টাকা কেজি দরের পেঁয়াজের দাম উঠেছে ২৬০ টাকা। ভারত হঠাৎ করে ২৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়ার পর মিশর, পাকিস্তান, তুরস্ক, মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ রফতানি করে চাহিদা মেটানোর চেষ্টা হচ্ছে। এমনকি কার্গো বিমানে করে পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে। টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের কৃষকদের উৎপাদিত নতুন পেঁয়াজ বাজারে উঠতে শুরু করেছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদে পেঁয়াজ সিন্ডিকেটে জড়িতরা কুমির-হাঙ্গরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ায় কিছুতেই পণ্যটির মূল্য নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এ অবস্থায় দেশের গৃহিণীরা পেঁয়াজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিনব প্রতিবাদ করেছে। তারা পেঁয়াজের সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীর কুশপুতুল বানিয়ে সেটিতে থুথু, ঝাড়ু ও ছেঁড়া জুতা নিক্ষেপের মাধ্যমে ঘৃণা প্রদর্শন করেছে। একই সঙ্গে তারা পেঁয়াজ কম ব্যবহার করে রান্নার দেশের গৃহিণীদের উৎসাহিত করছে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পেঁয়াজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে গৃহিণীদের প্রতিবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এদিকে কাল ৬ নভেম্বর সমুদ্রপথে ২৫০০ টন পেঁয়াজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছিবে বলে জানা গেছে।

থুথু কর্মসূচি : পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে পত্র-পত্রিকা, অনলাইন মিডিয়া, ফেসবুক, ব্লগ, টুইটারে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্ষুব্ধ গৃহিণীরা কর্মসূচি পালন করছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছে। তবে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে গত ৩ নভেম্বর চট্টগ্রামে। পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে ওই প্রতীকী কর্মসূচিতে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীর কুশপুতুল বানিয়ে সেটিতে থুথু, ঝাড়ু ও ছেঁড়া জুতা নিক্ষেপের মাধ্যমে ঘৃণা প্রদর্শন ছিল কর্মসূচির মূল প্রতিপাদ্য। প্রতীকী এই কর্মসূচির মঞ্চ থেকে উপস্থিত লোকজনকে খাওয়ানো হয় পেঁয়াজ ছাড়া রান্না করা মাছ-মাংসের তরকারি, লাল শাক ও পালং শাক, মিক্সড সবজি ও নুডলস।
ব্যতিক্রমী এই কর্মসূচির সভাপতিত্ব করেন নাগরিক উদ্যোগের উপদেষ্টা হাজী মো. ইলিয়াছ। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের পাশে এ জি চার্চ স্কুলচত্বরে অনুষ্ঠিত এই কর্মসূচি পথচারীসহ সবার নজর কাড়ে। একপর্যায়ে সেখানে কয়েকশ’ গৃহিণী হাজির হন।

নাগরিক উদ্যোগ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে পেঁয়াজ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণার আগুন ছড়িয়ে দাও’ সেøাগানে আয়োজিত এই কর্মসূচিতে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন সমবেতদের উদ্দেশে বলেন, পেঁয়াজের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ জনগণ উদ্বিগ্ন। সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে লুকিয়ে থাকা স্বার্থান্বেষী মহল, যারা প্রধানমন্ত্রীর শুদ্ধি অভিযানকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়, তারাই পরিকল্পিতভাবে পেঁয়াজের দাম বাড়াচ্ছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা পেঁয়াজ কারবারির সাথে জড়িত বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করেছে। তাদের ধরা হচ্ছে না কেন? চাল-ডাল পেঁয়াজ সবকিছুর দাম বাড়ছে। এটা কি মগের মুল্লুক? সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা কী করছে? তিনি আরো বলেন, ২০০ টাকা দিয়ে পেঁয়াজ না কিনে পরিবারের শিশুদের জন্য দুধ কিনুন। আর যেসব ব্যবসায়ী মানুষের মুখে খাবার কেড়ে নিতে দাম বাড়চ্ছে, তাদের প্রতি ঘৃণা জানাতে থুথু নিক্ষেপ করুন।

প্রতিবাদ সমাবেশে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসিনা মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী যখন দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, বিশ্বে যখন বাংলাদেশে সুনাম বাড়ছে, ঠিক তখনই পেঁয়াজের ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রীর সম্মানহানি করতেই এই পাঁয়তারা করছে। আমরা মহিলা সমাজ রান্নাঘর থেকেই পেঁয়াজ প্রত্যাখ্যান করছি। আত্মীয়-স্বজনদের বলব, পেঁয়াজ ছাড়া পাঁচফোড়ন দিয়ে রান্না করুন। নিরামিষ খাবার খাব। যেকোনো মূল্যে পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের চক্রান্ত বাস্তবায়ন হতে দেবো না। তাদের বলছি, দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করবেন না। এ ছাড়াও বক্তৃতা করেন মোরশেদ আলম, মহানগর আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক চন্দন ধর, মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মমতাজ খাঁন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর আফরোজা কালাম, বেসরকারি কারা পরিদর্শক আজিজুর রহমান আজিজ, নারী নেত্রী শারমিন সুলতানা ফারুক ও সাবেক ছাত্রনেতা মিথুন বড়ুয়া প্রমুখ।

২৫০০ টন পেঁয়াজ আসছে : দেশের পেঁয়াজের চাহিদা মেটাতে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে একশ কন্টেইনারে এক সাথে আড়াই হাজার টন পেঁয়াজ আসছে চট্টগ্রাম বন্দরে। তুরস্ক থেকে আমনাদি করা এই পেঁয়াজ নিয়ে ‘এমসিসি থাইপে’ কন্টেইনার জাহাজ আগামীকাল ৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছবে বলে জানা গেছে। এরপর বন্দর জেটিতে ভিড়বে। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপ এসব পেঁয়াজ সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে (টিসিবি) সরবরাহ করবে। তারা ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করবে। এর আগে সিটি গ্রুপ উড়োজাহাজে করে ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পেঁয়াজ আনলেও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে প্রথমবার পেঁয়াজ আনছে।
জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিত সাহা বলেন, উড়োজাহাজে করে নভেম্বর মাসে দুটি চালানে ২৫ টন পেঁয়াজ এসেছে তুরস্ক থেকে। আর সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কন্টেইনারে আসছে ২৫শ’ ৫৬ টন। এসব পেঁয়াজ আমরা কেজি ৩৭ টাকা ৫০ পয়সা দরে টিসিবিকে হস্তান্তর করেছি। টিসিবি ন্যায্যমূল্যে এসব পেঁয়াজ সারাদেশে বিক্রি করছে। সরকারকে সহযোগিতা করতেই আমদানি করা হয়েছে।

জানা গেছে, পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ার পর বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের অনুরোধে সাড়া দিয়ে দেশের কয়েকটি শীর্ষ শিল্পগ্রুপ সমুদ্রপথে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নেয়। এরমধ্যে সবার আগে ২০ নভেম্বর পাকিস্তান থেকে প্রথম কার্গো বিমানে করে ৮১ টন ৫০০ কেজি পেঁয়াজ আমদানি করে ঢাকার শাদ এন্টারপ্রাইজ। রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছিলে দ্রুত খালাস করে বাজারে দেয়া হয়। অতঃপর দ্রুত পেঁয়াজ নিয়ে আসে ভোগ্যপণ্যের শীর্ষ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামভিত্তিক বিএসএম গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি এরইমধ্যে প্রায় ৬শ’ টন পেঁয়াজ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এনে বাজারে সরবরাহ করেছে। মেঘনা গ্রুপ এনেছে সাড়ে ৫শ’ টন পেঁয়াজ। ৬৪ হাজার টনের আমদানি সনদ নিয়েছে এস আলম গ্রুপ; উড়োজাহাজে তাদের কিছু পেঁয়াজ ঢাকায় পৌঁছলেও এখন পর্যন্ত সমুদ্রপথে কোনো পেঁয়াজ আসেনি। তবে অনেকগুলো ছোট আমদানিকারক এখন আমদানি করে বাজারে সরবরাহ রেখেছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের এক কর্মকর্তা জানান, এমসিসি থাইপে জাহাজটি বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছবে ৬ ডিসেম্বর। জাহাজটিতে পেঁয়াজ থাকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জেটিতে ভিড়ার সুযোগ পাবে। ফলে দ্রুত পেঁয়াজ জাহাজ থেকে নামবে। চট্টগ্রাম বন্দরের হিসাব মতে ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ হাজার ৭৯৭ টন পেঁয়াজ চট্টগ্রাম বন্দরে নেমেছে। এরমধ্যে সরবরাহ হয়েছে ১১ হাজার ৭১২ টন। বাকিগুলো ছাড়ের অপেক্ষায় আছে।
টিসিবির ট্রাকে দীর্ঘ লাইন : সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেড করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কয়েকদিন থেকে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলা শহরে ট্রাকে করে পেঁয়াজ বিক্রি করছে। সীমিত আয়ের মানুষ ও স্বল্প আয়ের মানুষজন দীর্ঘলাইনে দাঁড়িয়ে ন্যায্য দামে পেঁয়াজ কিনছেন। পেঁয়াজের লাইনে পুরুষের চেয়ে নারীদের সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। গতকাল দেখা গেছে শুধু পেঁয়াজ নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যই নিম্নবিত্তের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। তাই সাধারণ মানুষ লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে পেঁয়াজসহ চিনি, মশুর ডাল, সয়াবিন তেল কিনছেন। রাজধানীর খামারবাড়ির মোড়ে লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে টিসিবি থেকে পেঁয়াজের পাশাপাশি চিনি, মশুর ডাল, সয়াবিন তেল কিনতেও দেখা যায় নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষদের। টিসিবির পণ্য কিনতে লাইনে দাঁড়ানো আশালতা বেগম নামের এক ক্রেতা বলেন, ‘চিনি, পেঁয়াজ আর ডাল নিতে এসেছি। দোকানে চিনি কিনতে লাগে ৬৫ টাকা, এখানে ৫০ টাকা। বাজারে পেঁয়াজ ২০০ থেকে ২৩০ টাকা পর্যন্ত লাগে, এখানে ৪৫ টাকায় পাচ্ছি। বোতলের তেল বাজারে ১১০ টাকা, এখানে পাচ্ছি ৮০ টাকায়। সব দিক থেকেই সুবিধা পাচ্ছি, তাই এখানে এসেছি।’

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পেঁয়াজ

১৩ এপ্রিল, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ