Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

উদার ও অসম্প্রায়িক শাসক ছিলেন বাবর

মুফতী পিয়ার মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মসজিদ নির্মাণের জন্য অন্যত্র ৫ একর জমি বরাদ্দ দিয়ে প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো বাবরি মসজিদের স্থানে রাম মন্দির নির্মাণের রায় দিয়েছে। এতে সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ মারাত্মকভাবে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। ভারতসহ পুরো মুসলিম বিশ্বে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের ঝড় উঠেছে। এই রায় যে পূর্বপরিকল্পিত এবং তাতে যে হিন্দু সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদী গোষ্ঠির ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির দাবি অসার ও ভিত্তিহীন, তা জানার জন্য আমাদের ফিরে যেতে বাদশাহ বাবর, বাবরি মসজিদের ইতিহাস এবং এতদসংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্তের দিকে।

উপমহাদেশে ইসলাম ও ইসলামী শাসন: খুলাফায়ে রাশিদীনের জামানা থেকেই ভারত উপমাহাদেশে ইসলাম ও মুসলমানদের আগমন ঘটে। সূফি-সাধক, পীর-দরবেশ ও ধর্ম প্রচারকগণ তখন থেকেই দীনে ইসলামের সুমহান নীতি ও আদর্শ এ দেশের মানুষের মাঝে প্রচার করতে থাকেন। তাঁদের সুমহান আখলাক-চরিত্র ও মানবতাবাদী কর্মকান্ডে বিমুগ্ধ হয়ে এ দেশের জনসাধারণ বিশেষ করে হিন্দু বর্ণবাদী শ্রেণির বৈষম্যের যাতাকলে নিষ্পেষিত মানুষ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল এবং ইসলামের মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, অনুপম সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সন্ধান পেয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। অনেকে আবার যথা নিয়মে ইসলাম গ্রহণ না করলেও তাদের মানসিক সমর্থন ঝুঁকে পড়েছিল ইসলামের দিকেই। এ কারণেই ইসলাম ধর্মের প্রচারকগণ শাসন ক্ষমতার অধিকারী না হয়েও একেক এলাকায় নিজেদের আদর্শিক প্রভাব বিস্তার করে: ক্রমান্বয়ে মানুষকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে সময় মুসলমানদের ইবাদত-বন্দেগী ও শিক্ষা-দীক্ষার তাকীদেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ-মাদরাসা ও খানকাহ ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়। এক পর্যায়ে ভারত উপমহাদেশে পুরোদ¯ুÍর মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর কয়েকশ বছর পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে মুসলিম শাসকগণ উপমহাদেশ শাসন করেন।

মোঘল শাসন: ২১ এপ্রিল ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে কাবুলের আমীর মোঘল বংশোদ্ভুত বাবর ভারত আক্রমণ করে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে দিল্লির সুলতান ইবরাহিম লোদীকে পরাজিত করে দিল্লির মসনদ দখল করেন। এতে করে ভারতবর্ষে মোঘল শাসনের সূচনা হয়। বাবরের ক্ষমতা দখলের পর ১৩ জন মোঘল সম্রাট ১৫২৬-১৮০৩ পর্যন্ত প্রায় সুদীর্ঘ ২৭৭ বছর দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থেকে ভারতবর্ষ শাসন করেন।

বাদশাহ বাবর ও তাঁর সুমহান আদর্শ: ইতিহাস সাক্ষী, বাদশাহ বাবর ছিলেন একজন উদারমনা ধর্মপরায়ন প্রজাবান্ধব ও বিচক্ষণ শাসক। তাঁর মতো একজন শাসক মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ নির্মাণ করবেন তা বিশ্বাস করা তো অনেক পরের কথা, কল্পনাই করা যায় না। কারণ তিনি নিজে আমৃত্যু অহিংসা ও অসাম্প্রদায়িক নীতি অনুসরণ করেই শাসন পরিচালনা করেছেন এবং তাঁর উত্তরসূরীদেরও সেই নীতি অনুসরণের অসিয়ত করে গেছেন। বাবরি মসজিদ নির্মাণের বছর ৯৩৫ হিজরি/১৫২৮ ঈসায়ীতে পুত্র হুমায়ুনকে সম্বোধন করে তিনি অসিয়ত করেছেন, ‘পুত্র! ভারতবর্ষে বহু ধর্মের সমাবেশ। আল্লাহর শোকর, তিনি আমাদেরকে এই ভূখন্ডের রাজ্য ক্ষমতা দান করেছেন। তোমার অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হলো, ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে সকল ধর্মাবলম্বীর প্রতি তাদের রীতি অনুসারে ন্যায়বিচার করা। গাভী কুরবানি থেকে বিরত থেকো, তাহলে ভারতবাসীর হৃদয়রাজ্য জয় করতে পারবে এবং তাদের আনুগত্য লাভ করবে। হুকুমতের আইন-কানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল প্রজার মন্দির ও উপাসনালয় ধ্বংস করো না। এমনভাবে ন্যায়বিচার করো, যেন রাজা প্রজাদের প্রতি আর প্রজারা রাজার প্রতি সন্তুষ্ট থাকে। মনে রেখো, ইসলামের প্রচার অত্যাচারের খড়গ দ্বারা নয়, মাহাত্ম ও উদারতার দ্বারাই হতে পারে। শীয়া-সুন্নী মতবাদকে সর্বদা এড়িয়ে যেও। অন্যথায় ইসলামের শক্তি খর্ব হবে। বিভিন্ন মত ও পথের লোকদের এমনভাবে মিলিয়ে রেখো যেভাবে মানব দেহের মূল চার উপাদান মিলিত থাকে। তাহলে সালতানাত বিভেদ-বিশৃঙ্খলা মুক্ত থাকবে। পাঠক! বাবরি মসজিদ নির্মাণের বছরই বাদশাহ বাবর পুত্রকে সম্বোধন করে এই কালজয়ী অসিয়তনামাটি লিখেছিলেন। রাম জন্মভূমির মন্দির ধ্বংস করেই যদি তিনি মসজিদটি নির্মাণ করে থাকেন, তাহলে পুত্রকে কী করে এই অসিয়ত করতে পারেন?

বাবরের উদারতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও মহানুভবতা: বাদশাহ বাবরের ইনসাফ, উদারতা ও মহানুভবতা কেমন ছিল তা খোদ হিন্দু ঐতিহাসিকদের যবান থেকেই শুনুন। আজ পর্যন্ত সকল হিন্দু ঐতিহাসিক বাবরের হৃদয়গ্রাহী ব্যক্তিত্ব, উদারতা, অহিংসা, অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি গুণের ভূয়সী প্রসংশা করেছেন। তাঁদের কয়েকজনের সাক্ষ্য ও মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা হলো। ইতিহাসের অধ্যাপক শ্রীরাম শর্মা স্বীয় গ্রন্থ ‘মোঘল এমপায়ার অব ইন্ডিয়া’তে বাবরের উপরোক্ত অসিয়তনামা উদ্ধৃত করার পর লেখেন, ‘বাবর কোনো মন্দির ধ্বংস করেছেন কিংবা কোনো হিন্দুকে ধর্মীয় কারণে কষ্ট দিয়েছেন এমন কোনো প্রমাণ ইতিহাসে নেই।’ পাটনা ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক ঐতিহাসিক রাম প্রসাদ খোশলা তার ‘মোঘল কিংশিপ এন্ড নোবেলটি’, গন্থে বাবরের বিভিন্ন গুণাবলি আলোচনা করার পর লেখেন, ‘বাবরের রোজনামচায় কোনো মন্দির ধ্বংসের কথা নেই। তিনি ধর্মীয় কারণে বিধর্মীদের পাইকারী হারে হত্যা করেছেন, এরও কোনো প্রমাণ নেই। তাঁর উদারতা ও অসাম্প্রদায়িকতা সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ছিল।’ এলাহবাদ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. রাম প্রসাদ ত্রিপাঠি ‘রাইয এন্ড ফল অব মোঘল এমúায়ার’ গ্রন্থে লেখেন, ‘বাবর ধর্মান্ধ ছিলেন না। আমির-গরিব, হিন্দি-আফগানি সবার সাথেই তাঁর আচরণ ছিল ভদ্র, শালীন ও বন্ধুত্বপূর্ণ।’ এরপর একটি দীর্ঘ পর্যালোচনায় তিনি লেখেন, মোঘল সালতানাতের শান-শওকত কেবল সমর শক্তির কারণেই ছিল না; বরং অমুসলিম প্রজাদের সাথে বিশেষ করে রাজপুতদের সাথে তাঁরা ধর্মীয় উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন। সে যুগে শিল্প-সাহিত্যের বিকাশও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। আকবরকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতেই হবে। তবে এর ভিত্তি রচিত হয়েছিল তার মহান পিতামহ বাবরের জামানায়। তিনি এমন এক শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তক, যাতে ধর্ম ও বর্ণে বিভেদ ছিল না। বন্ধুত্ব ও বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে রাজপুত সমস্যার সমাধান এবং তাদের মিত্রতা অর্জন করা হয়েছিল। দরবারের রীতি-নীতি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে এ সকল বিষয়ে সূচনা হয়েছিল বাবরের শাসনামলেই। তিনি কেবল একটি নতুন সা¤্রাজ্যের ভিত্তি প্রস্তরই স্থাপন করেননি, রাজ্য শাসনের নীতি ও পদ্ধতির দিকেও ঈঙ্গিত করে গেছেন। ভারতবর্ষে তিনি এমন এক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ও শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তক, যার দৃষ্টান্ত অন্য দেশের ইতিহাসে পাওয়া যায় না।

বাবর সম্পর্কে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও রাষ্ট্র নায়কদের মন্তব্য: বাদশাহ বাবরের ব্যক্তিত্ব ও মহানুভবতায় স্বাধীন ভারতের বাঘা বাঘা রাজনৈতিক ব্যক্তি ও রাষ্ট্র নায়ক অভাবনীয়ভাবে প্রভাবিত হয়ে বাবরের ভূয়সী প্রসংশা করেছেন। ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ তার ‘ইন্ডিয়া ডিভাইডাড’ গ্রন্থে পুত্র হুমায়ুনকে লেখা বাবরের কালজয়ী চিঠিটি সংকলন করেছেন এবং বাবরকে একজন অসাম্প্রদায়িক শাসক বলে মন্তব্য করেছেন। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা, স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জাওহরলাল নেহেরুও বাবরের সুমাহন ব্যক্তিত্বে দারুণ প্রভাবিত ছিলেন। তিনি ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে বাবর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বাবর ছিলেন জাগরণ যুগের আদর্শ নেতা। তাঁর চরিত্রে অভিযানপ্রিয়তা, শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগ ও সৌখিন জীবনের আগ্রহ ছিল।’ একজন রাষ্ট্রনায়ক কী পরিমাণ উদার, অসাম্প্রদায়িক ও অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে ভিন্ন ধর্মের বিশিষ্ট ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা এমন সাক্ষ্য দিতে পারেন ও মন্তব্য করতে পারেন তা একজন সচেতন ব্যক্তিমাত্রই উপলব্ধি করার কথা।

মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে ইসলামের দিক নির্দেশনা
মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে ইসলামী শরীআতের অনেক নিয়ম-কানুন ও বাধ্য-বাধকতা আছে। সে সকল নিয়ম-কানুন ও বাধ্য-বাধকতা মেনেই মসজিদ নির্মাণ করতে হয়। না মেনে কেউ মসজিদ নির্মাণ করলে তা মসজিদ বলে গণ্য হয় না। সকল মাজহাবের সকল ফকীহগণের সর্বসম্মত মত এই যে, কোনো ব্যক্তি বা কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন জমি জবর দখল করে তাতে মসজিদ নির্মাণ করা নাজায়েয। নির্মাণ করে ফেললেও তা ইসলামের দৃষ্টিতে মসজিদ বলে গণ্য হবে না এবং তাতে নামায পড়াও নাজায়েয। উক্ত মসজিদকে বাতিল ঘোষণা করে হকদার তার হক উসূল করে নিতে পারবে। সর্বকালের সকল নির্ভরযোগ্য মুফতী ও উলামায়ে কিরাম এই ফাতওয়াই দিয়ে আসছেন। মোটকথা, মসজিদ বানানোর জন্য অবশ্য পালনীয় শর্ত এই যে, জমির মালিকানা বৈধ উপায়ে হাসিল হতে হবে। কারো হক নষ্ট করা যাবে না। কোনো প্রকার জোর-জবরদস্তি করা যাবে না। অবৈধ উপায়ে কোনো মসজিদ নির্মাণ করা হলে এর প্রতিবাদ সর্ব প্রথম আলেম-উলামাগণই করে থাকেন। শরীআতের বিধি-বিধানের তোয়াক্কা না করে কেউ যদি কোথাও এমন মসজিদ বানিয়ে থাকে, তাহলে তা কোনো কালেই আলেম-উলামা ও ফকীহগণের নিকট মসজিদ বলে স্বীকৃত হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না। ইসলামের ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্তও আছে যে, গির্জার জমি জবরদখল করে মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করার কারণে মসজিদের ঐ অংশ ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। উমাইয়া খলীফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক সিরিয়ার দামেশকে একটি শানদার মসজিদ নির্মাণ করার ইচ্ছা করেছিলেন। পরিকল্পনা মাফিক মসজিদটি নির্মাণ করতে গিয়ে জমির সংকট দেখা দিল। পাশেই একটি গির্জা ছিল। এ জন্য তিনি খ্রিস্টানদের কাছে উক্ত গির্জার জমি চাইলেন। তারা উত্তর দিল, এই জমি দিতে আমরা প্রস্তুত নই। এপরপরও যদি জোর করে নেওয়া হয়, তাহলে জবরদখলকারী কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হবে। তাদের এই জবাব শুনে খলীফা ওয়ালিদ ক্রুদ্ধ হলেন এবং বললেন, দেখা যাক কুষ্ঠ হয় কি না এবং গির্জার জমিতে মসজিদ নির্মাণ করলেন। খলীফা উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহ. এর জামানায় খ্রিস্টানরা তাঁর কাছে এই অভিযোগ নিয়ে এলো। খলীফা উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহ. ছিলেন কুরআন-সুন্নাহর খাঁটি অনুসারী। খোলাফায়ে রাশিদীনের প্রকৃত উত্তরসূরী। সাহাবায়ে কিরামের জলন্ত প্রতিচ্ছবি। তাই তিনি সঙ্গে সঙ্গে মসজিদের ঐ অংশ, যা গির্জার জমিতে বানানো হয়েছিল, ভেঙ্গে দেওয়ার আদেশ করলেন। উপরন্তু বাইতুল মালের খরচে গির্জা পুনর্নির্মাণের ফরমানও জারি করলেন। মসজিদ নির্মাণের এ সকল বিধি-নিষেধ বাদশাহ বাবরের অবশ্যই জানা ছিল। কারণ তিনি কুরআন-হাদীস ও ফিকহ শাস্ত্রে প্রভূত জ্ঞান রাখতেন। তার প্রমাণ হচ্ছে তার রচিত মাসআলা-মাসাইল সংক্রান্ত কিতাব ‘ফিকহে বাবরি’। যেই বাদশাহ ভিন্ন ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের প্রতি যারপর নাই উদার, যে উদারতা ও ইনসাফের সাক্ষ্য দিয়েছেন স্বয়ং হিন্দু ধর্মেরই কর্তা ব্যক্তিগণ। যিনি মসজিদ নির্মাণের উদার নীতি ও ইনসাফপূর্ণ বিধি-বিধান সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল, তাঁর সম্পর্কে কীভাবে ধারণা করা যায় যে, তিনি রাম মন্দির ভেঙ্গে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেছেন?

বিবাদের সূত্রপাত
মোঘল আমলের ইতিহাসে রাম মন্দির ও বাবরি মসজিদ বিতর্কের কথা পাওয়া যায় না। এই বিতর্কের শুরু ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে। এর আগে এ নিয়ে কোনো বিতর্ক ছিল না। মোঘল শাসন দুর্বল হওয়ার পর অযোধ্যায় নবাবদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। নবাবদের শাসনও যখন দুর্বল হয় তখন এ অঞ্চলের রাজনীতিতে ইংরেজদের অনুপ্রবেশ ঘটে। মূলত এই সময়টাতেই অযোধ্যায় মসজিদ-মন্দির বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে। এই অযাচিত বিতর্কের জেরেই ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। এর পিছনে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল। তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে, এ অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা নিষ্কন্টক করতে হলে এখানকার অধিবাসীদের মাঝে দ্ব›দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টি করতে হবে। শুরুতেই অযোধ্যা তাদের অপতৎপরতার কেন্দ্রে পরিণত হয়। দিল্লিতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে। এরপর থেকে মুসলমানরা যেখানেই মুসলমানদের সংখ্যা বেড়েছে, সেখানেই মসজিদ নির্মাণ করেছেন, ইমাম-মুআযযিন নিয়োগ দিয়েছেন, মুসাফিরদের জন্য সরাইখানা এবং পীর-দরবেশদের জন্য খানকাহ নির্মাণ করেছেন। মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং মুদাররিস নিয়োগ দিয়েছেন। এই ধারাবাহিকতায় অযোধ্যায় মুসলমানদের আগমনের পর এখানেও মসজিদ-মাদরাসা ইত্যাদি নির্মিত হয়েছে। এ দিকে অযোধ্যাকে হিন্দুরা পবিত্র স্থান মনে করত। এটাকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজ বেনিয়া গোষ্ঠি হিন্দুদের উত্তেজিত করার জন্য প্রচার করতে থাকল যে, অযোধ্যার অধিকাংশ মসজিদ হিন্দুদের মন্দির ভেঙ্গে কিংবা তাদের কোনো পবিত্র স্থানে নির্মিত। অন্যদিকে মুসলমানরা যেন হিন্দুদের দাবি মেনে না নেয় সে দিকে উৎসাহ প্রাদানের জন্য চালবাজ ইংরেজ বেনিয়ারাই তাদের গেজেটিয়ার ও প্রতœতাত্তিক রিপোর্টসমূহে তাদেরই বর্ণিত পবিত্র স্থান সম্পর্কে লিখত যে, এগুলো বিরান হয়ে বন-জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল। পরে সেগুলো নিছক অনুমানের ভিত্তিতে নির্ণয় করা হয়েছে। চালবাজ ইংরেজরা প্রথমে প্রপাগান্ডা চালিয়েছে যে, হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করে মুসলমানদের মসজিদ বানানো হয়েছে। এরপর হিন্দু-মুসলিম বিবাদ মেটানোর জন্য ইংরেজ বাহিনী মিমাংসাকারীর ভূমিকায় ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছে। হিন্দুদের দাবি ছিল, ধ্বংসকৃত মন্দিরসমূহ পুনর্নির্মাণ করা হোক এবং সে সকল স্থানে নির্মিত মসজিদগুলো ধ্বংস করা হোক। আর মুসলমানদের পক্ষে তা যৌক্তিক কারণেই মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ ঘটনার সমসাময়িক ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থে এইসব প্রচার-প্রচারণার কোনো প্রমাণ ও তত্ত¡-উপাত্ত না থাকায় তা ছিল সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। ঘটনার বহু যুগ পরের বই-পুস্তকে এইসব কথা ও দাবি-দাওয়া পাওয়া গেলে তা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? তাই মসজিদ স্বস্থানে বহাল থাকবে। তাতে নামায আদায়ে বাধা দেওয়া যাবে না। বড় আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বিবাদের সূচনাকাল [১৮৫৫] থেকে আজ পর্যন্ত কোনো হিন্দু পন্ডিত বা ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ নির্মাণের সমসাময়িক কোনো হিন্দি বা সংস্কৃত সূত্র থেকে দেখাতে পারেননি যে, অযোধ্যার কোনো মসজিদ হিন্দুদের মন্দির ভেঙ্গে বানানো হয়েছিল। কেবল গুজব ও প্রপাগান্ডায় কান দিয়ে এবং চালবাজ ইংরেজদের বানানো বিবরণে বিশ্বাস করেই হিন্দুরা বারবার উত্তেজিত হয়েছে এবং দাঙ্গার সৃষ্টি করেছে।

উপরিউক্ত আলোচনায় এ কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, বাবরি মসজিদের স্থানে কানো কালেই রাম মন্দির বা অন্য কোনো মন্দির ছিল না। বাবরি মসিজদ নির্মাণ করা হয়েছিল সম্পূর্ণ নির্ভেজাল ও নিষ্কণ্টক স্থানে, যাতে কোনো মন্দির, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা কোনো ব্যক্তি কিংবা অন্য কোনো ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা কোনো কালেই ছিল না। তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, রাম মন্দির ভেঙ্গে উক্ত স্থানে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করা হয়নি। এ সবই ছিল শত শত বছরের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতিতে চিড় ধরিয়ে ধূর্ত ইংরেজদের অযোধ্যার ক্ষমতা নিষ্কন্টক করার হীন পাঁয়তারা মাত্র। তাই ভারতবর্ষের অখন্ডতা ও ঐক্যের স্বার্থেই অতীব জরুরি হলো, সুপ্রিম কোর্টের উক্ত বিতর্কিত ও পক্ষপাতমূলক রায় প্রত্যাহার করে বাবরি মসজিদ স্বস্থানে বহাল রাখার যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া মিফতাহুল উলূম, নেত্রকোনা



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন