Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিরাপত্তা, সুশাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করাই মূল চ্যালেঞ্জ

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

সবকিছু একটা আরেকটার সাথে গুলিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র এবং সরকার; সরকার এবং দল; দল, প্রশাসন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান একাকার হয়ে পড়ায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ছে। নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার ও আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই সাধারণ মানুষ করের টাকায় প্রশাসন, সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ করা হয়। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো রাজনৈতিক বা গোষ্ঠিগত পক্ষাবলম্বনের সুযোগ নেই। জননিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের মধ্যে যে সীমারেখা থাকা আবশ্যক তা রক্ষা করা প্রতিটি সরকার ও প্রতিটি রাজনৈতিক-সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মৌলিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে এবং পার্টি ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সীমারেখা মুছে গিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র একসময় টোটালিটারিয়ান বা সর্বগ্রাসী ব্যবস্থায় পরিণত হয়। এ ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থায় আভ্যন্তরীণভাবে ক্ষমতার জোরে সরকার সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হলেও বহিঃশত্রæর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে রাষ্ট্র অত্যন্ত দুর্বল ও ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে। স্বাধীনতার পর প্রায় অর্ধশত বছরে পদার্পণ করে আমাদের রাষ্ট্র যদি এখন গণতান্ত্রিক অঙ্গীকার থেকে সরে গিয়ে সর্বগ্রাসী ব্যবস্থায় পরিণত হয়, নতুন প্রজন্মের কাছে তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ও গণতান্ত্রিক প্রত্যাশার সাথে রাজনৈতিক মহলের বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবেই চিহ্নিত হবে। পাকিস্তানি স্বৈরাচারের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করে একটি বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার। কোটি মানুষের স্বপ্ন, ত্যাগ ও লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার অঙ্গীকার কোনো দলীয় স্বার্থের গ্যাড়াকলে বন্দি থাকতে পারে না। এ জাতি তা কখনো মেনে নেয়নি বলেই সুলতানী-মোঘল আমল থেকে বৃটিশ ও পাকিস্তানি আমল পর্যন্ত বাংলাদেশ সব সময় স্বাধিকারের লড়াই করে জাতিগত স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলেছে। ভাষার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য বাঙ্গালী মুসলমানের সংগ্রাম উপমহাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিবর্তন ও অগ্রযাত্রায় মাইল ফলক ভূমিকা পালন করেছে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের একমাত্র স্বাধীন রাজনৈতিক আত্ম-পরিচয়ের ঠিকানা বাংলাদেল আজ বড় ধরনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আর মাত্র ১ বছর পরেই আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করতে চলেছি। স্বাধীনতার সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এখন বাংলাদেশের নেতৃত্বে রয়েছে। তাদের নেতৃত্বেই হয়তো স্বাধীনতার সুর্বণ জয়ন্তী পালিত হবে। একটি সংগ্রামী জাতি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ৫০ বছর পূর্তি জাতির জন্য অনেক বড় মাইল ফলক। এ সময় অনেকেই হয়তো স্বাধীনতার প্রত্যাশা, প্রাপ্তি, সাফল্য ও ব্যর্থতার হিসাব মিলাতে চাইবেন। একাত্তরের স্বাধীনতা যেমন কোনো একক দলীয় রাজনৈতিক ইস্যু ছিল না, তেমনি স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীও কোনো দলীয় রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটি সার্বজনীন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ইস্যু। কোনো দলীয় রাজনৈতিক গোঁড়ামী, কুপমন্ডুকতা ও হীনস্বার্থের কারণে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে জাতির প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মধ্যে বড় ধরনের গরমিল ধরা পড়লে তা সমগ্র জাতিসত্তার উপর কালিমা লেপন করবে।

বর্তমান সরকারের তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার প্রথম বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। তবে সাধারণত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন কোনো রাজনৈতিক সরকারের প্রথম বছর পার করায় যে উদযাপনের উৎসবমুখরতা থাকার কথা তা তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। রাজপথে দাঁড়াতে না পারলেও রাজপথের বিরোধীদল বিএনপি আগামী ৩০ ডিসেম্বর গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালনের ঘোষণা দিয়েছে। পক্ষান্তরে সরকার ও সরকারি দল হয়তো গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষার দিন হিসেবে দিবসটি সাড়ম্বরে পালনের উদ্যোগ নেবে। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে কোনো রাজনৈতিক-সামাজিক ইস্যুই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অগোচরে রাখা যায় না। গত বছর ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন কিছু অদ্ভুত নির্দেশনা জারি করেছিল। এসব নির্দেশনা মূলত নির্বাচনের অনিয়ম, ভোটকেন্দ্র দখল, জালভোট ও একহাতে সিলমারার দৃশ্যগুলোকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখতেই কাজ করে। ভোটকেন্দ্রে দলীয় ক্যাডারদের অবাধ জাতায়াতের ব্যবস্থা থাকলেও গণমাধ্যমকর্মী ও ক্যামেরা সচল রাখার ব্যবস্থা রহিত করার ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা নেই। এতকিছুর পরও একাদশ জাতীয় নির্বাচনে রাতের বেলা সিল মেরে বাক্স বোঝাই করার ব্যাপক কারসাজি গোপন রাখা যায়নি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল প্রধান বিরোধীদলের জোট ও বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের বাইরে রেখেই। সে নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের চালচিত্র, টার্নওভার ও সামগ্রিক চিত্র দেশের গণতন্ত্রের জন্য লজ্জাজনক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। এমনকি সরকারি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফ থেকেও একটি রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে যথাশীঘ্র সব দলের অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচনের কথা বলা হয়েছিল। তবে সে অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার বাস্তবতা দেশে নতুন একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে দশম জাতীয় সংসদের প্রথম বর্ষপূর্তিকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে পালনের ডাক দিয়ে বিএনপি নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে বালুর ট্রাক দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখার স্মৃতি হয়তো এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে। দশম জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামাত জোটের লাগাতার অবরোধ কর্মসূচির কারণে রাজধানী ঢাকা কার্যত সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। সেই সাথে রাজপথে আগুন সন্ত্রাস, গণপরিবহনে অগ্নি সংযোগের ঘটনাবলী দেশে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। সে সব আগুন সন্ত্রাসে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার ঘটনায় বিএনপি সরাসরি অভিযুক্ত হলেও এ নিয়ে বেøইম-গেম ও কনস্পিরেসি তত্ত¡ও সমানভাবে সক্রিয় রয়েছে। বরিশালের এক আওয়ামী লীগ নেতা নিজ দলের আরেক নেতার বিরুদ্ধে নিজের মালিকানাধীন গাড়িতে আগুন দেয়ার অভিযোগ করেছিলেন। অবরোধ অগ্নি সংযোগের ঘটনায় যেমন বিএনপি জোটের সরাসরি দায় আছে, একইভাবে অবরোধ আগুন সন্ত্রাসের সময় বেশকিছু স্থানে সরকারি দলের নেতাকর্মীদেরকেও নাশকতামূলক কর্মকান্ডে জড়িত থাকার তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে দেখা যায়। তবে সে সব নাশকতা ও গাড়িতে অগ্নি সংযোগের ঘটনায় বিএনপি- জামাতের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে লাখ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় নাশকতার সাথে যুক্ত প্রকৃত অপরাধীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অপরাধী যে দলেরই হোক, নাশকতার অপরাধকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের হাতিয়ারে পরিণত করলে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও এ ধরনের অপরাধ কখনো বন্ধ হবে না।

স্বাধীনতার ৫০ বছর বা সুবর্ণ জয়ন্তীকে সামনে রেখে আভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। শুধু সরকারের পক্ষে এককভাবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার কার্যকর রোডম্যাপ অর্গলমুক্ত করা সরকারের দায়িত্ব। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভিন্নমত ও রাজনৈতিক বিভক্তি থাকবেই। সে বিভক্তি যদি দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তিকে স্পষ্টভাবে বিভক্ত করে পারস্পরিক বৈরী শক্তিতে পরিণত করে এবং তা যদি সামাজিক-রাজনৈতিক হানাহানি ও প্রতিহিংসার জন্ম দেয় তা রাষ্ট্রীয় অগ্রগতি ও অগ্রযাত্রায় দুর্লঙ্ঘ প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা, ভোটাধিকার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন না হলে এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গণতান্ত্রিক নিরপেক্ষতা রক্ষিত না হলে সে শাসনব্যবস্থায় জননিরাপত্তা ও সমাজ প্রগতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব। অস্থিতিশীল ও সামাজিক-রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যায় না। মিয়ানমারের রাখাইনের মুসলমানদের উপর সামরিক জান্তার মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দমন নিপীড়নের ধারাবাহিক তৎপরতায় বাংলাদেশ সরাসরি আক্রান্ত। দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রিফিউজি বাংলাদেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ নিয়ে বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক বিভেদ না থাকলেও রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও আইনগতভাবে রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের প্রচ্ছন্ন দুর্বলতা ধরা পড়ছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের পক্ষে একটি আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে উঠার পাশাপাশি ইসলামি সম্মেলন সংস্থা(ওআইসি)র মত আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় ভূমিকাতে কাজে লাগিয়ে সমস্যা মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের নিষ্ক্রীয়তাই ধরা পড়ে। আফ্রিকান দেশ গাম্বিয়া যখন রোহিঙ্গা গণহত্যা ও মানবাধিকারের প্রশ্নে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে মামলা লড়ছে, তখন বাংলাদেশ একতরফাভাবে মিয়ানমারের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করছে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি আদালতে বক্তব্য দিতে গিয়ে নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ায় গাম্বিয়ার মামলার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেন। যদিও তার সেই দাবি আদালতের যুক্তিতর্কে টিকেনি। রাখাইনে গণহত্যা এবং রোহিঙ্গা রিফিউজি প্রশ্নে বিশ্বশক্তিগুলোর আঞ্চলিক পক্ষপাত সভ্যতার জন্য অনেক বড় কলঙ্ক। আঞ্চলিক শক্তি চীন ও ভারতের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণেই বাংলাদেশকে নিরব ও নমনীয় ভূমিকায় অবস্থান করতে হচ্ছে। ভারত ও চীন বাংলাদেশের দুই প্রধান অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অংশীদার ও আঞ্চলিক প্রতিবেশী হওয়া সত্তে¡ও রোহিঙ্গা সংকটে তাদের ভূমিকা বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতা ও দুর্বলতাকেই নির্দেশ করে। অর্থনৈতিকভাবে মিয়ানমারের চাইতে ভালো অবস্থানে থাকলেও হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্যিক অংশীদারকে আমরা নিজেদের পক্ষে কাজে লাগাতে পারছি না। আমাদের জন্য এটা অনেক বড় ব্যর্থতা। অন্যদিকে আসামের এনআরসি এবং নয়াদিল্লির সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট রোহিঙ্গা সংকটের মতো বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দেখা দিলেও এ বিষয়ে আমাদের সরকারের নিরবতা ও নিষ্ক্রীয়তা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। আমাদের সরকার এবং নাগরিক সমাজ বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সামাজিক অবস্থা নিয়ে গর্ব করলেও ভারতের মন্ত্রীর পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়নের কাল্পনিক অভিযোগ তোলার পরও আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে সে সব বক্তব্যের আনুষ্ঠানিক জোরালো প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। উপরন্তু আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের উপর আস্থা রেখে বসে থাকার পক্ষেই কথা বলছেন। তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের প্রশ্নে ভারতের অনিচ্ছা-অনাগ্রহ, নতুন নতুন বাঁধ নির্মাণ এবং পানি প্রত্যাহারের ধারাবাহিক তৎপরতার মধ্যেও আমাদের সরকার দীর্ঘদিন ধরে তাদের উপর আস্থা রাখার কথা বলছেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বর্ষপূতির এই সময়টি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে সামনে রেখে গতানুগতিক রাজনৈতিক ধারা, একচেটিয়া সর্বগ্রাসী ব্যবস্থা পরিবর্তন করে বহুমত ও দলের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক সহাবস্থান এবং মতপ্রকাশ ও সভাসমাবেশের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহারের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বিগত দু’টি জাতীয় নির্বাচন এবং বেশ কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচনে সরকার, সরকারি দল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের একচেটিয়া ভূমিকার কারণে দেশের নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। একাদশ জাতীয় নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে পুনরায় দলের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়নের মধ্য দিয়ে জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা। কিন্তু বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় কাউন্সিলের পর সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে কলঙ্কজনক ঘটনাটি ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ভবনে। প্রায় তিন দশক পর আদালতের নির্দেশনা এবং ছাত্র-শিক্ষক সমাজের দাবির মুখে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে সব দল ও মতের শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সমান সুযো-সুবিধা না থাকলেও নির্দলীয় সংগঠন সাধারণ ছাত্র অধিকার ও কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে উঠে আসা মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থীরা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ডাকসু নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের একচেটিয়া কর্তৃত্ব ও দখলদারিত্বের মধ্যে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনেও কয়েকটি হল সংসদে জাতীয় নির্বাচনের মতো রাতের বেলায় ব্যালট বাক্স ভরে ফেলার চিত্র দেখা গেছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব চিত্র ভাইরাল হয়ে পড়া এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে ডাকসু নির্বাচনে একচেটিয়া টার্নআউট সম্ভব না হওয়ায় কোটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে আসা ছাত্রনেতা নুরুল হক নুর ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ক্যাডার বাহিনী ও প্রশাসনের উপর একচেটিয়া কর্তৃত্বের মধ্যেও ডাকসুতে ছাত্রলীগের প্যানেলকে হারিয়ে কোটা বিরোধী আন্দোলনের নেতার ভিপি পদে পাস করার বাস্তবতা ছাত্রলীগের কেউ কেউ মেনে নিতে পারেনি। এ কারণেই গত ১০ মাসে ডাকসু ভিপির উপর ৮ বার হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলার প্রায় প্রত্যেকটিতেই অভিযোগের আঙুল উঠেছে ছাত্রলীগের দিকে। ভিপি নুরুল হক নুর সংঘবদ্ধ চক্রের হামলায় আহত হয়ে বার বার হাসপাতালে ভর্তি হলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়া দুঃখজনক। উপমহাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে ধর্মের নামে অধর্ম, দেশপ্রেমের নামে সংবিধান ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বেড়ে চলেছে। বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি সংগঠনের নেতাকর্মীদের হামলায় ডাকসু ভিপিসহ বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রলীগ ও ডাকসুর অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা রয়েছে। সেই ঐতিহ্যকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে ডাকসু ভিপিকে ডাকসু ভবনে পিটিয়ে আহত করল কথিত মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতারা। সেখানে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রচ্ছন্ন ভূমিকার অভিযোগ রয়েছে। গত এক দশকে আওয়ামী লীগ নেতা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বার বার ছাত্রলীগের কারণে বিব্রত হয়েছেন। বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগের কর্মকান্ড বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন, বহিষ্কার করেছেন। এবার মুক্তযুদ্ধ মঞ্চ ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ছাত্র নেতাদেরকে রক্তাক্ত করার পর সারাদেশের ছাত্র সমাজ এবং সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছেন। প্রতিবাদ-বিক্ষোভ প্রশমনে সরকারের পক্ষ থেকেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে দেখা যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কয়েকজন নেতাকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। হামলাকারী বাকিদেরও গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা হবে, এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিরোধী শক্তি কখনো মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ হতে পারে না। দেশের শিক্ষাঙ্গণের সন্ত্রাস কঠোর হাতে দমনের পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্য ও অগ্রগতি নিশ্চিত করাই এই মুহূর্তে সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন