Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অস্থিতিশীল স্বর্ণের বাজার

এক বছরের ব্যবধানে ভরিতে ১৩ হাজার টাকা বৃদ্ধি : স্বর্ণে বিনিয়োগ বাড়ছে

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৬ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

অস্থিতিশীল আন্তর্জাতিক সোনার বাজার। সেই ধাক্কায় দেশের বাজারেও স্বর্ণের মূল্য উর্ধ্বমুখী। সামনের দিনগুলোতে দাম কমার কোন লক্ষণ দেখছেন না এ খাতের ব্যবসায়ীরা। গত বছর মূল্যবান ধাতুটির দাম গড়ে প্রায় প্রতি মাসেই বেড়েছে। এর মধ্যে গত জুলাই ও আগস্ট মাসে ছয় দফা দর বেড়েছে। গত বছরের ১ জানুয়ারি দেশের বাজারে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেট সোনার দাম ছিল প্রতি ভরি ৪৭ হাজার ৪৭২ টাকা। আর চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬০ হাজার ৩৬১ টাকা। অর্থাৎ প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ভরিতে দাম বেড়েছে ১২ হাজার ৮৮৯ টাকা। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম ২০১৩ সালের পর সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) তথ্য অনুযায়ী, দেশের বাজারে সোনার দাম ২০১২ সালের পর সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। ওই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর ভালো মানের সোনার ভরি ৬০ হাজার ১৬২ টাকা হয়েছিল; যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দর। ১৯৭০ সালে সোনার ভরি ছিল মাত্র ১৫৪ টাকা। ১৯৮০ সালে তা ৩ হাজার ৭৫০ টাকা হয়। ১৯৯০ সালে দাম দাঁড়ায় সাড়ে ৬ হাজার টাকা। ২০০০ সালের দিকে দাম ছিল ৬ হাজার ৯০৬ টাকা। ২০১০ সালে ৪২ হাজার ১৬৫ টাকায় ঠেকে মূল্যবান ধাতুটির দাম। জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের সারা বছরের বিক্রির একটি বড় অংশ হয় ডিসেম্বর-জানুয়ারি-ফেব্রæয়ারি মাসে, মানে বিয়ের মৌসুমে। কিন্তু এবার বেচাবিক্রি তাদের প্রত্যাশার অর্ধেকও পূরণ করতে পারবে বলে তারা মনে করতে পারছেন না। বাংলাদেশে এখন ২২ ক্যারেটের ভালো মানের সোনার দাম ৬০ হাজার ৩৬১ টাকা, যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিয়ের বাজার ধরতে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) গত অক্টোবরে প্রতি ভরি (২২ ক্যারেট) সোনার দাম ৫৬ হাজার ৮৬২ টাকায় নামিয়ে এনেছিল। কিন্তু এরপর চার ধাপে সেই দাম ৬০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। আর সেজন্য মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাকে দায়ী করছেন বাংলাদেশের গয়না ব্যবসায়ীরা। জুয়েলার্স সমিতি বলছে, দেশীয় মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় বুলিয়ন মার্কেটে সোনার দাম বেড়েছে। তাই সর্বশেষ গত ৫ জানুয়ারি জুয়েলার্স সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটি দেশের বাজারে সোনার দাম ভরিতে ১ হাজার ১৬৬ টাকা বাড়ানো হয়।

মূলত বায়তুল মোকাররম, নিউ মার্কেট, চাঁদনি চক, বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্ক, ইস্টার্ন প্লাজাসহ বড় বড় শপিংমল ও অভিজাত বিপণি বিতানগুলো রাজধানীতে গয়নার বড় বাজার।
গতকাল বায়তুল মোকাররম ও নিউ মার্কেট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ক্রেতার অভাবে গয়নার দোকানের কর্মীরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। আমিন জুয়েলার্স, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড, সুলতানা জুয়েলার্সসহ পরিচিত ব্র্যান্ডের দোকানে দুয়েকজন ক্রেতা থাকলেও বাকি দোকানগুলো প্রায় ফাঁকা।

নিউ মার্কেটে সুলতানা জুয়েলার্সের ব্যবস্থাপক সৈয়দ মনির হোসেন বলেন, গত এক মাসে দেখতে দেখতে সোনার দাম অনেক বেড়ে গেল। বেচাকেনা নেই বললেই চলে। এই মন্দাভাব কবে দূর হবে বলা মুশকিল।
আমিন জুয়েলার্সের শাখা ব্যবস্থাপক ইউনুস আলী খান বলেন, তাদের বিক্রি ‘একেবারেই’ কমে গেছে। যাদের ১০ ভরি কেনার পরিকল্পনা ছিল, তারা এখন ৬/৭ ভরিতেই বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করছে।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বলেন, সোনার বাজার একটি অনিশ্চিত বাজার। দামের ওঠানামা এই বাজারের জন্য খুবই অস্বস্তিকর। দাম বাড়লেও সেটা ব্যবসায়ীদের স্বস্তি দেয় না, কারণ প্রতিদিন যে পরিমাণ সোনা বিক্রি হয় বাজার থেকে ঠিক সে পরিমাণ সোনা কিনেই স্টক ঠিক রাখতে হয়। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম বাড়ছে তাই আমাদেরও দাম বাড়াতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বছরের শুরু থেকে পর্যায়ক্রমে আউন্সপ্রতি দাম বেড়েছে আড়াইশ’ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় একুশ হাজার টাকা। ভরিপ্রতি বেড়েছে আট হাজার টাকা। কিন্তু আমরা একবারে না বাড়িয়ে পর্যায়ক্রমে বাড়াচ্ছি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পণ্য বাজার ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম বøুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে (স্পট মার্কেট) ২০১৩ সালের এপ্রিলে সোনার দাম আউন্সপ্রতি সর্বোচ্চ এক হাজার ৫৩৪ ডলার ৩১ সেন্টে উঠেছিল। ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ দাম ছিল আউন্সপ্রতি ১ হাজার ৩৭১ ডলার, ২০১৫ সালে ১ হাজার ২৯৪ ডলার, ২০১৬ সালে ১ হাজার ৩৮৯ ডলার, ২০১৭ সালে ১ হাজার ৩৩৩ ডলার এবং ২০১৮ সালে ছিল ১ হাজার ৩৫৫ ডলার। সর্বশেষ গতকাল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স (৩১ দশমিক ১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) সোনার দাম ১ হাজার ৫৫১ মার্কিন ডলার ছিল। তবে গত কয়েক মাস ধরেই মূল্যবান ধাতুটির দর বেশ ওঠা-নামার মধ্যে রয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে বিভিন্ন দেশে প্রবৃদ্ধির হার কমে গেছে। স্বাভাবিকভাবে বিনিয়োগও কমে যাচ্ছে। শেয়ারবাজার অস্থির হয়ে উঠছে। অন্যদিকে ডলার দুর্বল হচ্ছে। এতে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের সবচেয়ে নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে ডলারের বদলে সোনা বেছে নিয়েছে। এছাড়া সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও সোনা কিনে রাখছেন। এসব কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম কয়েক মাস ধরে বাড়ছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, বাণিজ্যযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে সোনার দাম আউন্সপ্রতি ১ হাজার ৬০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকার বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতসহ বড় দেশগুলোর অর্থনীতিতে মন্দার প্রভাব পড়েছে সোনার দামে। এসব দেশ তাদের মুদ্রার মানও কমিয়েছে। কমেছে ঋণের সুদের হারও। ফলে বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণে বিনিয়োগ করছে। স্বর্ণের এই বাড়তি চাহিদার কারণে প্রভাব পড়ছে দামে।

এদিকে সরকার স্বর্ণ নীতিমাল-২০১৮ ঘোষণা করার পর চলতি বছরে নিজেদের কাছে সঞ্চিত সোনা বৈধ করেছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে ডিসেম্বরের শুরুতে একটি ব্যাংকসহ ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে স্বর্ণ আমদানির লাইসেন্সও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শুল্ক বাধার কারণে এখনও কোনো লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান স্বর্ণ আমদানি শুরু করতে পারেননি বলে জানালেন দিলীপ আগরওয়ালা। তিনি জানান, একজন যাত্রী এখন সর্বোচ্চ ১০০ গ্রাম সোনার গয়না বিনা শুল্কে আনতে পারেন। আর শুল্ক দিয়ে সর্বোচ্চ ২৩৪ গ্রাম বা ২০ ভরি সোনার বার আনা যায়। সেক্ষেত্রে প্রতি ভরিতে শুল্ক দিতে হয় ২ হাজার টাকা। ‘অথচ লাইসেন্সধারী একজন ব্যবসায়ী যখন আমদানি করবেন, তখন প্রতি ভরিতে ওই দুই হাজার টাকা শুল্কের বাইরে আরও ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম বাণিজ্য শুল্ক (এটিভি) দিতে হবে। আমরা ভ্যাট ও অতিরিক্ত শুল্ক কমিয়ে সর্বসাকুল্যে ভরিপ্রতি এক হাজার টাকা শুল্ক আরোপের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে এনবিআরকে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু এখনও কোনো সাড়া পাইনি। এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে এনবিআর’র ভ্যাট পলিসি বিভাগের সদস্য গোলাম কিবরিয়া বলেন, বাজুসের চিঠি এলে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হবে।



 

Show all comments
  • ইমরান এইচ ১৬ জানুয়ারি, ২০২০, ১:৪৪ এএম says : 0
    ওরা ভারতের সাথে তাল রেখে বাড়িয়ে দিছে
    Total Reply(0) Reply
  • Md Nurul Islam Jashim ১৬ জানুয়ারি, ২০২০, ১:৪৪ এএম says : 0
    বাংলাদেশ তো স্বর্ন অামদানি করে না সব চোরাই পথে নিয়ে আসে ,, তাহলে বিশ্বের সাথে তাল মিলাবে কেনো?? দাম বাড়বে কেনো
    Total Reply(0) Reply
  • জোহেব শাহরিয়ার ১৬ জানুয়ারি, ২০২০, ১:৪৫ এএম says : 0
    দেশই অস্থিতিশীল তো স্বর্ণের বাজার অস্থিতিশীল হবেই তো।
    Total Reply(0) Reply
  • মেহেদী ১৬ জানুয়ারি, ২০২০, ১:৪৫ এএম says : 0
    এ আর নতুন কি। এই দেশে স্থিতিশীল বলে কিছু নেই।
    Total Reply(0) Reply
  • Babul ১৬ জানুয়ারি, ২০২০, ৯:৫১ এএম says : 0
    চোরাই স্বর্ণগুলো কোথায় যাচ্ছে, কেউ দেখছে না...
    Total Reply(0) Reply
  • Md. Didarul Alam ২৬ মে, ২০২২, ৭:৩০ পিএম says : 0
    2006,2007, এবং 2008 সালে স্বর্ণের দাম কত ছিল? দয়া করে Aproximate দাম টা কি বলা যাবে। চার্ট দিলে খুবই উপকৃত হব। ধন্যবাদ
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: স্বর্ণ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ