Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

১৫ জনের মৃত্যুদন্ড

ঢাকা ও চট্টগ্রামে পৃথক দুই মামলার রায়, ৫ পুলিশের ফাঁসি

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ২১ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে গুলি চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যার ঘটনায় মামলায় পাঁচ আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল সোমবার চট্টগ্রামের বিশেষ জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ মো. ইসমাইল হোসেন চার আসামির উপস্থিতিতে বহুল আলোচিত এ রায় ঘোষণা করেন। দন্ডিত পাঁচজনই পুলিশ সদস্য।

দুইশ পৃষ্ঠার রায়ে আদালত বিনা উসকানিতে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদার অবৈধ নির্দেশে ২৪ জনকে গুলিবর্ষণ করে হত্যা এবং নিরীহ শত শত মানুষকে আহত করার ঘটনা মাস কিলিং বা গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রায় ঘোষণার পর আদালত প্রাঙ্গণে উল্লাসে ফেটে পড়েন আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা।

অন্যদিকে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো চার আসামি এবং আদালতের বাইরে তাদের স্বজনেরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। আগামী ২৪ জানুয়ারি এ ঘটনার ৩২ বছর পূর্ণ হবে। দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময়ে মামলার বাদী, প্রধান আসামিসহ তিন আসামি ও তদন্ত কর্মকর্তা মারা গেছেন। উল্লেখযোগ্য বেশ কয়েকজন সাক্ষী এবং বিচারের অপেক্ষায় থেকে মারা গেছেন নিহতদের অনেক স্বজন।

আলোচিত এ মামলায় দন্ডিতরা হলেন- চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কোতোয়ালি অঞ্চলের তৎকালীন পেট্রোল ইনসপেক্টর (পিআই) গোবিন্দ চন্দ্র মন্ডল ওরফে জে সি মন্ডল, কন্সটেবল মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, শাহ মো. আবদুল্লাহ ও মমতাজ উদ্দিন। জে সি মন্ডল পলাতক আছেন। বাকি চারজন কারাগারে।

রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ পিপি মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দন্ডবিধির ৩০২ ও ৩৪ ধারায় মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে। একই সাথে তাদের ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া ‘বিপজ্জনক অস্ত্র দিয়ে গুরুতর আঘাত সৃষ্টির’ দায়ে দন্ডবিধির ৩২৬ ধারায় পাঁচ আসামির প্রত্যেককে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদন্ড এবং ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদন্ড দিয়েছেন বিচারক।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি লালদীঘি ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভা ছিলো। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমানবন্দর থেকে নেমে কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে সরাসরি লালদীঘি ময়দানের দিকে রওনা হন। ততক্ষণে পুলিশ পুরো এলাকা ঘেরাও করে ফেলে। তাকে বহনকারী জনসভামুখী খোলা ট্রাক আদালত ভবনের দিকে এগিয়ে আসতেই তাতে নির্বিচারে গুলি ছোড়া শুরু হয়। সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ২৪ জন। আহত হন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সাংবাদিকসহ শতাধিক মানুষ। দলের নেতাকর্মী ও আইনজীবীরা আওয়ামী লীগ সভাপতিকে ঘিরে মানববেষ্টনী তৈরি করে তাকে নিরাপদে আইনজীবী সমিতি ভবনে নিয়ে যাওয়ায় তিনি রক্ষা পান। গুলিতে নিহতদের কারও লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবার লাশ বলুয়ার দীঘি শ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
নিহত হন যারা

ওইদিন নির্বিচারে গুলিতে নিহত হয়েছিলেন মোট ২৪ জন। তারা হলেন- মো. হাসান মুরাদ, মহিউদ্দিন শামীম, স্বপন কুমার বিশ্বাস, এথলেবার্ট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, ডি কে চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, আব্দুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বি কে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, সমর দত্ত, হাসেম মিয়া, মো. কাসেম, পলাশ দত্ত, আব্দুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ ও শাহাদাত।

অবৈধ নির্দেশে
আদালত মামলার রায়ে আসামিদের তথ্যের ভিত্তিতে ঘটনার একটি চিত্র তুলে ধরেন। এটি মাস কিলিং বা গণহত্যা উল্লেখ করে রায়ে বিভিন্ন সময়ে এ মামলার বিচার বিঘিœত হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। আদালত বলেন, সাক্ষীদের জবানবন্দিতে জানতে পেরেছি সে সময়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমানবন্দর থেকে পথসভা করতে করতে লালদীঘির দিকে যাচ্ছিলেন। জেলা পরিষদ এলাকায় পেশাজীবীদের সাথে মতবিনিময় সভার কথা ছিল। তার গাড়িবহরের পথে তিনটি ব্যারিকেড দেয়া হয়। একটি কোতোয়ালীর মোড়, অপরটি বাংলাদেশ ব্যাংকের গেইট ও শেষটি লালদীঘি এলাকায়। কৌশলে কোতোয়ালী মোড়ের প্রথম ব্যারিকডেটি সরিয়ে গাড়িবহর ঢুকে পড়লে জে সি মন্ডল ওয়্যারলেসে জানায়, ‘তারা চলে আসছে।’ সে সময় সিএমপির তৎকালীন কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা ওয়্যারলেসে পলাতক আসামি জে সি মন্ডলকে গুলি করার নির্দেশ দেন। তার এ অবৈধ নির্দেশ পাওয়ার পর জে সি মন্ডলের নির্দেশে আসামিরা এলোপাতাড়ি রাইফেলের গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে ২৪ জন নিহত হয়। এ হত্যাকান্ডের সাক্ষ্য প্রমাণ এবং আলামত বিনষ্ট করতে নিহতের স্বজনদের অগোচরে সকলের লাশ অভয়মিত্র শ্মশান ঘাটে পুড়িয়ে ফেলা হয়। শত শত নিরীহ মানুষকে গুলি করে আহত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ মামলার অন্যতম সাক্ষী উল্লেখ করে আদালত রায়ে বলেন, নিরাপত্তাজনিত কারণে তিনি সাক্ষ্য দিতে আসতে পারেননি। ৫৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। সাক্ষ্যে প্রমাণ হয়েছে ওইদিন কোন ধরনের সহিংসতার আগেই কিলিং শুরু হয়।

পাঁচ বছর পর মামলা
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের অবসানের পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী মো. শহীদুল হুদা বাদী হয়ে ৪২ জনকে আসামি করে এ ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময়ে মামলার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলাটির তদন্তে গতি আসে। আদালতের নির্দেশে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি মামলাটি তদন্ত করে ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি প্রথম এবং অধিকতর তদন্ত শেষে ১৯৯৮ সালের ৩ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় অভিযোগপত্র দেয়। এসব অভিযোগপত্রে আসামি করা হয় আট পুলিশ সদস্যকে।
তারা হলেন- সিএমপির তৎকালীন পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদা, কোতোয়ালি অঞ্চলের পেট্রোল ইনসপেক্টর জে সি মন্ডল, কনস্টেবল আব্দুস সালাম, মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, বশির উদ্দিন, শাহ মো. আবদুল্লাহ ও মমতাজ উদ্দিন। এদের মধ্যে রকিবুল হুদা, বশির উদ্দিন ও আব্দুস সালাম মারা গেছেন। মামলার বাদী মো. শহীদুল হুদাও মারা গেছেন। মারা গেছেন সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি আব্দুল কাদেরও।

বাধাগ্রস্ত হয় সাক্ষ্যগ্রহণ
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসলে ফের এ মামলার বিচার কাজ ঝিমিয়ে পড়ে। ২০০১ সালের মে থেকে ২০০৬ সালের ২৩ আগস্ট পর্যন্ত মামলার কোন সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। এরপর ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়েও কারও সাক্ষ্য নেয়া যায়নি। ২০১৬ সালে মামলাটি চট্টগ্রামের বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে আসার পর সাক্ষ্যগ্রহণে গতি আসে। এরমধ্যে ২০১৬ সালের ২৬ জুন সাক্ষ্য দেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। নিহত একজনের মা শেফালী সরকার, সাংবাদিক অঞ্জন কুমার সেন ও হেলাল উদ্দিন চৌধুরী, এডভোকেট সুভাষ চন্দ্র লালা, নিহতের ভাই অশোক কুমার বিশ্বাস, নিহতের মা হাসনা বানু, নিহতের ভাই মাঈনুদ্দিন, আবু সৈয়দ এবং অশোক বিশ্বাস সাক্ষ্য দেন। এছাড়াও সাক্ষী হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক, এম এ জলিল, এম এ মান্নান, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এবং আতাউর রহমান খান কায়সারের নাম ছিল। তারাও গত কয়েক বছরে মারা গেছেন। গত ১৪ জানুয়ারি এ মামলার ৫৩ তম সাক্ষী আইনজীবী শম্ভুনাথ নন্দীর সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্যদিয়ে শেষ হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।

টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা
ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনসহ প্রায় সব সাক্ষী তাদের সাক্ষ্যতে জানিয়েছেন, ওইদিনে হামলার মূল টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা। তবে জনতার বাধভাঙা প্রতিরোধ এবং শেখ হাসিনার অসীম সাহসিকতায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেছেন। খোলা ট্রাকে স্থাপিত মঞ্চে শেখ হাসিনা ভাষণ দেয়ার সময় নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। কিন্তু মুহূর্তের জন্য তিনি বিচলিত হননি। গুলি বন্ধ করতে পুলিশকে অনুরোধ করেন তিনি। ট্রাকে থাকা নেতাদের অনেকে শুয়ে পড়ে আত্মরক্ষার চেষ্টায় ছিলেন। অথচ তখনও সাহসিকতার সাথে জনতার উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। পরে আইনজীবীসহ দলের নেতারা মানববেষ্টনি তৈরি করে শেখ হাসিনাকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে আইনজীবী সমিতি কার্যালয়ে নিয়ে যান।

আদালত প্রাঙ্গণে উল্লাস
রায় ঘোষণার পর আদালত প্রাঙ্গণে উল্লাসে ফেটে পড়েন আইনজীবীরা। এ সময় সেখানে ‘শেখ হাসিনার বাংলায়-খুনিদের রক্ষা নাই’ শেখ হাসিনার ভয় নাই-রাজপথ নাই ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান তোলেন আইনজীবীরা। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল বলেন, সেদিন শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে নির্বিচারে গুলি করা হয়েছিল। স্বৈরাচারের গুলি উপেক্ষা করে আমাদের নেত্রী জনগণের উপর গুলিবর্ষণ থামানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি সেদিন অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। আমরা এতোদিন অপেক্ষায় ছিল খুনিদের বিচার হোক। সে অপেক্ষার অবসান হয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে গুলিবর্ষণকারীদের সর্বোচ্চ সাজা হয়েছে। এতে করে এ ঘটনায় যে ২৪ জন জীবন দিয়েছেন তাদের স্বজনেরাও খুশি বলে জানান তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মৃত্যুদন্ড

১৮ নভেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ