Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

চাক্তাই খালের হাহাকার

বেপরোয়া দখল বর্জ্যরে ভাগাড়ে ভয়াবহ দূষণ

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

খরস্রোতা কর্ণফুলী হয়ে চাক্তাই খাল থেকে পণ্যবোঝাই নৌকা, ট্রলার ছুটে যেত বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। দুই কূলের বাসিন্দারা প্রাকৃতিক এ খালের পানি পানও করতেন। দেশ-বিদেশি পর্যটকরাও ছুটে যেতেন সেখানে। কিন্তু দিনে দিনে অযত্ম, অবহেলা, বেপরোয়া দখল, দূষণে সমৃদ্ধি-সম্ভাবনার চাক্তাই খাল এখন চট্টগ্রামের দুঃখ।
এ খালকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জে চলছে হাহাকার। নৌপথে পণ্য পরিবহন বন্ধ হওয়ার পথে। বর্ষায় বৃষ্টি আর প্রবল জোয়ারে পানিবদ্ধতায় প্রতিবছর নষ্ট হচ্ছে শত শত কোটি টাকার মালামাল। লোকসানের মুখে এলাকা ছাড়তে শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। খালের বর্জ্য আর দূষিত পানিতে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে দুর্গন্ধ। পরিবেশ এতটাই ভয়াবহ দূষণের শিকার হয়েছে টিউবওয়েলের পানিতেও দুর্গন্ধ।
মৃতপ্রায় এ খালের প্রাণপ্রবাহ ফিরিয়ে আনার বদলে গলাটিপে ধরেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ। দুই বছর আগে সিটি কর্পোরেশনসহ বিশেষজ্ঞদের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করে তৎকালীন সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম খালের মুখে রেগুলেটর স্থাপনের কাজ উদ্বোধন করেন। কোনরকম প্রাকসম্ভাব্যতা যাচাই না করে গৃহীত এ প্রকল্পে চাক্তাই খালের মরণ ডেকে আনবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। খালের মুখের একাংশ দখলে নিয়ে রেগুলেটরের কাজ শুরু হলেও গত দুই বছরে অগ্রগতি খুব সামান্য। এতে আগামী বর্ষায় পানিবদ্ধতা ভয়াবহ আকার ধারণ করার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গতকাল মঙ্গলবার খালের মুখ থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, খালজুড়ে পলিথিন, প্লাস্টিক, আমদানি পণ্যের কার্টনের সাথে আসা ককসিটসহ হরেক বর্জ্যরে স্তুপ। এসব বর্জ্যে ভরাট হয়ে গেছে চাক্তাই খাল। বদরখালী উপখালসহ চাক্তাই খালমুখী সবকটি নালা এবং ছরায় বর্জ্যরে বাগাড়। খালের মুখ কর্ণফুলী নদীর প্রান্ত থেকে চর চাক্তাই পর্যন্ত একাংশ দখলে নিয়ে রেগুলেটর নির্মাণের কাজ করছে সিডিএ।
ব্যবসায়ী ও মাঝি-মাল্লারা জানান, ভাটার সময় খালের মুখেই নর্দমার রূপ। কয়েক বছর আগেও এই অবস্থা ছিলো না। প্রতিদিন অসংখ্য নৌযান চামড়ার গুদাম হতে চর চাক্তাই পর্যন্ত বিভিন্ন ঘাটে পণ্য বোঝাই করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলাচল করতো। শত শত কোটি টাকার পণ্য পরিবহন হতো নৌপথে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের ২৫-৩০ ভাগ এই খাল দিয়ে পরিবহন করা হতো। মালামাল বোঝাই ‘এম বি শাপলা-১’ ছয় দিন ধরে আটকা খালে।
খালাসী আনোয়ার হোসেন জানালেন, দুই দিনের মধ্যে মালামাল নিয়ে স›দ্বীপে খালাস করে ফিরে আসার কথা। কিন্তু ভরাট খালে নৌকায় ৮০ লাখ টাকার পণ্যসহ আট মাঝি-মাল্লা বন্দি হয়ে পড়েছে। প্রবল জোয়ারের অপেক্ষায় তারা। এই দুর্গতি দেখে খালে না ঢুকে বেশিরভাগ নৌযান খালের মুখে কর্ণফুলীতে মালামাল বোঝাই করছে।
স›দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে নেওয়ার উদ্দেশে নৌযান মান্নান-১ এর সারেং সেলিম উদ্দিন বলেন, আগে খালের অনেক ভেতরে গিয়ে মালামাল তোলা হতো। তখন প্রতি বস্তায় ঘাট শ্রমিকদের সাত টাকা করে দিতে হতো। এখন খালের মুখে নৌযান রেখে মালামাল তুলতে হচ্ছে। শ্রমিকেরা গুদাম থেকে ঠেলাগাড়িতে মালামাল এনে নৌযানে তুলছে। এজন্য প্রতি বস্তায় মজুরি দিতে হচ্ছে ২০ টাকা। এতে পরিবহন ব্যয় প্রায় তিনগুণ বেড়ে গেছে।
হাতিয়া, কুতুবদিয়া ও বাঁশখালী থেকে আসা কয়েকজন নৌযান চালক জানান, সিডিএর রেগুলেটর স্থাপনের কাজে ধীরগতির কারণে চাক্তাই খাল এখন মরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় জোয়ারের সময়ও নৌযান চালানো যাচ্ছে না। পণ্য বোঝাই করতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। পদ্মা অয়েলের ডিলার মেসার্স খাজা ট্রেডিংয়ের কর্মকর্তা নুরুল আবছার বলেন, একসময় নৌপথে শত শত ড্রামভর্তি কেরোসিনসহ জ্বালানি তেল দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ দেওয়া হতো। এখন তা প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। এ অবস্থায় অনেকে ব্যবসা সরিয়ে নিচ্ছেন। যারা কোথাও যেতে পারছেন না তারা লোকসান গুণছেন।
ওই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা বিশিষ্ট সাংষ্কৃতিক কর্মী-সমাজসেবী শাহরিয়ার খালেদ বলেন, খনন ছাড়াই চাক্তাই খালের তলা পাকা করায় গভীরতা কমে গেছে। এতে বৃষ্টির পানি বয়ে নিয়ে যেতে পারছে না চাক্তাই খাল। আবার জোয়ারেও প্লাবিত হচ্ছে খালের দুই ক‚ল। এ খালকে রক্ষা একইসাথে মহানগরীকে পানিবদ্ধতা ও জোয়ার থেকে রক্ষায় খালের স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে। সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছাড়া নগরীর খাল, নালা রক্ষা করা যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, পলিথিন বর্জ্যে খাল, নালা অচল হয়ে পড়েছে।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ওই এলাকার সাবেক কাউন্সিলর জামাল হোসেন বলেন, খালের কারণে পুরো মহানগরীতে পানিবদ্ধতা হচ্ছে। জোয়ার আর পানিবদ্ধতায় চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের প্রতি বর্ষায় শত শত কোটি টাকা লোকসান গুণতে হচ্ছে। সিডিএ সবাইকে অন্ধকারে রেখে খালের মুখে রেগুলেটর নির্মাণ করছে। এর ফলে চাক্তাই খাল তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলবে। বিগত ২০০৪ সালে চাক্তাই খাল খনন না করে তলা পাকা করার এবং দখলদার উচ্ছেদ ও নিয়মিত খনন না করায় খালের এই মরণদশা বলেও জানান তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, সুইস গেইট বসানো হলে চাক্তাই খাল পুরোপুরি ভরাট হয়ে অচল হয়ে যাবে আর তাতে নৌপথে পণ্যপরিবহনও বন্ধ হয়ে যাবে। তবে প্রকল্পের পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী রাজিব দাশ বলেন, কর্ণফুলী থেকে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত ২২শ কোটি টাকায় নদী তীরবর্তী উপকূলীয় সড়ক নির্মাণের অংশ হিসাবে চাক্তাই খালসহ ১২টি খালের মুখে রেগুলেটর বসানো হচ্ছে।
চাক্তাই খালের মুখে রেগুলেটর বসানো হলেও নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। ফলে নৌপথে পণ্যপরিবহনে কোন অসুবিধা হবে না। প্রকল্প কাজের ধীরগতির বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, একপাশে কাজ করতে গিয়ে কিছুটা ধীরে করতে হচ্ছে। তবে আগামী বছরের জুনের মধ্যে কাজ শেষ হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে বহদ্দারহাট বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত ১২৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি নতুন খাল খনন উদ্বোধন করেছেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। খালটি চালু হলে ওই এলাকার পানিবদ্ধতা সমস্যা লাঘব হবে বলে আশা করছেন স্থানীয়রা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দূষণ

২৫ জানুয়ারি, ২০২৩
২৮ ডিসেম্বর, ২০২২
৪ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ