Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

উন্নয়নের চালচিত্র এবং একটি অর্থবহ মুজিববর্ষ

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

২০২০ সালকে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করেছে সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবর্ষকে জাতি ও বিশ্বের সামনে মহিমান্বিত করে উপস্থাপন করাই হচ্ছে মুজিববর্ষের নানা কর্মসূচির লক্ষ্য। আগামী ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিনকে ঘিরে দু’মাস ব্যাপী আনুষ্ঠানিক কাউন্টডাউন চলছে। ১৭মার্চ থেকে বর্ষব্যাপী মুজিব জন্মশত বর্ষের জাতীয় কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে। এ উপলক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ আগামি ২২ ও ২৩ মার্চ সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকেছেন। সেখানে ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রণব মূখার্জিকে বিশেষ বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকেও বেশ কিছু অতিথির আগমন ঘটবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিন ও মুজিব বর্ষ এমন এক সময়ে উদযাপিত হচ্ছে, যখন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় জাতি এক চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সেই সাথে আমাদের জন্য এটি এমন এক সময় যখন আমরা আমাদের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করতে চলেছি। উল্লেখ্য, ২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতা সুবর্ণ জয়ন্তীতে পদার্পণ করবে। যে কোনো জাতির জন্য এটি এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষ উদযাপন এবং স্বাধীনতার স্থপতি, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ও বীর পুরুষদের স্বপ্ন-বাস্তবতার প্রশ্নে নতুন প্রজন্ম অনেক কিছুই তলিয়ে দেখতে চাইবে। সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশি ডায়াসপোরার নবীন-প্রবীণ অংশিজন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা স্বাধীনতার ৫০ বছরের অর্জন ও ব্যর্থতাকে মূল্যায়ণ করতে চাইবে। যে জাতি ধর্মীয় চেতনার নিরীখে দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে ১২০০ মাইল দূরের সিন্ধু-পাঠানদের সাথে রাজনৈতিক মেলবন্ধন করে, যে জাতি ভাষার স্বাতন্ত্র্য এবং মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় রাজপথে বুকের রক্ত দেয়ার বিরল নজির স্থাপন করে, যে জাতি রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তি, বৈষম্যহীন সমাজ, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের দাবিতে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে লাখো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অমূল্য স্বাধীনতা অর্জন করার অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করে। এখানেই শেষ নয়, সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতিয় ঐক্য গড়ে তোলা এবং ঐকবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার অনন্য নজিরও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অংশ। এতকিছুর মধ্য দিয়ে অর্জিত ভাষা ও সংস্কৃতি, ধর্মীয় চেতনা ও মূল্যবোধ, বৈষম্যহীন সমাজ, অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র তথা সব নাগরিকের অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থার কোন ধাপে আমরা অবস্থান করছি তাই এখনকার মূল্যায়ণের বিষয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি যদি সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, মানুষের নিরাপত্তা না থাকে, রাষ্ট্রীয় পরিষেবা এবং বিচার ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে, রাষ্ট্রের সম্পদ লুণ্ঠিত হয়, বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে লাখ লাখ মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। এমন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি-পরিবেশকে উন্নয়ন বলা চলে না। সামাজিক ন্যায়বিচার, সম্পদের সুষম বন্টন এবং সব মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির গ্যারান্টির জন্য দেশ স্বাধীন করেছিলাম বলেই স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে সামনে রেখে আমরা নিশ্চয়ই এসবের ভিত্তিতেই স্বাধীনতার অর্থময়তা ও ব্যর্থতার মূল্যায়ণ করব। সেখানে শাসকশ্রেণী তথা সব রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার সম্পর্ক বিদ্যমান।

কারাগারের দেয়ালগুলো সোনায় নির্মিত নাকি লোহার গরাদ কয়েদির কাছে তা বিবেচ্য বিষয় নয়। বন্দিত্বের যন্ত্রনা থেকে মুক্তির প্রত্যাশাই হচ্ছে কয়েদির কাছে মূল বিবেচ্য বিষয়। মানবাধিকারের গ্যারান্টি বঞ্চিত, ন্যায়বিচারের অধিকার থেকে বঞ্চিত কোনো সমাজ ও রাষ্ট্র কারাগারের চেয়ে ভাল স্থান নয়। গত ৫০ বছর ধরে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো পালাক্রমে দেশ শাসন করেছে। প্রত্যেক দলই যার যার মত করে দেশ এগিয়ে নেয়ার এবং উন্নয়নের জিগির তুলেছে। সময়ের গতিশীলতার সাথে সাথে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি নতুন নতুন অর্থনৈতিক খাতের বিস্তার ঘটেছে। এসব তো এক প্রকার উন্নয়নই। তবে যে প্রত্যাশাকে সামনে রেখে দেশের মানুষ ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আন্দোলন করেছিল, ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিল, ১৯৭১ সালে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল এবং ৮ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ৯০ সালে গণতন্ত্রের মুক্তির লক্ষ্যে দেশে একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল, সেই প্রত্যাশা ও লক্ষ্য থেকে আমরা কি আগের চেয়ে অনেক পিছনে বা দূরে সরে গেছি? এই প্রশ্নই এখন জাতির জন্য অনেক বড় আত্মশ্লাঘার বিষয়। এখানেই জাতির সামনে একরাশ হতাশার কালোমেঘ ঘুরপাক খাচ্ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি সমাজকে গ্রাস করে চলেছে। অবক্ষয়, সন্ত্রাস-লুন্ঠন, অপমৃত্যু ও দখলবাজি মহামারি আকারে বিস্তার লাভের এই প্রক্রিয়ার মধ্যে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারি কোনো ঘটনায় প্রভাবশালী কেউ কেউ গ্রেফতার হলে সেটাই যেন বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম হিসেবে সংবাদ শিরোনাম হয়। আর এই বিচ্ছিন্য-ব্যতিক্রমী ঘটনার দিকে আঙুল তুলে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বলেন, বিচার হচ্ছে, কেউ রেহাই পাবে না। প্রভাবশালী মহল এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপরাধ প্রবণ সদস্যদের দ্বারা হাজার হাজার জুলুম-অবিচারের ঘটনার মধ্য থেকে দু’একটার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ বিরল। এ কারণে অপরাধিরা আরো বেপরোয়া হয়ে সাধারণ মানুষের উপর স্টিমরোলার চালিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ার প্রতিযোগিতাকে মোক্ষ লাভের উপায় বলে নির্ধারন করে নিয়েছে। খালেদ, জিকে শামিম, ইসমাইল স¤্রাট থেকে এ সপ্তাহে ধরা পড়া পাপিয়া পর্যন্ত তাদের বেড়ে ওঠার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ক্ষমতার আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে থেকে সাধারণ মানুষের জন্য টর্চার সেল গড়ে তোলার বিচারহীনতার ধারাবাহিক ইতিহাসই উঠে আসে। এরপরও ব্যতিক্রমী দু’একটা ঘটনায় সমাজে ও রাজনীতিতে প্রভাবশালী মহলের কারো কারো হাতে হাতকড়া লাগার দৃশ্য মানুষকে কিছুটা হলেও আশ্বস্ত ও আশান্বিত করে। দেশে ন্যায়বিচার ও সুশাসন থাকলে এমন হাজার হাজার প্রভাবশালীর হাতে হাতকড়া পড়বে। এটাও মনে রাখা দরকার যে দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার থাকলে এমন শত শত গডফাদার, লুন্ঠনবাজ, অর্থপাচারকারি দানবীয় শক্তির উত্থান সম্ভব হতো না। রাজনৈতিক পদপদবি ও ক্ষমতার মোড়কে এ বিচারহীনতার সুৃযোগ কাজে লাগিয়ে মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত ও জিম্মি করে কর্পদকশুণ্য ব্যক্তিরা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে রাজকীয় জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। নরসিংদীর যুব মহিলা লঘি নেত্রির গডমাদার হয়ে উঠার কাহিনী তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল সম্প্রতি দেশের রংপুরে আয়োজিত এক সমাবেশে বলেন, মানুষ এখন আর ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করে না। অর্থাৎ ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা থেকে বঞ্চিত হতে হতে মানুষ এখন ন্যায়বিচারের আশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি মাৎস্যন্যায়ের সমাজ কায়েম করে চলেছে। বিচারহীনতার উদাহরণ হিসেবে সুলতানা কামাল সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকান্ডের বিচারের চলমান বাস্তবতার কথা উল্লেখ করেছেন। আট বছর আগে নিজেদের ফ্লাটে আততায়ির হাতে নিহত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনী নিহত হওয়ার পর দেশের সাংবাদিক সমাজ খুনীদের গ্রেফতারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে খুনীদের গ্রেফতারের প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। এবং প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই হত্যামামলার অগ্রগতির উপর নজর রাখছেন বলে জানিয়েছিলেন। সাগর-রুনী হত্যাকান্ডের ৮ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো মামলার তদন্ত রিপোর্ট তথা চার্জশিট জমা দিতে পারেনি পুলিশ। আদালতে তদন্ত রিপোর্ট জমাদানের তারিখ ইতিমধ্যে ৭২ বার পেছানো হয়েছে। সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনী নিহত হওয়ার পর তার বাসা থেকে তেমন কোনো টাকা-পয়সা বা মূল্যবান সম্পদ খোঁয়া যায় নি। শুধুমাত্র দু’টি ল্যাপটপসহ কম্পিউটার ডিভাইস খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা ছিল মনে প্রানে সংবাদকর্মী। সাগরসারওয়ারের অনুসন্ধানি প্রতিবেদনের কিছু অপ্রকাশিত স্ক্রিপ্ট ও ভিডিও সে সব কম্পিউটারে সংরক্ষিত ছিল বলে কথিত আছে। এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে সে অনুসন্ধানী রিপোর্টের নেপথ্যে যারা বা যাদের নাম জড়িয়ে আছে তারাই হয়তো এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত। এটা একটা সরল হিসাব। এর বাইরে ভিন্ন কিছুও থাকতে পারে। সেটা তদন্তে বেরিয়ে আসার কথা। কিন্তু আট বছরেও তদন্ত রিপোর্ট আদালতে জমাদানে ব্যর্থতার পেছনের রহস্যই যেন এখন তদন্তের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওরা কারা, যারা নিজেদের মুখোশ রক্ষায় শিশু সন্তানের সামনে সাংবাদিক পিতা-মাতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে? সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কে সউদি কনসুলেট ভবনে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসি সউদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় সারাবিশ্বে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। সে ঘটনায় সোচ্চার মার্কিন প্রশাসনকে ম্যানেজ করতে কোটি কোটি ডলারের গোপন লেনদেন হয়েছে বলে নানা মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। এরপরও জামাল খাশোগি হত্যার বিচার থেমে থাকেনি। সউদি রাজপরিবারের সাথে ঘনিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন। মার্কিন সা¤্রাজবাদের ভিত্তি ধসিয়ে দেয়া সাংবাদিক, উইকিলিক্স প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বা এডওয়ার্ড ¯েœাডেন রাষ্ট্রশক্তির জুলুমের ভয়ে দেশান্তরি হলেও সাগর-রুনীর মত নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হতে হয়নি। হত্যাকান্ডের শিকার হওয়ার পর দুই বছরের মধ্যেই জামাল খাশোগি হত্যার বিচার পরিনতি লাভ করলেও সরকারের পক্ষ থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে খুনিদের ধরে বিচারের সম্মুখীন করার প্রতিশ্রæতি দেয়ার ৮ বছর পরও সাগর-রুনী হত্যাকান্ডের তদন্ত রিপোর্টও জমা হয়না! ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি, নারায়নগঞ্জের ৭ খুনের ঘটনায় প্রভাবশালী মন্ত্রীর জামাতাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিরা জড়িত। সে ঘটনাও ধামাচাপা থাকেনি। সাগর-রুনী হত্যার নেপথ্যের ব্যক্তিরা কি এর চেয়েও উপরের প্রভাবশালী? অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের ভাষ্য মতে, সাগর-রুনীর পরিবার এখন আর ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করেন না। মানুষ এখন কথা বলতেও সাহস পায় না। সাহস করে সত্য কথা বলার নামই স্বাধীনতা। যে কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে এবং আইনের শাননে মানুষের এই অধিকারের নিশ্চয়তা থাকে। মুজিব বর্ষে এসে আমরা এই বিচারহীনতা, সাহসহীন বন্দিত্বের প্রশ্নে নতুন প্রজন্মমের জিজ্ঞাসার কি জবাব দিব আমরা?

মুজিব বর্ষ শেষে দেশের মেগা অবকাঠামো প্রকল্পগুলো দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। দেশের প্রতিটা ঘরে বিদ্যুৎ পৌছে দেয়া হবে। লাখ লাখ নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা হবে। মধ্য আয়ের দেশের কাতারে সামিল হবে বাংলাদেশ, ইত্যাদি সবই ইতিবাচক ও আশান্বিত হওয়ার মত প্রতিজ্ঞা। কিন্তু সমাজের মানুষ হিসেবে, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে এবং গণতান্ত্রিক বিশ্ব সম্প্রদায়ের অংশিদার হিসেবে আমাদের জন্য এর চেয়েও বহুগুন প্রত্যাশিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সামাজিক-রাজনৈতিক বৈষম্যমুক্ত, মানবাধিকারের গ্যারান্টি ও ন্যায়বিচারের নিশ্চিত করার মত রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। আজকে যে সর্বব্যাপী অর্থনৈতিক লুন্ঠন, স্টেট ব্যাংক সব ধরনের ব্যাংক লুট, ব্যাংক নালিকদের জনগনের জামানত লুট, ভূমি ধ্বস ঋণ খেলাপী, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচারের মচ্ছব, মাদকের বিদ্ধংসী বিস্তার এবং আইনের পোশাক পরা একশ্রেণীর ব্যক্তিবর্গের বেপরোয়া অপরাধের আড়ালে বিচারের সব রাস্তা রুদ্ধ হওয়ার চিত্র দেখা যাচ্ছে, কোনো অর্থনৈতিক বা অবকাঠামো উন্নয়ন দিয়ে সে অন্ধকারের কলঙ্ক দূর করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুজিব বর্ষে নানা প্রতিশ্রæতির পাশাপাশি অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরছেন, দুর্নীতি বিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিচ্ছেন, কিন্তু মানুষ যেন আশান্বিত হতে পারছে না। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পুনরাবৃত্তির পরও থানার ওসির কোটি টাকা মাসিক ইনকামের খবর প্রকাশিত হয়, যুব মহিলা লীগের একটি জেলা কমিটির নেত্রির টর্চার সেল, রঙ্গশালা, কোটি কোটি টাকা পাচার ও অস্ত্র ও মাদকের আখড়ার সন্ধান কদাচিৎ বেরিয়ে আসে। দেশে অনুসন্ধানি সাংবাদিকতা থাকলে হয়তো র‌্যাবের অভিযান বা গোয়েন্দা তথ্যের আগেই এমন অসংখ্য রিপোর্ট বেরিয়ে আসতো। রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতির লালন এবং সাংবাদিকের জীবননাশ ও কলম স্তব্ধ করে দেয়ার ধারাবাহিক হুমকির মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে বর্বরতার অন্ধকারে ঠেলে দেয়া হয়েছে। মেগা অবকাঠামো উন্নয়ন, গ্যাস-বিদ্যুতের সুযোগ বৃদ্ধি, মেট্টোরেল বা পদ্মাসেতুর চেয়ে মানুষের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, আইনের শাসন ও সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গত এক দশকে দেশের মানুষ তথাকথিত উন্নয়ন অনেক দেখেছে। ডিজিটালাইজেশনের সুফলও পাচ্ছে। কিন্তু মাদক ব্যবসায়ী কোটিপতি ওসি, এসপি, ডিআইজি প্রিজন, খালেদ মাহমুদ, মক্ষীরাণী পাপিয়া, স¤্রাটদের মত জুয়াড়ি মাদক ব্যবসায়ী রাজনৈতিক নেতা, তুফান সরকার বদরুলের মত ধর্ষকদের দৌরাত্ম্যে আতঙ্কের সমাজে কোনো উন্নয়নই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বা অর্থবহ নয়। আমরা যখন দেশকে এগিয়ে নেয়ার দাবি করছি তখন দেশের লাখ লাখ যুবক জীবনের ঝুকি নিয়ে বৈধ-অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। দেশের অর্থনীতির হয়তো সিঙ্গাপুরের চেয়েও সম্ভাবনাময়। কিন্তু দেশের হাজার হাজার তরুণ বিভিন্ন দেশের কারাগারে ধুঁকে ধুঁকে মরার পরও প্রতিদিন অসংখ্য যুবক দেশ ছাড়ছে কেন? ইরাক,সিরিয়া, লিবিয়া থেকে সে সব দেশের লাখ লাখ মানুষ পালিয়ে গেলেও হাজার হাজার বাংলাদেশি তরুণ দেশে ফেরার চেয়ে এখনো সে সব দেশকেই যেন বেশি নিরাপদ মনে করছে। বিভিন্ন দেশের কোস্টগার্ডের হাতে আটক, সমুদ্রে ভাসমান, ঝড়ে হতাহত অথবা ডেসপারেট মাইগ্রেন্টদের মধ্যে প্রায়শ উঠে আসছে বাংলাদেশিদের নাম। এভাবেই বিশ্বের সামনে আমাদের উন্নয়নের দাবিগুলো অর্থহীন হয়ে পড়ছে। সর্বাগ্রে মানুষের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা, কথা বলার অধিকার, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করার অধিকার, লেখার অধিকার, রাষ্ট্রীয় ও আইনগত সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার, ন্যায়বিচার তথা সুশাসন নিশ্চিত করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো ও আধুনিক জীবনযাত্রার মানদন্ডে দেশ অনেক এগিয়েছে। সেই সাথে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির কারণে সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, মানুষের নিরাপত্তা ও আইনের শাসনে আমরা অনেক বেশি পিছিয়ে গেছি। এই বাস্তবতা সামনে রেখে মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে আমাদের গর্ব ও অহঙ্কারের সবকিছুকেই ¤øান করে দিচ্ছে। রাজনৈতিক অসততা ও অস্থিরতা ঘুঁচিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার পাশাপাশি দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির মূলোৎপাটনের সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসন এবং গণতান্ত্রিক-মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের পথ উন্মুক্ত করাই হোক মুজিববর্ষের মূল অঙ্গীকার।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মুজিববর্ষ

২০ এপ্রিল, ২০২১
১৭ ডিসেম্বর, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন