Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

পণ্য পরিবহনে পিছিয়ে রেল

২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ লাখ ৬ হাজার টন কন্টেইনার পরিবহন

নূরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১ মার্চ, ২০২০, ১২:০১ এএম

কয়েক বছর ধরেই বাড়ছে রেলওয়ের যাত্রী পরিবহন। এর মধ্যে ট্রেনে ভ্রমণের ভাড়াও দুই দফা বাড়ানো হয়েছে। এতে রেলের আয় প্রতি বছরই বাড়ছে। তবে লাভজনক হলেও রেলপথে পণ্য পরিবহন আশানুরূপ বাড়েনি। এতে করে খুব একটা বাড়েনি এ খাতের আয়। আবার আয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতি বছর ব্যয় বাড়ছে রেলের। এর প্রভাবে প্রতি বছর রেলের লোকসান বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, লোকসান কমাতে রেলে পণ্য পরিবহন আরও বাড়ানো উচিত। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনার পরিবহন বাড়ালে রেলেও লাভবান হতো অন্যদিকে মহাসড়কেও চাপ কমতো। 

১৯৮৭ সাল থেকে কনটেইনার পরিবহন শুরু করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকার কমলাপুর আইসিডির (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) মধ্যে কনটেইনার পরিবহন করছে সংস্থাটি। ২০১৬-১৭ অর্থবছর ৭ লাখ ৪২ হাজার টন কনটেইনার পরিবহন করেছে রেলওয়ে। পরের অর্থবছর (২০১৭-১৮) কনটেইনার পরিবহন কমে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৮১ হাজার টনে। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেলে ৭ লাখ ৬ হাজার টন কনটেইনার পরিবহন হয়েছে।
রেলওয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দেশের অভ্যন্তরে যত কনটেইনার পরিবহন হয়, তার মাত্র ৪ থেকে ৫ শতাংশ রেলপথে পরিবহন হচ্ছে। কনটেইনার পরিবহনে রেলপথ মন্ত্রণালয় কনটেইনার কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (সিসিবিএল) নামে স্বতন্ত্র একটি কোম্পানি গঠন করলেও এখনো কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
গত ৯ বছরে রেলওয়ে লোকসান গুনেছে আট হাজার ২৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৮ সালসহ আগের দুই বছরে লোকসান অনেক বেড়ে যায়। রেলওয়ের তথ্যমতে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে রেলওয়ের লোকসান ছিল ৫৮৪ কোটি টাকা। পরের দুই অর্থবছর তা বেড়ে হয় যথাক্রমে ৭৪৫ ও ৮৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১২-১৩ অর্থবছরে রেলের ভাড়া বাড়ানো হয়। এতে আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় সে অর্থবছর রেলের লোকসান কমে দাঁড়ায় ৬৩৩ কোটি টাকা। পরের দুই বছর সংস্থাটির লোকসান কিছুটা ধীরে বাড়ে। এতে ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছর রেলের লোকসান হয় যথাক্রমে ৬৮০ কোটি ও ৭৪৭ কোটি টাকা।
এর পরের অর্থবছরই রেলের লোকসান এক লাফে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। সে বছর এক হাজার ২০২ কোটি টাকা লোকসান গুনে রেলওয়ে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মাঝামাঝি রেলের ভাড়া গড়ে সাড়ে সাত শতাংশ বাড়ানো হয়। এর পরের অর্থবছর রেলওয়ে লোকসান গুনেছে এক হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি লোকসান গুনে এক হাজার ৪৩২ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে রেলওয়ে আয় করে ৬৭৩ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪৭ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছর রেলের আয় কমে দাঁড়ায় ৭২৬ কোটি টাকা। তবে ভাড়া বাড়ানোর প্রভাবে ২০১২-১৩ অর্থবছর রেলের আয় প্রায় ২০০ কোটি টাকা বেড়ে যায়। সে বছর সংস্থাটির আয় দাঁড়ায় ৯২৯ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর তা আবার কিছুটা কমে ৯২২ কোটি টাকায় নেমে যায়।
২০১৪-১৫ অর্থবছর প্রথমবারের মতো রেলের আয় দাঁড়ায় এক হাজার ৬১ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর তা আবার কমে দাঁড়ায় এক হাজার ২৭ কোটি টাকা। তবে নতুন কোচ-ইঞ্জিন সংযোজনের পর ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছর রেলের ট্রেন ও বগির সংখ্যা বেড়েছে। এতে যাত্রী সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। এর প্রভাবে দুই অর্থবছরে সংস্থাটির আয়ও অনেক বাড়ে। এ দুই অর্থবছর রেলওয়ে আয় করে যথাক্রমে এক হাজার ৪৪৫ কোটি ও এক হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা।
রেলওয়ের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, রেলের আয়ের উৎসগুলোর মধ্যে প্রধান হলো যাত্রী ও পণ্য পরিবহন। পণ্য পরিবহনের মধ্যে রয়েছে কনটেইনার, জ্বালানি তেল, খাদ্যশস্য ও সার পরিবহন। এ খাতে আয়ও অনেক বেশি। তবে যাত্রী পরিবহনকেই বেশি গুরুত্ব দেয় রেলওয়ে। পক্ষান্তরে পণ্য পরিবহনে গুরুত্ব দেয়া হয় না বললেই চলে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় কন্টেইনার ট্রেন চলে। সে ট্রেন চালানো হয় ৬৬ বছরের পুরাতন ইঞ্জিন দিয়ে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ ইঞ্জিনগুলো প্রায়ই বিকল হয়ে যায়। কন্টেইনার পরিবহনের রেকগুলোও অতি পুরাতন। সঠিক পরিচর্যার অভাবে প্রায়ই সেগুলো লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। এতে করে সঠিক সময়ে মালামাল কমলাপুরে এসে পৌঁছায় না। তাতে রেলের প্রতি আস্থা হারিয়ে ব্যবসায়িরা সড়কপথেই মালামাল পরিবহনে বেশি আগ্রহ দেখান।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, দেশে যত পণ্য পরিবহন হয়, তার ৮০ শতাংশই হয় সড়কপথে। আর নৌপথে ১৬ ও রেলপথে পরিবহন হচ্ছে ৪ শতাংশ পণ্য। অন্যদিকে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বন্দরের ৯৪ শতাংশ পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে সড়কপথে। রেলপথে পরিবহন হচ্ছে মাত্র ৬ শতাংশ। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের হিসাবে, প্রায় ১০ শতাংশ পণ্য পরিবহন হচ্ছে নৌপথে।
তবে চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য পরিবহন ব্যবস্থাটি পুরোপুরি সড়কনির্ভর। এতে সড়কের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে। যানজটের পাশাপাশি সড়কের আয়ুও কমে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় সড়কের বদলে পণ্য পরিবহনে রেল ও নৌপথকে প্রাধান্য দেয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে গত বছর ৩১ লাখের মতো একক কনটেইনার ওঠানামা হয়েছে। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চট্টগ্রাম বন্দরের ৯৪ শতাংশ পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে সড়কপথে, মূলত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। পণ্য পরিবহনে সড়কপথের এই প্রাধান্যে একদিকে যেমন দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন হিসেবে খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দেখা দিচ্ছে তীব্র যানজট, তেমনি বন্দরে পণ্যজটেরও অন্যতম কারণ এটি। এমন পরিপ্রেক্ষিতে সড়কপথের ওপর চাপ কমাতে রেলপথে পণ্য পরিবহন ২০ শতাংশে উন্নীত করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে নৌ-পরিবহন সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, উন্নত দেশে পণ্য পরিবহনে রেল ও নৌপথকে গুরুত্ব দেয়া হয়। অথচ আমরা হাঁটছি উল্টোপথে। সড়কপথের ওপর চাপ কমিয়ে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার সিংহভাগই রেল ও নৌপথনির্ভর হিসেবে গড়ে তোলার পরামর্শ দেন তিনি। এতে করে পণ্য পরিবহন যেমন সহজ হবে তেমনি মহাসড়কের উপর চাপ কমে দুর্ঘটনাও কমবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রেল

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ