Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার?

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৫ মার্চ, ২০২০, ১২:০১ এএম

আমরা সকলেই কোনো না কোনোভাবে ক্রেতা বা ভোক্তা। আমরা জনসাধারণ প্রতিদিন বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করি। এ সকল দ্রব্যসামগ্রী আমরা নিজেদের কষ্টার্জিত টাকা খরচ করে ক্রয় করে থাকি। আমরা অনেকেই জানি না, বাজার থেকে আমরা যে সব দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করছি এসব দ্রব্যসামগ্রীর আদৌ গুণগত ও পরিমাণগত মান ঠিক আছে কিনা। বিষয়টি আমাদের আরো ভাবিয়ে তোলে যখন সংবাদপত্রে, ‘পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান-বিএসটিআই’র কোনো মান নেই’ শিরোনামে সংবাদ পড়ি।

একথা আমাদেরকে স্বীকার করতেই হবে যে, বিশ্বের প্রায় দেশেই ক্রেতা ও ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় কঠোর আইন প্রচলিত থাকলেও বাংলাদেশে সে ধরনের কোনো আইন নেই। সঙ্গতকারণেই বাজারে বিক্রেতাদের কাছে ক্রেতারা সব সময় অসহায় বা জিম্মি। বিভিন্ন সংবাদসূত্রে প্রকাশ, ট্যাং, স্যুপ, মাইলো, হরলিকসসহ হরেক রকম আমদানিকৃত রেডি ফুড জাতীয় পণ্যসামগ্রী ও তরল পানীয়সামগ্রীতে বাজার ছেয়ে গেলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের এ ব্যাপারে মাথা ব্যথা নেই। শুধু তাই নয়, এগুলোর সঠিক মান নিয়ন্ত্রণের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বিজ্ঞাপনের চমক সৃষ্টি করে বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি করে, ভোক্তাদের ঠেলে দিচ্ছে নানাবিধ জটিল রোগের কোলে। ফলে ক্রেতা কিংবা ভোক্তাশ্রেণি পয়সা দিয়ে রোগ-ব্যাধি কিনছে। কোথাও কোথাও মৃত্যুও ঘটছে পাইকারী হারে।

কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) দীর্ঘদিন থেকে নকল, ভেজাল, মানহীন-গুণহীন, পণ্যে বাজার ছেয়ে যাবার বিষয়ে অভিযোগ জানিয়ে আসলেও এর প্রতিবিধান হয়নি। এখানে উল্লেখ্য যে, মানহীন পণ্যসামগ্রীর মধ্যে বেশিরভাগ রেডি ফুড জাতীয় হওয়ায় সাধারণ ক্রেতা বা ভোক্তা এর গুণাগুণ কিছুতেই যাচাই-বাছাই করতে পারে না। অথচ বাংলাদেশ ছাড়া এশিয়ার সকল দেশেই ক্রেতাস্বার্থ সংরক্ষণের নিমিত্তে আইন আছে, রয়েছে বিশেষ আদালত। বাংলাদেশের ক্রেতা বা ভোক্তারা ব্যবসায়ীদের চাতুরী, প্রচারণা সর্বোপরি সংঘবদ্ধতার কাছে জিম্মি। দেশ স্বাধীনের এতটা বছর পরেও জনগণ অসাধু-দুর্নীতিপরায়ন কারবারীদের কাছে অসহায়। এটা কিছুতেই স্বাধীন জাতির গৌরবের বিষয় হতে পারে না।

একথাও ঠিক যে, দেশে উৎপাদিত এবং আমদানিকৃত খাদ্য, পণ্যসামগ্রী ও কাঁচামালের গুণগত মান, ওজনমান, নিয়ন্ত্রনকারী বিএসটিআই’র পরীক্ষা কার্যক্রম সঠিকভাবে চলছে না। খাবার পানি, ভোজ্যতেল, তরলখাদ্যসহ মানুষের জীবনের সাথে জড়িত প্রায় দেড়শ’টি পণ্যের ওজন ও গুণগতমান নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব এ প্রতিষ্ঠানটির ওপর ন্যস্ত। জনবলের অভাব দেখিয়ে এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সরঞ্জামের অভাব দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বারংবার পার পেয়ে যাচ্ছে। স্থানের অভাব সত্তে¡ও প্রতিষ্ঠানটিতে নাকি অতিরিক্ত আরও বেশ কিছু পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এতদসত্তে¡ও বিগত বহু বছর যাবত অনেক পণ্যের উৎপাদক একবার প্রতিষ্ঠানটিকে নমুনা দেখিয়ে লাইসেন্স ও প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করে পরবর্তীতে কাক্সিক্ষতমানের পণ্য উৎপাদন না করে, পণ্যের মানের ফলোআপ না করে দেশবাসীকে বঞ্চিত করে চলেছে। একথা কে না জানে যে, ক্রমবর্ধমান চাহিদা, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্যের মান ও গুণাগুণ যথাযথভাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার বিকল্প নেই। প্রগতিশীল বাণিজ্যিক বিশ্বে পণ্যদ্রব্যের সঠিক মানগুণ অটুট রাখতেই হবে। মানুষের পরিবর্তনশীল চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে উন্নতমানের ও নতুন নতুন ডিজাইনের নতুন নতুন পণ্যদ্রব্য উৎপাদন ও যোগান দেয়ার জন্য দ্রব্য গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন। গুণগত মানের উপর নির্ভর করে বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগী উৎপাদকরা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পাচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী শুরু হয়েছে তুমুল বাণিজ্যিক যুদ্ধ। সেখানে গবেষণা বিভাগ বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে নতুনত্বের সংযোজন ঘটিয়ে উন্নত মানগুণ সংরক্ষণপূর্বক নতুন পণ্যদ্রব্য উদ্ভাবন করে, অনেক সময় নতুন উৎপাদন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নিজেদের অবস্থান সুসংহত রাখার আয়োজনের শেষ নেই। এ প্রেক্ষিতে বলতেই হচ্ছে, ‘পণ্যের বা সেবার গুণগত মান’ বলতে কোনো জিনিষ এ সোনার বাংলায় আছে, একথা বিশ্বাস করার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। লক্ষ লক্ষ ক্রেতাকে ওজনে কম, খাদ্যে ভেজাল, জীবন রক্ষাকারী ঔষধে ভেজাল, নকল সার, নকল কারখানা, দুই নম্বরীকে এক নম্বর বলে চালানো বা এক নম্বরীর সাথে দুই নম্বরী মেশানো এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। চারিদিকে ভেজাল আর ভেজাল যেন ভেজালের দুনিয়া পণ্যের গুণাগুণ ও মান শিল্পোন্নয়ন, বাণিজ্য উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। ভোক্তা বা ক্রেতাদের গ্রহণযোগ্য যথোপযুক্ত পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও সরবরাহকরণ নিশ্চিত করতে না পারলে আভ্যন্তরীণ কিংবা বহির্বাণিজ্য এর কোনটিতে আমরা সফলতা অর্জন করতে পারবো না। দ্রব্যের সাইজ, রং, উপযোগিতা, গুণাগুণ, টেকসই ক্ষমতা, সংরক্ষণ, যোগ্যতা ইত্যাদি পণ্যমান সূচিতকরণ, জাতীয় স্বার্থেই আমাদের বজায় রাখতে হবে। অবাধ বাণিজ্যিক বিশ্বে নির্দিষ্ট মান বিশিষ্ট পণ্য ক্রেতাদের নিকট গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করে। তাই আমাদের উৎপাদনকারী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ভোক্তাদের নিকট সব দিক দিয়ে গ্রহণযোগ্য না হলে তারা বাজার হারাবে। কারণ, ভোক্তাই হলো পণ্যদ্রব্যের জীবনীশক্তি। কোনো প্রতিষ্ঠান স্বর্ণের জুতা তৈরি করলেও তা যদি ভোক্তাশ্রেণি ভোগ না করে তবে সে প্রতিষ্ঠানের মৃত্যু অনিবার্য। পণ্যের গুণগতমান ও সঠিক ওজন নিশ্চিত করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। গণতান্ত্রিক দেশে সরকারের দায়-দায়িত্ব আরো বেশি। আমাদের আফসোস, প্রতিটি সরকারই এ বিষয়টি কৌশলে কেন যে এড়িয়ে চলে তা বোধগম্য নয়। একথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে প্রতিটি সরকারই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বিদেশি পণ্যদ্রব্যের প্রতি ভোক্তাশ্রেণি একদিকে যেমন আকৃষ্ট হচ্ছে অপরদিকে বিদেশি পণ্যদ্রব্যে বাজার সয়লার হয়ে যাচ্ছে।

বর্তমান সময়ে সরকার ক্রেতাস্বার্থ সংরক্ষণ আইনটি বাস্তবায়নকল্পে অনেক দূর এগিয়েছে। আমরা আইনটির দ্রুত প্রয়োগের দাবি জানাই। একথাও সত্য যে, দেশে ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন ও ভোক্তা আদালত প্রতিষ্ঠিত হলেই রাতারাতি ভোক্তা অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে, এমনটি আশা করাও ঠিক হবে না। তবে এটাও সত্য যে, ভোক্তা স্বার্থ বা অধিকার সংরক্ষণের পথে প্রথম ও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো উক্ত আইন প্রণয়ন করা ও সংশ্লিষ্ট আদালত প্রতিষ্ঠা করা। এ প্রারম্ভিক কার্যটি সম্পাদিত হলেই কেবল প্রশ্ন আসবে আইনের সুষ্ঠু, অবাধ প্রয়োগ ও আদালতকে কার্যকর করা। মাটির উপরে যে শুয়ে থাকে তার পক্ষে নিচে পড়ে যাওয়া যেমন অসম্ভব, তেমনি আইন প্রবর্তন ছাড়া নাগরিক সচেতনা বৃদ্ধির কথা বলা একই অর্থ বহন করে। ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে আর হাঁটা যায় না। হাঁটতে হলে কদম উঠাতে হবে। এ সত্যটি ব্যবস্থাপক শ্রেণি উপলব্ধি করলেই অর্থনৈতিক মুক্তির পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবো আমরা।

আমাদের যাবতীয় উন্নতি-অগ্রগতি এক কথায় জ্ঞানী চাকরিজীবী তথা সরকারি আমলাদের হাতে বন্দি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত হচ্ছে জাতির ভাগ্য। কোনো কাজই যেন শেষ হয়েও হয় না। এখানে তেলের দাম আর ঘি’র দাম একই। বলা বাহুল্য, যে দেশের তেলের দাম আর ঘি’র দাম সমান, বুঝে নিতে হবে সে দেশের শাসন, প্রশাসন, বিচার, আইন, সরকার ও ব্যবস্থাপনায় যোগ্য ব্যক্তির পদচারণা নেই। স্বাস্থ্যবান লোক দেশ ও জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। খাদ্যে ও বিভিন্ন পণ্যে ভেজাল মিশিয়ে এ দেশের বিশাল মানবসম্পদকে শারীরিক, মানসিক ও দৈহিকভাবে নষ্ট করার যে হীন প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, এর ভিত এখনি মচকে ভেঙ্গে ফেলবার উৎকৃষ্ট সময় ও সুযোগ। গরিব রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের আয়োজনে সীমাবদ্ধতা থাকবেই। আমাদের আরজ এতে আমাদের ঐকান্তিকতা আন্তরিকতা, চেষ্টা-প্রচেষ্টা সর্বোপরি দেশ ও জনগণের প্রতি ভালোবাসা ও জবাবদিহির তো কমতি থাকার কথা নয়। দেশের জনগণকে মানসম্পন্ন পণ্যদ্রব্য পাবার ক্ষেত্রে আমাদের সুপ্রচেষ্টার যেন কমতি না হয়।



 

Show all comments
  • jack ali ১৫ মার্চ, ২০২০, ১১:২৫ এএম says : 0
    This is a disaster because our people don't fear Allah.. They have forgotten that they will live forever, they will never will never die...they will never face Allah in Judgement day----- main reason that we are muslim but our country is not rule by the Law of Allah...
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পণ্য

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন