Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন

শাহেদ নুর | প্রকাশের সময় : ১৭ মার্চ, ২০২০, ১২:০২ এএম

দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনের অনেকগুলো বছর কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধকার কুঠুরিতে। ফলে দূরে থাকতে হয়েছে পরিবার পরিজনের কাছ থেকে। পরিবারের সবাই বিষয়টি বুঝলেও অবুঝ শিশু শেখ রাসেল মনে করছিলো, কারাগারটাই তার ‘আব্বার বাড়ি’। বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন নিয়ে প্রকাশিত বই ‘কারাগারের রোজনামচা’য় তিনি সেই বিষয়টি লিখেছেন এভাবে, ‘১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না, যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই আব্বা আব্বা বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল, আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে আব্বার বাড়ি। এখন ওর ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি।’ (দিনটি ছিলো ১৯৬৬ সালের ১৫ জুন।)
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র বর্ণনা অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু প্রথম কারাগারে গিয়েছিলেন ১৯৩৮ সালে। তখন তিনি স্কুল ছাত্র ছিলেন। তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গোপালগঞ্জে আগমন উপলক্ষে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করার দায়িত্ব পড়েছিলো তাঁর ওপর। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে তিনি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেছিলেন। পরে দেখা গেলো, হিন্দু ছাত্ররা সেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে সরে গেলো। কারণ, কংগ্রেস থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগের সাথে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। সমাবেশ হয়ে যাওয়ার কিছুদিন পর হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে মারামারি হয়। এই ঘটনায় হিন্দুরা মামলা করে। সেই মামলায় গ্রেফতার হয়ে বঙ্গবন্ধুকে সাতদিন কারাগরে থাকতে হয়।
২০১৭ সালের ৭ মার্চ জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপরের আনা ধন্যবাদ প্রস্তাব সম্পর্কিত আলোচনায় প্রখ্যাত রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। এর মধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাত দিন কারা ভোগ করেন। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বানকালে জীবনের দ্বিতীয়বার ও পাকিস্তান আমলে প্রথমবারের মতো ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু। পাঁচদিন কারাবরণ করে মুক্তি পান ১৫ মার্চ। এরপর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সমগ্র দেশ সফর শুরু করে। এই সফরে থাকা অবস্থায় ফরিদপুরে ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর আবার গ্রেফতার হন তিনি। ১৩২ দিন কারাভোগের পর মুক্তি পান পরের বছর ২১ জানুয়ারি।
১৯৪৯ সালের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা তাদের ন্যায্য দাবিদাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে ধর্মঘটের ডাক দেয়। এসময় বঙ্গবন্ধু তাদের এই দাবির প্রতি সমর্থন জানান এবং তাদের পক্ষে আন্দোলনে অংশ নেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯ এপ্রিলে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। মুক্তি পান জুলাই মাসে। এরপর একইভাবে কয়েক দফায় গ্রেফতার হন এবং মুক্তি লাভ করেন। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল করে। কিছুদিন পরে অবশ্য তাঁর ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেয়া হয়।
ওই বছর ১৪ অক্টোবর আর্মানিটোলা ময়দানে আয়োজিত জনসভা থেকে দরিদ্র মানুষের খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিছিল বের করা হয়। মিছিল থেকে মওলানা ভাসানী, শামসুল হক ও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। এবারে তাঁকে (বঙ্গবন্ধু) প্রায় দুই বছর পাঁচ মাস কারাগারে থাকতে হয়। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদ মিছিলে গুলি চলে। এতে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেকে। জেল থেকে বঙ্গবন্ধু এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন এবং অনশনে যান। টানা অনশনে অসুস্থ বঙ্গবন্ধুকে স্বাস্থ্যগত কারণে ২৬ ফেব্রুয়ারি মুক্তি দেয়া হয়।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর ৩০ মে যুক্তফ্র্র্রন্টের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধু করাচি থেকে ঢাকায় ফেরার পর গ্রেফতার হন। ২০৬ দিন কারা ভোগ করে ২৩ ডিসেম্বর মুক্তি লাভ করেন। জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীর উপর আক্রমণ এবং তার মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা এবং সেনাবাহিনী প্রধান আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক আইন জারি করে সকল ধরনের রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এরপর ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। প্রায় চৌদ্দ মাস বন্দি থাকার পর মুক্তি পেলেও জেল গেটেই আবার তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬০ সালে ৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করে তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি আবারও গেফতার হয়ে মুক্তি পান ওই বছরের ১৮ জুন। এ দফায় তিনি কারাভোগ করেন ১৫৮ দিন। ১৯৬৪ ও ১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও আপত্তিকর বক্তব্য প্রদানের অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে তিনি ৬৬৫ দিন কারাগারে ছিলেন।
১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেওয়ার পর ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন শহরে আটবার গ্রেফতার হন এবং ছাড়া পান। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জে সভা শেষ করে ঢাকা ফেরার পর ৮ মে তিনি আবার গ্রেফতার হন। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। ১৮ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও জেলগেট থেকে আবার গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু। সেইবার তাকে রাখা হয় সেনানিবাসে। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবসহ সকল আসামীকে মুক্তি দেয়া হয়। এ সময় তিনি ১ হাজার ২১ দিন কারাগারে ছিলেন।
সর্বশেষ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও অনেক ত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। শেষ দফায় বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে থাকতে হয় ২৮৮ দিন।
২০১৭ সালের ২০ মার্চ দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধুর জেল জীবনের অজানা কাহিনি’ শিরোনামে বিশ্লেষক ও গবেষক আবদুল মান্নানের লেখা প্রবন্ধের তথ্যানুযায়ি, পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে বঙ্গবন্ধু ১৮ বার জেলে গেছেন। এসময় দুই বার তিনি মৃত্যুর মুখোমুখিও হয়েছিলেন।
লেখক: সাংবাদিক



 

Show all comments
  • আরমান ১৯ ডিসেম্বর, ২০২০, ৭:০৮ এএম says : 0
    ১৯৪৮ সালের ১১ মাচ্ কোন জাগা থেকে গ্রেফতার করা হয়
    Total Reply(0) Reply
  • আরমান ১৯ ডিসেম্বর, ২০২০, ৭:০৮ এএম says : 0
    ১৯৪৮ সালের ১১ মাচ্ কোন জাগা থেকে গ্রেফতার করা হয়
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মুজিব শতবর্ষ

২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১
১৮ মার্চ, ২০২০
১৭ মার্চ, ২০২০
১৭ মার্চ, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন