Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

করোনা সংক্রমণের পরীক্ষা হচ্ছে না বিশেষজ্ঞদের অভিমত

আইইডিসিআর একক কর্তৃত্ব দেখিয়ে দায়সারাভাবে কাজ করছে -ডা. কামরুল হাসান খান

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ২৫ মার্চ, ২০২০, ৯:০৯ পিএম

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের শনাক্তের পরীক্ষা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ডব্লিউএইচও’র সর্বশেষ উদ্বেগও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা শনাক্তে পরীক্ষা না হওয়া। সম্প্রতি ডব্লিউএইচও তাই উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, সব দেশের প্রতি আমাদের বলার বিষয় হচ্ছে ‘পরীক্ষা, পরীক্ষা, পরীক্ষা’। এর মানে হলো করোনা আক্রান্ত হিসেবে কাউকে সন্দেহ হলে প্রথম কাজ হলো পরীক্ষা করানো। ডব্লিউএইচও’র এই বার্তা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ইতোমধ্যে ৩৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশের জনঘনত্ব ও এখানকার মানুষের জীবনযাপনের ধরন বিবেচনায় নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞই বাংলাদেশকে উচ্চ ঝুঁকির দেশ হিসেবে বিবেচনা করছেন।

বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, দেশে করোনার লক্ষণ দেখে রোগীরা আইইডিসিআর’র ভীড় করছে। পাশাপাশি বিভিন্ন হাসপাতালে যাচ্ছে। কিন্তু যত সংখ্যক মানুষ পরীক্ষার জন্য যাচ্ছেন তার ১ শতাংশও পরীক্ষা হচ্ছে না। তাই লক্ষণ থাকা স্বত্তেও অধিকাংশ মানুষই বঞ্চিত হচ্ছেন করোনা শনাক্ত থেকে। যদিও শুধুমাত্র লক্ষণ থাকলেই করোনা আক্রান্ত এটাও বলার সুযোগ নেই। কারণ চীনে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের প্রতি তিনজনের একজন ছিলেন নীরব বাহক। আর ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে এদের সবারই ভূমিকা ছিলো। শরীরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ ছিল না কিংবা অনেক দেড়িতে প্রকাশ পেয়েছিল। ফলে অন্যরা তাদের সঙ্গে নির্ভয়ে মেলামেশা করার কারণেও ভাইরাসটি ছড়িয়েছে।

যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের ৮১ শতাংশের শরীরে হালকা লক্ষণ দেখা দেয়, যা অন্যান্য ভাইরাল জ্বরের মতো চিকিৎসায় ভালো হয়ে যায়। ১৪ শতাংশের শরীরে মাঝারি লক্ষণ এবং মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ গুরুতর অসুস্থ হচ্ছেন, যাঁদের বেশির ভাগই বয়স্ক ও অন্যান্য শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। আর তাই কে বা কার মধ্যে করোনার সংক্রমণ ঘটেছে এটা বুঝতে অবশ্যই করোনা শনাক্তে পরীক্ষা করানো দরকার। অন্যথায় একজনের মাধ্যমে অন্যদের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়িয়ে মহামারী আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে বিভিন্ন সময়ে চিকিৎসক ও সাংবাদিকরা করোনা সনাক্তে পরীক্ষা বাড়ানোর জন্য সরকারের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) পরিচালক প্রফেসর ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাকে পরামর্শ দিলেও তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি। আর তাই প্রতিদিন করোনা সনাক্তে শত শত লোকের আইইডিসিআরে ভীড় ও করোনা নিয়ে হটলাইনে প্রতি মিনিটে ১৮টির বেশি কল আসলেও অধিকাংশই থাকছেন সনাক্তের বাইরে। হটলাইন চালুর পর এ পর্যন্ত কল এসেছে ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৬৮৩টি। অথচ বুধবার (২৫ মার্চ) পর্যন্ত দেশে মাত্র ৭৯৪ জনের পরীক্ষা করা হয়েছে। করোনা সনাক্তের পরীক্ষা না হওয়ায় দেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সঠিক তথ্য উঠে আসছেনা বলেও মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি মানুষের মধ্যে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. কামরুল হাসান খান ইনকিলাবকে বলেন, প্রতিদিনই পরীক্ষা বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। কারণ লাখ লাখ মানুষ বিদেশ থেকে এসেছেন। তাদের পরীক্ষা না করালে সঠিক চিত্রটা উঠে আসবে না। সংক্রমণের সঠিক সোর্সও চিহ্নিত হবে না। এটা করতে না পারলে এবং পরীক্ষা বাড়াতে না বাড়ালে দেশব্যাপি করোনা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। প্রফেসর ডা. কামরুল হাসান বলেন, বিশ্বের অবস্থা ভালো নয়। তাই পরিকল্পিত কর্মসূচি নিয়ে আগাতে হবে আমাদের। অন্যথায় বাংলাদেশ ভয়ংকর পরিস্থিতির দিকে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আইইডিসিআর দায়সারাভাবে কাজ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বার বার পরীক্ষা বাড়ানোর কথা বললেও কর্ণপাত করছেন না তারা। এ পর্যন্ত মাত্র ৭৯৪ জন রোগীর পরীক্ষা করা হয়েছে।

প্রফেসর ডা. কামরুল হাসান বলেন, করোনার চেয়ে বড় সঙ্কট আর হতে পারে না। করোনা মোকাবেলায় আমাদেরকে সমস্ত সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। আইসিডিডিআর’বিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে এই সময়ে অবশ্যই কাজে লাগানো দরকার। কিন্তু আইইডিসিআর একক কর্তৃত্ব দেখিয়ে দায়সারাভাবে কাজ করছে বলে উল্লেখ করেন। আর এভাবে চললে দেশের মানুষকে বাঁচানো সম্ভব নয়। একই সঙ্গে হুমকি-ধামকি দিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইন করলে হবে না। কারণ আমাদের দেশে এটা কেউ মানবে না। এ জন্য অবশ্যই আমাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন বাড়াতে হবে। জনবল বাড়িয়ে আবারও পরীক্ষা বাড়ানোর তাগিদ দেন প্রফেসর ডা. কামরুল হাসান।

তবে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী অনেক বিচক্ষণ তাঁর ভাষনে অবশ্যই দেশের এই সংকটকলীন সার্বিক চিত্র এবং ভয়াবহতা উঠে আসবে। একই সঙ্গে দেশের স্বার্থে বাস্তবমুখী পদক্ষেপই তিনি নিবেন বলে উল্লেখ করেন প্রফেসর কামরুল হাসান।

সূত্র মতে, শুধু মার্চ মাসেই দেশে ৭ লাখের উপরে বিদেশ ফেরত মানুষ এসেছেন। গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে লকঢাউন ঘোষণার পর থেকে বাস, ট্রেন ও লঞ্চঘাটে ঘরমুখো মানুষের ভীড় বাড়ায় এক জনের মাধ্যমে অন্য জনের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি ছিল খুব বেশি। অথচ বুধবারের তথ্য অনুযায়ী দেশে নতুন করে করোনা আক্রান্ত রোগী নেই। যদিও এই সময়ে আক্রান্ত একজন মৃত্যুবরণ করেছেন।

এদিকে করোনা পরীক্ষার জন্য দেশের অন্যান্য ভাইরোলজি ল্যাবের সহযোগীতা নিচ্ছে না আইইডিসিআর। আইইডিসিআর’র একটি সূত্র জানিয়েছে, জনবল সঙ্কটের কারণে চাইলে অধিক পরীক্ষা করানো সম্ভব হচ্ছে না তাদের। তবে আইইডিসিআর’র মতোই সক্ষমতা আছে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ, বা আইসিডিডিআর,বি’র। আইইডিসিআর ৭টি ভাইরোলজি ল্যাবে পরীক্ষা করলেও সাহায্য নিচ্ছেনা আইসিডিডিআর,বি’র ৮টি ল্যাবের। আইসিডিডিআর,বি’র সাহায্য না নেওয়া প্রসঙ্গে আইইডিসিআর’র নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠনাটির পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার একঘুয়েমি দায়ী। তিনি চান না অন্য কারোর হাতে বিষয়টি থাকুক। তিনি এ সংক্রান্ত বিষয়টি নিজের হাতেই রাখতে চাচ্ছেন।

এদিকে করোনা পরীক্ষার জন্য ৩ টি পলিমারেজ চেইন রিএকশন (পিসিআর) মেশিন এবং ভাইরোলজি ল্যাব থাকা স্বত্তেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনা সংক্রান্ত কোন রোগীর পরীক্ষা, ভর্তি বা এই সব রোগীদের চিকিৎসাই নেই। বরং নতুন রোগী ভর্তি ও হাসপাতালের জরুরী সেবাও বন্ধ করে দিয়েছেল প্রতিষ্ঠানটি। যদিও অনেক সমালোচনার পর সীমিত পরিসরে জরুরী সেবা ও রোগী ভর্তি কার্যক্রম চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, করোনার পরীক্ষা অবশ্যই কম হয়েছে। তবে সরকার পরীক্ষা বাড়ানোর জন্য হয়তো পদক্ষেপ নিবে। দু’একদিনের মধ্যে হয়তো বোঝা যাবে। দেশের অন্যান্য ল্যাবেও করোনার টেষ্ট করা হবে। ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে। শিগগিরই কার্যকর করা হবে।

তবে আশঙ্কা প্রকাশ করে প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, পরীক্ষা আরও বাড়ানো দরকার ছিল। কারণ কয়েক লাখ বিদেশ ফেরত দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে যা আমাদের জন্য অত্যন্ত হুমকির। একই সঙ্গে বিদেশ ফেরতদের ছেড়ে দিয়ে সরকার ভুল করেছে। তারা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও এখন পুলিশ দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করছে সরকার। তবে খুব বেশি দেরি হয়ে গেছে। তাই অবশ্যই আমাদেরকে পরীক্ষা বাড়ানোয় জোড় দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

আইসিডিডিআরবি’র সহায়তা না নেওয়া প্রসঙ্গে ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, বিশেষ কারণে হয়তো সরকার তাদের সাহায্য নেয়নি। অনেক ব্যাপার হয়তো আছে সে জন্যই তাদের সহায়তা নেওয়া হয়নি। সরকার চাইলে তাদের সহায়তা নিতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।



 

Show all comments
  • Kawsar Mobarok ২৫ মার্চ, ২০২০, ১১:৩৮ পিএম says : 0
    আমার মনে হয় সরকার আনেক দেরি করে হলেও বুঝবে তখন বলে আর লাভ নেই ঝাহবার তাহয়ে জাবেই।
    Total Reply(0) Reply
  • Md Shahinur Alom ২৭ মার্চ, ২০২০, ৯:৫০ এএম says : 0
    যাদের করোনা ভাইরাস হয়েছে তাদের কি মেরে ফেলা হচ্ছে? না কি তাদের চিকিৎসা করা হচ্ছে?
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ