Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সবাইকে নিয়েই করোনা মোকাবেলা করতে হবে

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ৪ এপ্রিল, ২০২০, ১২:০১ এএম

ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে করোনা পরিস্থিতি। ভালো কোনো খবর আসছে না। আতঙ্ক এবং শঙ্কার খবরই বেশি। আমাদের দেশ এখন অনেক উষ্ণ ও আর্দ্র। অনেকে ভাবছেন, এই কারণে কোভিড-১৯-এর ব্যাপক সংক্রমণ এখানে ঘটবে না। কিন্তু বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা সতর্ক করে বলেছেন, এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার মতো পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত এখনো নেই তাদের কাছে। বেশ কয়েক বছরের বিভিন্ন ঋতুর উপাত্ত ছাড়া আবহাওয়ার সঙ্গে এ ভাইরাসজনিত রোগের যোগসূত্র বের করা সম্ভব নয়। তার ওপর তথ্য লুকানোর অভিযোগ ভর করেছে। সেইসঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে সাধারণ মানুষের সঙ্গে করোনায় ডাক্তার, নার্স এবং চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরাও আতঙ্কিত। এজন্য ভুগছে অন্য রোগীরাও। জ্বর বা করোনার লক্ষণ থাকলেই সবাই করোনা আক্রান্ত না। এছাড়া করোনা হলেই সবাই মরে না কিন্তু, হাসপাতালগুলো যেভাবে রোগী ফিরিয়ে দিচ্ছে, এতে শুধু করোনায় নয়, অন্য যেকোন রোগেও বিনা চিকিৎসায় মরণের আতঙ্কে পেয়েছে অনেককে। মানুষ মাত্রই মরণশীল। কিন্তু এমন মৃত্যু কেউ আশা করে না। এই মৃত্যুর দায় কে নেবে? করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির কী চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার নেই?

শুধু করোনার উপর সব দায় চাপিয়ে দেয়া আরেক অসুস্থতা। এর বিপরীতে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, করোনা দূরের কথা, সাধারণ সর্দিকাশি হলেও মানুষের মধ্যে তা লুকানোর প্রবণতা তৈরি হয়েছে। আবার অন্য কোনো গুরুতর রোগে পড়লেও এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে মানুষকে। ৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণার সিদ্ধান্তকে যা-ই বলা হোক, এছাড়া সরকারের করনীয় আর কিছু ছিলও না। পরিস্থিতি বিবেচনায় এই ছুটির মেয়াদ আরও কিছুদিন বাড়নো হয়েছে।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিতে ২৪ মার্চ থেকে সশস্ত্র বাহিনী নেমেছে। মাঠ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সশস্ত্র বাহিনী মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে মাঠে কাজ করছে। প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এমনকি ঘরে বসেই নামাজ আদায় ও প্রার্থনা করার অনুরোধ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, বিশ্বব্যাপী মহামারী মোকাবেলায় সাধারণত প্রতিরোধ, শনাক্তকরণ, দমন এবং প্রশমন- এই চার পর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

মানুষ যে রোগে চিকিৎসা নিচ্ছে না বা চিকিৎসা নিতে পারছে না, এর একটি দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। এরই মধ্যে করোনা-সংকটের মধ্যেই ডেঙ্গুর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন পরিবেশ ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। ডেঙ্গুতে গত বছর ভুগতে হয়েছে অসংখ্য মানুষকে। সরকারি হিসাবেই মারা গেছে ১৭৯ জন। বেসরকারি হিসাবে তিন’শতের মতো। এবার ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই অনেক মানুষ মারা পড়ছে করোনায়। এর ফাঁকে দুয়েকজন ডেঙ্গুতেও ভুগছে। এই পরিস্থিতিতে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির সমান্তরালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিলে চিকিৎসাব্যবস্থার জন্য সেটা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দেবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিকদের রক্ষার গ্যারান্টি না থাকলে রাষ্ট্রের সদিচ্ছা নিয়ে অভক্তি জাগে। তখন নিয়তিবাদী হয়ে পড়ে মানুষ। সমাজে নানা গুজবও ছড়িয়ে পড়ে। আধুনিক বিজ্ঞান থেকে ঝাড়ফুঁক-তুকতাক সবই চলছে। রাষ্ট্র যখন নাগরিকদের রক্ষার সুপরিকল্পনা দিতে ব্যর্থ হয়, যখন জনমনে রাষ্ট্রের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ থাকে, তখন নিরূপায় হয়ে পড়ে মানুষ। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের অনেকের রোজগার ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এই অসহায় শ্রমজীবীদের সুরক্ষা দিতে এখন পর্যন্ত ব্যাপকভিত্তিক কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

করোনার জেরে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদন খাত। বিদেশি ক্রয়াদেশ যেমন বাতিল ও স্থগিত করা হচ্ছে, তেমনি অভ্যন্তরীণ চাহিদাও কমছে। অবধারিতভাবেই কলকারখানায় উৎপাদন কমাতে হবে। তাহলে তো কলকারখানার শ্রমিকদের চাকরি ঝুঁকিতে পড়বে। দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ২৩ হাজার ৫৫৭টি কারখানায় কর্মীসংখ্যা ১১ লাখ ২৭ হাজার ৮৪১ জনের মতো। এ ছাড়া ১৬ হাজার ৬৮৯টি অতি ছোট কারখানায় কাজ করে ২ লাখ ৬৩ হাজার ৭২০ জন। আর ৩ হাজার ৩১টি বৃহৎ কারখানায় কাজ করে ৪০ লাখ ২৭ হাজার ১৪১ জন। এসব কারখানার বেশির ভাগই তৈরি পোশাক খাতের। এ ছাড়া মাঝারি আকৃতির কারখানার সংখ্যা ৩ হাজার ১৪টি। এসব কারখানায় ৪ লাখ ৬১ হাজার ১৪২ জন কাজ করে। করোনার ক্ষতি কাটাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণাটি অবশ্যই আশার বিষয়। এই তহবিলের অর্থ দিয়ে কেবল শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হবে। কিন্তু রিকশা-বাসচালক ও সহকারী, দোকানের সহকারী, হোটেল-রেস্তোরাঁর কর্মীদের মতো অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীদের জন্য কোনো টাকা বরাদ্দ নেই।

যেকোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় লাঠিপেটা বা চাপ নয়, জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়েই এই পথ পাড়ি দিতে হয়। মানুষ কেন চিকিৎসা থেকে দূরে থাকছে বা ছিটকে পড়ছে বিষয়টি ভাবনার দাবি রাখে। চরম সত্য হচ্ছে, দেশের সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে রোগী কমেছে। এমনকি চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারেও রোগীর তেমন ভিড় নেই। এটি তথ্য। অভিযোগ নয়। এ নিয়ে বিতর্কেরও কিছু নেই। নির্জলা বাস্তবতা হচ্ছে, করোনা সংক্রমণের ভয়ে মানুষ না পারতে হাসপাতালের পথ মাড়াচ্ছে না। দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের ঘোষণা প্রথম আসে ৮ মার্চ। এর ১০ দিন পর অর্থাৎ ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর তথ্য আসে। এরপরই চিকিৎসকদের সংক্রমিত হওয়ার ঘটনাগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। হাসপাতালেও রোগী কমতে থাকে। আবার ব্যক্তিগত সুরক্ষার নিশ্চয়তা না থাকায় ডাক্তারদের অনেকেও রোগী দেখা থেকে বিরত থাকছেন। সরকারি হিসাবে, ইতোমধ্যে চারজন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছেন। এছাড়া হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন বিভিন্ন হাসপাতালের প্রায় ৫০ জন চিকিৎসক। সংক্রমণের হার বাড়তে থাকলে অনেক চিকিৎসককে আইসোলেশনে যেতে হতে পারে। সব মিলিয়ে স্বাভাবিক দৈনন্দিন চিকিৎসা কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে।

অলৌকিকভাবে এ সমস্যার সমাধান আসবে ভাবলে ভুল হবে। সীমিত সক্ষমতার রোগতত্ত¡, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান- আইইডিসিআরের কাছে অতি প্রত্যাশাও ঠিক হবে না। সীমিতসংখ্যক টেস্টিং কিট দিয়ে বিপুল জনগোষ্ঠির পরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। বিদেশ প্রত্যাগতদের মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তাঁদের সংস্পর্শে আসা লোকদের আলাদা করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা অস্বীকারের কোনো জো নেই। সীমিত টেস্টিংয়ের কারণে আক্রান্তদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে, তাও স্পষ্ট। এ ছাড়া টেস্টিংয়ের অভাবে প্রকৃত আক্রান্ত ব্যক্তি ও মৃত্যুর যথাযথ পরিসংখ্যান না পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে। অভিযোগটির ফয়সালা করা উচিৎ। সরকারি, বেসরকারি খাত সবাইকে রোগটির সংক্রমণ বিস্তার রোধ ও চিকিৎসার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। সব বেসরকারি হাসপাতালে টেস্টিং ও চিকিৎসার অনুমতি দিতে হবে। জনস্বার্থে টেস্টিংয়ের ফলাফল, আক্রান্ত ও আরোগ্যের ফলাফলের তথ্যও জানানো উচিৎ। যে যতো কথাই বলুক, যতো সমালোচনাই করুক, নানান ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের দিকে আঙুল তোলা হোক এ যুদ্ধে সামনে থাকতে হবে সরকারকেই। আর ফ্রন্টলাইনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বিকল্প খোঁজার চেষ্টা হবে বৃথা। স্বাস্থ্য খাতের জন্য কোনো বিশেষ বরাদ্দ না থাকার জের এখন আমরা সইছি। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যসেবীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ, টেস্ট কিট, নতুন আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, হাসপাতাল সম্প্রসারণ ইত্যাদি কাজের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা প্রয়োজন। বরাদ্দ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অপচয় ও আত্মসাৎকারীদের দ্রুততম সময়ে বিচারের ব্যবস্থাও করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনা

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন