Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

স্বেচ্ছায় লকডাউন

সচেতন হচ্ছে মানুষ : ঝুঁকি এড়াতে ঢাকাসহ সারাদেশে বাড়ছে

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৮ এপ্রিল, ২০২০, ১২:০০ এএম

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ সদস্যরা সাধারণ মানুষকে ঘরে ফেরাতে যেখানে হিমশিম খাচ্ছেন, তখন ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় স্বেচ্ছায় লকডাউনে এগিয়ে আসছেন স্থানীয় তরুণরা। পাড়া, মহল্লা বা গ্রামে রাস্তা বন্ধ করে টাঙিয়ে দেয়া হচ্ছে হাতে লেখা নোটিশ। অনুরোধ করা হচ্ছে অপ্রয়োজনে যেন অন্য এলাকার লোকজন যেন এই এলাকায় না আসেন। একইভাবে স্থানীয় লোকজনকে জানানো হচ্ছে যেন জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বের না হন।
মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে সারাদেশে। শুরুতে এ নিয়ে সচেতন হওয়ার জন্য নানা নির্দেশনা দেয়া হলেও খুব একটা আমলে নেননি নাগরিকরা। তবে এখন ভয়াবহতা বুঝতে শুরু করেছেন তারা। কারণ কোথাও একজন রোগী শনাক্ত হলে পুরো বাসা বা এলাকা লকডাউন করে দিচ্ছে প্রশাসন। তাই ঝুঁকি এড়াতে নিজেরাই অঘোষিত লকডাউন শুরু করেছেন।

রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় এমন চিত্র দেখা গেছে। ঢাকার বাইরেও কিছু কিছু এলাকার জনসাধারণ এই পথে হাঁটছেন। খুব বেশি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে বাসা বাড়ি থেকে বের হতে দেয়া হচ্ছে না। অতিথি, গৃহপরিচারিকাদের আসা যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বেশিরভাগ এলাকায়। দেশে করোনার প্রকোপের শুরুর দিকে মিরপুরের টোলারবাগে একজন মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ২৩ মার্চ ওই এলাকা লকডাউন করে পুলিশ। পরে সেখানে আরও একজনের মৃত্যু হলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেখানে লকডাউন করা হয়। ইতিমধ্যে দেশের অনেক জায়গায় এটা হয়েছে।

নিজ উদ্যোগে ‘লকডাউন’ করা লোকজন বলছেন, একজন করোনা আক্রান্ত হলে পুরো এলাকা বা ভবন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আসা যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। তাই আগেভাগেই নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে যাতে করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে নিরাপদে থাকা যায়। কোনো কোনো এলাকার তরুণদের দিয়ে অনানুষ্ঠানিক কমিটি করে এসব কার্যক্রম পরিচালিত করা হচ্ছে বলেও জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর বসুন্ধরা, মুগদা, ওয়ারীসহ কিছু এলাকার বাসা-বাড়ি লকাডাউন করেছে প্রশাসন। আইইডিসিআরের নির্দেশনায় এটা করা হয়েছে। তবে এর বাইরে বনশ্রী, শান্তিনগরের কিছু অ্যাপার্টমেন্ট নিজেরাই লকডাউন করেছে এলাকাবাসী। এছাড়া যশোর, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, কেরানীগঞ্জেও সচেতন মানুষজন স্বেচ্ছা লকডাউন করে গ্রাম বা এলাকায় প্রবেশের রাস্তায় আড়াআড়ি কাঠ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে। এর আগে পার্বত্য অঞ্চলে বেশ কিছু এলাকা সেখানকার অধিবাসীরা নিজেরাই সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেয়। যাতে করে কোনো লোকজন বাইরে থেকে যাওয়া আসা করতে না পারে সেজন্য এমন ব্যবস্থা নেয়া হয়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর বনশ্রী আবাসিক এলাকা মধ্যরাত পর্যন্ত সরগরম থাকতো। এখন সন্ধ্যার মধ্যেই পুরো এলাকা নীরব হয়ে যাচ্ছে। সব বাসার গেটে তালা। বাসায় আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে কঠোরতা। এলাকার লোকজনদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে, কোন আত্মীয়-স্বজন যেন বাসায় না আসে। সব সময় গেট তালা দিয়ে রাখতে। খুব জরুরি কাজ ছাড়া বাসার লোকেরাও যাতে বাইরে যেতে না পারে এবং বাইরের লোকেরাও বাসায় প্রবেশ করতে না পারে তার কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে। এসব এলাকায় প্রয়োজনীয় কেনাকাটায় সহায়তা করছেন নিরাপত্তারক্ষীরা। তবে লোকজনের চলাফেরা কম থাকায় চুরি-ডাকাতি যাতে না হয় সেজন্য নিরাপত্তাকর্মীদের সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।

এদিকে নিজ উদ্যোগে লকডাউন করা হয়েছে শান্তিনগরের ইস্টার্ন পয়েন্ট। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বের হতে পারছেন না অ্যাপার্টমেন্ট থেকে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ যাতে বাসার বাইরে না যায় সেজন্য বাড়ির মালিক কমিটি নির্দেশনা দিয়েছে। এখন সবাই তা মানছেন। ওয়ারীতেও বিভিন্ন রাস্তার মুখে বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে ‘স্বেচ্ছায় লকডাউন’ সাইনবোর্ড লাগানো দেখা গেছে। মানুষের এই সচেতনতার প্রশংসা করেছেন অনেকেই। এমনকি লক ডাউনের মধ্যেও যারা পড়েছেন তারাও এমন উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন।

এদিকে, ঢাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন এলাকার গ্রামে-গঞ্জে এরকম স্বেচ্ছা লকডাউনের খবর পাওয়া গেছে। যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার দোহাকুলা ইউনিয়নের বোয়ালিয়া ও নওয়াপাড়া গ্রামকে গত সোমবার লকডাউন ঘোষণা করেছে স্থানীয় যুবকরা। গ্রামের মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখতে নিজেরাই লকডাউনের ঘোষণা করেন তারা।
জানা গেছে, গ্রাম দুটির ছয়টি প্রবেশ পথে বাঁশ দিয়ে ফটক তৈরি করে বাধা দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে গ্রামজুড়ে ছিটানো হয়েছে জীবাণুনাশক। প্রবেশ পথে রাখা হয়েছে হ্যান্ডস্যানিটাইজার। বাইরের এলাকার কাউকেই ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না তাদের গ্রামে। আবার যৌক্তিক কারণ ছাড়া কাউকে গ্রাম থেকে বের হতে দেয়া হচ্ছে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় দোহাকুলা ইউপি চেয়ারম্যান আবু মোতালেব তরফদার বলেন, প্রতিদিন বাইরের লোকজন এই দুই গ্রামে এসে ভিড় করছে। আড্ডাবাজি করছে। এটা আমাকে জানায় কয়েকজন যুবক। আমি তাদেরকে বলেছি বাইরের লোকজন প্রবেশ বন্ধ করে দিতে।

ঢাকার অদূরে কেরাণীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায়ও এরকম স্বেচ্ছা লকডাউন করা হয়েছে। চট্টগ্রামের দক্ষিণপ্রান্তে ডলুনদীর তীরবর্তী ডলুক‚ল গ্রাম কিশোর-তরুণরা লকডাউন করে দিয়েছে। গ্রামের প্রবেশমুখে বাঁশ দিয়ে প্রতিরোধ তৈরি করা হয়েছে। এ ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে। সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার কালাইউরা গ্রামও স্বেচ্ছায় লকডাউন করেছেন স্থানীয় যুবকরা। খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার মামুদকাটী গ্রাম লকডাউন করা হয়েছে। গ্রামের প্রতিটা প্রবেশদ্বারে করোনাভাইরাস প্রতিরোধকল্পে কাজ করে যাচ্ছে অনির্বাণ লাইব্রেরির স্বেচ্ছাসেবকরা। চলাচল নিয়ন্ত্রণ, জীবাণুনাশক স্প্রের পাশাপাশি চলছে সচেতনতামূলক কার্যক্রম।

চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বটতলী, বৈরাগ, বারখাইন,রায়পুর ও বারশত ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে স্বেচ্ছায় নিজ নিজ বাড়ী লকডাউন করেছে এলাকার সচেতন জনগণ। মহামারি করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে সরকারের পাশাপাশি নিজেদের দায়িত্ববোধ থেকে গত সোমবার থেকে এ উদ্যোগ নেয় তারা। বটতলী ইউনিয়নের ছিরাবটতলী গ্রামের কাজী বাড়ী, মুকিম আলী নাজির বাড়ি, বারখাইন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ঘাটা, বৈরাগ ইউনিয়নের খাঁন বাড়ী সড়কসহ কয়েকটি বাড়ী, বারশত ইউনিয়নের গুন্দিপ পাড়ায় নিজেদের বাড়ী সমাজের লোকজন নিজেরাই লকডাউন করে দিয়েছে। অনেক বাড়ীর সামনে গাছর গুড়ি ফেলে বহিরাগত লোকজনকে প্রবেশে বাধা দেয়া হচ্ছে। আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও বটতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এমএ মান্নান চৌধুরী জানান, সচেতন গ্রামবাসী নিজেদেরকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে যে উদ্যোগ নিয়েছে তা প্রশংসনীয়। এখন যার যার অবস্থান থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা এ প্রসঙ্গে বলেন, শুরু থেকেই নানাভাবে মানুষকে করোনার বিষয়ে সচেতন করার চেষ্টা করা হয়েছে। একটু সময় লাগলেও এখন মানুষ সচেতন হয়ে ঘরে থাকছে বা নিজেরাই মানুষকে ঘরে রাখার চেষ্টা করছে-এটা সবার সম্মিলিত চেষ্টার ফসল।



 

Show all comments
  • Mohammad Alam ৮ এপ্রিল, ২০২০, ৬:১৭ এএম says : 0
    গ্রামের দোকানগুলোতে এখনও জনসমাগম/আড্ডা চলছে সেদিকে একটু নজর দেওয়া উচিত।
    Total Reply(0) Reply
  • আবদুল মান্নান ৮ এপ্রিল, ২০২০, ৮:১০ এএম says : 0
    সত্য খবরের জন্য
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ