Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

চুরির আশঙ্কায় হাজার বছরের পুরনো বৌদ্ধমূর্তি সিলগালা

সর্ব সম্মতিক্রমে রাজগুরু বিহারাধ্যক্ষ নিয়োগের সিদ্ধান্ত

বান্দরবান থেকে মো: সাদত উল্লাহ, | প্রকাশের সময় : ১৩ মে, ২০২০, ৬:৫৭ পিএম

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষীয় বান্দরবান রাজগুরু বৌদ্ধ বিহারের (খিয়ংওয়াক্যং) বিহারাধ্যক্ষকে সকলের সম্মতিক্রমে নিয়োগ দানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও চুরির আশঙ্কায় হাজার বছরের পুরনো বৌদ্ধমূর্তি সিলগালা করার বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়ে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সোমবার বিকালে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ শহিদুল ইসলামসহ অন্যান্যরা মন্দিরে গিয়ে বুদ্ধমূর্তিটি সিলগালা করে দেন। সূত্র জানায়, রাজগুরু বিহার পরিচালনা কমিটির দ্বন্দ্বের কারণে প্রাচীনতম হাজার বছরের এই বুদ্ধমূর্তিটি বেহাত হয়ে যেতে সে আশঙ্কায় জেলা পরিষদ বান্দরবান শহরের রাজগুরু বৌদ্ধ বিহারে থাকা মূর্তিটি সিলগালা করে দিয়েছে। এঘটনায় স্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ও সচেতন মহল, বোমাং রাজ পরিবারের একাধিক সদস্য জেলা পরিষদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও এর বিরোধীতা করে করেছেন রাজগুরু বৌদ্ধ বিহার পরিচালনা কমিটির সভাপতি থোয়াইংচপ্রু মাস্টার। তিনি সাংবাদিকদের জানান, প্রাচীন বুদ্ধমূর্তিটি সিলগালা করে দেওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজ পরিবারের এক সদস্য জানান, রাজগুরু বিহারে ঐতিহ্য রক্ষা ও যেকোন বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সৃষ্টি রোধে জেলা পরিষদ যে উদ্যোগ নিয়েছে এইটিকে রাজ পরিবারের সদস্যরা স্বাগত জানায়। তিনি এই পদক্ষেপ গ্রহণ করায় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লাকে ধন্যবাদও জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ই মে পার্বত্য জেলা পরিষদে অনুষ্ঠিত্ব বৈঠকে উপস্থিত বিহার কমিটি, জেলার বিভিন্ন বিহারের বিহারাধ্যক্ষ ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নেতৃবৃন্দের মতামতের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এদিকে প্রয়াত উচহ্লাভান্তের মরদেহ চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার খৈয়াখালি ধর্মবিজয়ারাম বৌদ্ধ বিহার থেকে বান্দরবানে এনে যথাযথ বুদ্ধের রীতি অনুযায়ী শেষকৃত্য সম্পাদনের বিষয়ে প্রস্তুতি গ্রহণে এডহক কমিটি গঠন এবং জনমনে বিভ্রান্তি দূরীকরণ ও রাজগুরু বৌদ্ধ বিহারের স্থাবর-অস্থাবর পরিসম্পদ সুষ্ঠু সংরক্ষণের লক্ষে সার্বিক ব্যবস্থাগ্রহণের জন্য পর্যবেক্ষণ কমিটি করে দেয়াসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে জেলা পরিষদ। এই উদ্যোগটিকে প্রশংসা করেছেন জানিয়েছে পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বৌদ্ধ সমাজ ও স্থানীয় সচেতন মহল।
স্থানীয়রা সচেতন মহল মনে করেন, হাজার বছরের পুরোনো বুদ্ধমূর্তি রক্ষায় সিলগালা এবং সর্ব সম্মিতিক্রমে রাজগুরু বৌদ্ধ বিহারের বিহারাধ্যক্ষকে নিয়োগ দানে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা জেলায় একটি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার ঘটনা প্রতিরোধ করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ই মে রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়া ডাকবাংলা বৌদ্ধ বিহারে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয় রাজগুরু বিহার কমিটির সভাপতি থোয়াইংচপ্রæ মাস্টারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক এর কর্মকর্তা মংক্যশৈনু নেভী ও বাঙ্গালহালিয়া আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ভদন্ত ক্ষ্যামা থারা মহাথেরসহ কতিপয় ভান্তে ও শিষ্যরা। রাজগুরু বিহার কমিটির সবাইকে এবং বৌদ্ধ ভিক্ষু পরিষদ ও জেলার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সিনিয়র নেতাদের না জানিয়ে অত্যান্ত গোপনীয়তা অবলম্বন করে উক্ত গোপন বৈঠকে কৌশল অবলম্বন করে উচহ্লা ভান্তে মারা যাওয়ার পর রাজগুরু বৌদ্ধ বিহারের বিহারাধ্যক্ষ পদে তারই অন্যতম শিষ্য মিয়ানমার ফেরত বৌদ্ধ ভিক্ষু বীর চান পঞো থেরকে স্থলাভিষিক্ত করতে
স্বীকৃতি ও অনুমোদন সংক্রান্ত একটি পত্র জারী করেন। ঘটনাটি জেলায় জানাজানি হলে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সিনিয়র নেতা, বৌদ্ধ ভিক্ষু ধর্মাবলম্বীদের ক্ষোভ দেখা দেয়। এতে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করেন জেলা পরিষদ।
বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে গত ৫ই মে অনুষ্ঠিত বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, পর্যবেক্ষণ কমিটি কর্তৃক রাজগুরু বিহারের সকল স্থাবর-অস্থাবর পরিসম্পদের তালিকা প্রণয়ন ও সংরক্ষণের জন্য পর্যালোচনা এবং প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য কার্যক্রম চলছে। পর্যবেক্ষণ কমিটি কর্তৃক পরিদর্শনোত্তর প্রতিবেদন দাখিল না করা পর্যন্ত কোন বিষয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সঠিক হবে না বলে স্থানীয় ভিক্ষুসংঘ ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা পরিষদ।
তাই যেকোন ধরণের বিশৃঙ্খলা এড়াতে পরবর্তী সভায় সিদ্ধান্ত না হওয়ার পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী রাজগুরু বিহারে বিহারাধ্যক্ষ নিয়োগসহ যাবতীয় কার্যক্রম আপাতত স্থগিত রাখার জন্য বিহার পরিচালনা কমিটিকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ।
এব্যাপারে বান্দরবান সার্ক হিউম্যান রাইটার্স ফাউন্ডেশন সাধারণ সম্পাদক অংচমং বলেন, রাজগুরু বিহারের পরিসম্পদের একটি তালিকা থাকা দরকার বলে আমি মনে করি। তবে জেলা পরিষদের উদ্যোগের বিষয়ে পরিচালনা কমিটির মধ্যে কিছু মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তিনি জানান, গুরুভান্তের (উচহ্লাভান্তে) স্বর্ণজাদি, রামজাদিসহ সকল পরিসম্পদ সংরক্ষণ, পরিচালনাসহ নানান বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে দুই গ্রুপ রয়েছে। তবে গুরুভান্তের (উচহ্লাভান্তে) অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদানের পর সকল বিষয়ে হয়ত আলোচনা বা বৈঠক হতে পারে বলে তিনি জানিয়েছেন।
এবিষয়ে বান্দরবান জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ শহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, প্রাচীন বুদ্ধমূর্তিটি চুরির আশঙ্কায় চেয়ারম্যানের নির্দেশে এটি সিলগালা করা হয়েছে।
স্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও নেতৃবৃন্দরা জানান, বান্দরবানের খিয়ংওয়াক্যং (রাজগুরু বৌদ্ধ বিহার)এর প্রাচীনতম ও ঐতিহ্যবাহী গুনসম্পন্ন বুদ্ধমূর্তি ও স্বর্ণ, রৌপ্য ও অলংকারাদি সংরক্ষণ করা ছিল। দীর্ঘদিন ধরে এই মূর্তিটিসহ মূল্যবান দ্রব্যাদি বিহার থেকে উধাও হয়ে গেছে তাদের অভিযোগ রয়েছে। তারা বলেন, ঐ বুদ্ধমুর্তির সাথে সবসময় একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম ঘন্টিও ছিল। মূর্তটিকে যেখানেই নিয়ে যাওয়া হউক না’কেন সাথে সেই ঘন্টিটি বাজানো হয়। বিশেষ করে সাংগ্রাই-এর সময় সাঙ্গু নদীর তীরে বুদ্ধমূর্তি স্নান অনুষ্ঠানে সেই ঐতিহ্যবাহী ঘন্টিটি বাজিয়ে বাজিয়ে মর্যাদাপূর্ণ বুদ্ধমূর্তিটি নিয়ে যাওয়া হতো। কিন্তু উচহ্লাভান্তে বিহারাধ্যক্ষ হওয়ার ৫/৬বছর পর থেকে সেই প্রাচীনতম ঘন্টিটি আর দেখা যাচ্ছে না।
যমুনা টেলিভিশনের বান্দরবান জেলা প্রতিনিধি বাটিং মারমা জানান, সর্বজন পূজনীয় গৌতম বুদ্ধের আমলে নিজের উপস্থিতিতে একদিন একরাতের মধ্যেই নির্মিত বুদ্ধের প্রতিকৃতি, যেটি আড়াই হাজার বছরের পুরনো পঞ্চধাতু দিয়ে
৯টি তৈরি পঞ্চলাহা মূর্তির সাথে সাইজে(ঘন্টি)ও রয়েছে। যা ছিল খুই গুনসম্পন্ন বুদ্ধমুর্তি। যার মধ্যে তিনটি বাংলাদেশে আনা হয়েছিল। সে তিনটি মধ্যে ঘন্টিসহ একটি মূর্তি রাজগুরু বিহারে সংরক্ষিত ছিল। যেটি উচহ্লাভান্তে রাজগুরু বিহার দখল করার ৫/৬বছরের মধ্যে উধাও হয়ে যায়। তিনি আরো জানান, অদ্যবধি ঐঘন্টি সন্ধান না পাওয়ায় রাজগুরু বিহারে বর্তমানে থাকা মূর্তিটি আসল বুদ্ধ প্রতিকৃতি সর্বোচ্চ প্রাচীন সে মুর্তি কিনা জানার আগ্রহ সকল বৌদ্ধধর্মাবলম্বী নর-নারীর।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ঐসব অভিযোগের সত্যতা মিলে রাজগুরু বিহার পরিচালনা কমিটির সভাপতি থোয়াইংচপ্রু মাস্টারের বক্তব্যে। ১৯এপ্রিল জেলা পরিষদের বৈঠকে বিহার পরিচালনা কমিটির সভাপতি থোয়াইংচপ্রু মাস্টারও আশংকা প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশে ৩টি অতিপুরানো গুণসম্পন্ন বুদ্ধমুর্তির মধ্যে ১টি রাজগুরু বিহারে সংরক্ষিত ছিল। তার জানামতে যুগ পরম্পরায় দানকৃত গুণসম্পন্ন বুদ্ধমূর্তি, স্বর্ণ, রৌপ্য অলংকারাদি বিহারে থাকার কথা। তিনি (থোয়াইংচপ্রু মাস্টার) সেগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষিত আছে কিনা জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসন ও ক্যাং কমিটির প্রতিনিধি সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে বিষয়টি খতিয়ে দেখা জন্য জেলা পরিষদে অনুষ্ঠিত সভাকে অবহিত করেন তিনি। এঘটনার পর জেলা পরিষদ বৈঠকে উপস্থিত বৌদ্ধ ভিক্ষু ও নেতৃবৃন্দের মতামতের ভিত্তিতে এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ