Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ঘূর্নিঝড় আমফান: বাগেরহাটে দুই লক্ষাধিক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে, বেড়িবাঁধে ফাঁটল

বাগেরহাট জেলা ও শরনখোলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২০ মে, ২০২০, ৫:৪৯ পিএম

বাগেরহাট জেলার ৯টি উপজেলায় ৯৯৭ টি আশ্রয়কেন্দ্রে দুই লক্ষাধিক মানুষ ও ৩০ হাজার গবাদিপশু আশ্রয় নিয়েছে। এদিকে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে বলেশ্ব নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে সাতফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারের শরণখোলা অংশের বেড়িবাঁধের কয়েকটি জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে শরণখোলা উপজেলা সদরের রায়েন্দা বাজারের পূর্ব পাশে বাঁধে তাৎক্ষনিকভাবে মেরামতের কাজ শুরু করেছে পানি উনśয়ন বোর্ড। ৮৪টি মেডিকেল টিম ও ৭টি ফায়ার সার্ভিসের টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলায় রেড ক্রিসেন্ট, স্কাউটস, সিপিপির মোট ১১ হাজার ৭০৮ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বনরক্ষী ও কর্মকর্তাদের নিরাপদ নিরাপদ স্থানে নেওয়া হয়েছে। সুন্দরবনে আটকে পড়া জেলে, বাওয়ালী ও মৌয়ালরা সুন্দরবন বন বিভাগের বিভিনś ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জেলার কোথাও কোন হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে মাঠে থাকা পাকা ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছে কৃষক। ঝড় ও বৃষ্টি দু’একদিন স্থায়ী হলে পাকা ধান ঘরে তুলতে পারবেন কিনা শĽায় আছেন কৃষকরা।
আতĽে নির্ঘুম রাত কেটেছে বাগেরহাটবাসীর: মঙ্গলবার সারারাত বিভিনś আশ্রয় কেন্দ্র ও ঝুকিপূর্ন বাড়ি ঘরের মানুষরা আতĽে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন জেলার শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ ও মোংলা উপজেলাবাসী। করোনা সংক্রমনের ঝুকি থাকা স্বত্তেও রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে অনেকে এক সাথে থেকেছেন তারা। এর মধ্যে ছিল বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লোকালয় প্লাবিত হওয়ার আশংকায় যারা নিজ বাড়িতে ছিল তারাও ঝড় আতংকে কাটিয়েছে নির্ঘুম রাত। এর মধ্যে রাতভর আশ্রয়কেন্দ্র এসেছে মানুষ। কেউ কেউ আবার গবাদি পশুও নিয়ে এসেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষদের শুকনো খাবার ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেছে জেলা প্রশাসন। মঙ্গলবার রাত থেকে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা ঝুকিপূর্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দূর্গতদের জন্য ১৩ মে.টন চাল, নগদ ৩ লক্ষ টাকা, শিশু খাদ্যের জন্য ২ লক্ষ টাকা এবং গো খাদ্যের জন্য ২ লাখ টাকা ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছ।
বলেশ^র নদীর পানি বৃদ্ধি-বেড়িবাঁধে ফাটল: ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে বুধবার (২০ মে) দুপুর নাগাদ শরণখোলার কোলঘেষা বলেশ্বর নদীর পানি গতকালের চেয়ে সাতফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের বগী ও গাবতলা এলাকায় পানি উনśয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারের ঝুকিপূর্ন বেড়িবাঁধ উপচে যেকোন সময় লোকালয়ে পনি ঢুকতে পারে। বেড়িবাঁধের উপর পর্যন্ত পানি ছুই ছুই করছে। বেড়িবাঁধের গায়ে ঢেউ আছড়ে পড়ছে।
বেলা ১১টার দিকে শরণখোলা উপজেলা সদরের রায়েন্দা বাজারের পূর্বপাশে বলেশ্বর নদী সংলগś পানি উনśয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধে ভাঙ্গন দেখা দেয়। ভাঙ্গনের স্থান থেকে লোকালয়ে পানি ঢোকার উপক্রম হয়।প্রথমে সেখানে স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমে মাটি দিয়ে ভাঙ্গন রোধের চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে পানি উনśয়ন বোর্ড স্কাভেটর দিয়ে ভাঙ্গন কবলিত স্থানে মাটি দেওয়া শুরু করে।
মূল বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের বলেশ্বর নদী সংলগś খুড়িয়াখালী গ্রামে রিং বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। বুধবার সকাল ১০টার দিকে খুড়িয়াখালী গ্রামের শাহজাহান মোল্লার বাড়ির সামনের রিং বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি ঢোকা শুরু করেছে। খুড়িয়াখালী গ্রামের আরিফুল আল মামুন বলেন, সকালে শাহজাহান মোল্লার বাড়ির পাশ থেকে গ্রামরক্ষার জন্য দেওয়া রিং বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি ঢোকা শুরু করে। কিন্তু পানির গতি অনেক বেশি।
বাগেরহাটের পানি উনśয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ নাহিদুজ্জামান খান বলেণ, শরণখোলা এলাকায় বলেশ^র নদীর পানি প্রায় সাতফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। রায়েন্দা বাজারের পাশে বাঁধে যে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়েছিল সেখানে আমরা কাজ শুরু করেছি। এছাড়া বগী ও গাবতলা এলাকার বেড়িবাঁধের দিকে আমাদের বিশেষ নজর রয়েছে। পানি বৃদ্ধি পেলে ওই এলাকায়ও তাৎক্ষনিকভাবে কাজ শুরু করা হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।
সুন্দরবনের বনরক্ষী, জেলে, বাওয়ালী ও মৌয়ালরা নিরাপদে: সুন্দরবনের অভ্যন্তরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বনরক্ষী ও কর্মকর্তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঝড়ের প্রভাবে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে যেসব মৌয়াল ও জেলেরা আটকে পড়েছিল তাদেরকেও বন বিভাগের নিরাপদ ক্যাম্পগুলোতে রাখা হযেছে।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোঃ মঈনুদ্দিন খান বলেন, আম্পানের খবরের পর আমরা সুন্দরবন ও বঙ্গপসাগরে থাকা জেলে, বাওয়ালী ও মৌয়ালদেরকে নিরাপদ স্থানে যেতে বলেছি। তবে অনেকে নিজের কাজ গুছিয়ে যেতে পারেনি। তাদেরকে সুন্দরবন বন বিভাগের ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। তারা নিরাপদেই আছেন।
তিনি আরও বলেণ, সুন্দরবন পশ্চিম ও পূর্ব মিলিয়ে বনের অভ্যন্তরে আমাদের ৬৩টি ক্যাম্প রয়েছে। এসব ক্যাম্পে প্রায় ৪‘শ এর মত বনরক্ষি রয়েছে।এর মধ্যে ১৮টি ক্যাম্প আছে যেগুলো কাঠের তৈরি। সেসব ক্যাম্পের বনরক্ষী ও কর্মকর্তাদের আশপাশের সুবিধাজনক ক্যাম্পে (কনক্রিটের তৈরি ভবন) নিরাপদে থাকতে বলা হয়েছে। তারা সকলেই নিরাপদে রয়েছে। সুন্দরবনে আম্পানের প্রভাবে বাতাস ও বৃষ্টি হলেও এখনও সুন্দরবনের কোন ক্যাম্পের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।
পাকা ধান নিয়ে বিপাকে কৃষকঃ আম্পানের ফলে বৃষ্টি ও বাতাসে ঘরে ওঠাবার আগেই সোনার ফসল ভেসে যাবে পানিতে। কৃষি বিভাগ বলছে জেলার ৮৫ শতাংশ পাকা ধান কেটে ঘরে তুলেছে কৃষকরা। ৪৮ ঘন্টার মধ্যে অবশিষ্ট ধান কেটে ঘরে তোলার জন্য কৃষকদের বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এখনও ৩০ শতাংশের উপরে পাকা ধান মাঠে রয়েছে বলে দবি অনেক কৃষকের। এর মধ্যে ৫ থেকে ৭ শতাংশ ধান এখনও পাকেনি।
বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক রঘুনাথ কর বলেন, ‘আম্পান’ আঘাত হানার আগেই মাঠে থাকা অবশিষ্ট পাকা ধান কেটে কৃষকের ঘরে তুলতে সর্বাতĄক চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৮৫ ভাগ ধান কাটা হয়েছে। কিছু ধান এখনও পাকেনি। তবে পাকা ১০ ভাগ ধান মাঠে আছে, যার অধিকাংশ ফকিরহাট ও মোল্লাহাট উপজেলায়। এখানে ‘কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার’ ও ‘ম্যাকানাইজড রিপার’ ব্যবহার করা যাচ্ছেনা। যার ফলে এই দুই উপজেলায় ধান হাতে কাটতে হচ্ছে। তবুও সমন্বিত উদ্যোগে আগামী ২ দিনের মধ্যে এ ধান কাটা শেষ হবে বলে আশাকরছি। এ জেলায় চলতি মৌসুমে ৫২ হাজার ৯৩০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৪৩ হাজার ১১০ মেট্রিকটন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোঃ মামুনুর রশীদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের খবরের সাথে সাথে আমরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছি। বুলবুলসহ বিভিনś ঝড়ের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা চেষ্টা করেছি যাতে আম্পানের ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়। জেলার উপকূলীয় উপজেলা রামপাল, মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা সেখানে অবস্থান করে ঘূর্নিঝড় আম্পানের প্রভাব পর্যবেক্ষন করছেন। প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহন করছেন। সর্বোপরি আমরা চেষ্টা করছি যাতে বাগেরহাটবাসী ঘূর্নিঝড় আম্পানের ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ