Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

হালদায় রেকর্ড প্রকৃতিতে সুদিন

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ২৪ মে, ২০২০, ৪:০৩ পিএম

. করোনার ওপিঠে সৃষ্টি সুখের উল্লাস
. গড়ন-গঠন প্রজনন-জাগরণের উৎসব
. মানুষের হাতের কোনো পরিচর্যা ছাড়াই প্রাকৃতিক মহিমায় রুই কাতলা মৃগেল মা-মাছ দলে দলে ছাড়ে ডিম
. ১৪ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ, ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিমে রেণু-পোনা ফোটানোর ব্যস্ততা
. মঙ্গলবার থেকে সারাদেশে পৌঁছে যাবে
. হালদাপাড়ে অন্যরকম ঈদ আনন্দ


রুই কাতলা মৃগেল বড় (কার্প) জাতের মা-মাছের ডিম ছাড়ায় এবং আহরণে বড়সড় রেকর্ড গড়লো হালদা নদী। সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশের মহিমাময় প্রকৃতিরাজ্যের ‘সক্ষমতা’ সম্পর্কে বিস্ময়কর, কৌতূহল এবং দারুণ আশা জাগানিয়া স্পষ্ট বার্তা দিল হালদা। পরিবেশ-প্রতিবেশ-প্রকৃতি জগতে আজ সুদিন। মানুষের আগ্রাসী থাবামুক্ত। যান্ত্রিক কোলাহলহীন। বাধাহীন। তাই তো প্রকৃতি আজ স্বাধীন। জানান দিল পাহাড়ি খরস্রোতা হালদা। একথা বলেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ।
করোনা মহামারী তাড়া করছেই। মানবজাতির ঘোর দুর্দিন। সংক্রমণ ঠেকাতে গৃহবন্দী মানুষ সবকিছু থেকেই গুটিয়ে ‘নাই’ স্বেচ্ছায় হয়ে গেছে। ভীত-পীড়িত ঘরবন্দী মানুষেরা নিরীহ পরিবেশ-প্রকৃতি, উদ্ভিদ-প্রাণিরাজ্যের উপর জুলুম-অত্যাচার, জ্বালাতন করছে না। মোদ্দা কথায় আগ্রাসী ও ধ্বংসের হাত গুটিয়ে রেখেছে। রাখতে বাধ্য হয়েছে। আর সেই সুবাদে মুক্ত অদেখা-অজানা আরেক পৃথিবীকেই যেন উপভোগে মেতে উঠেছে পরিবেশ-প্রতিবেশ, ভূ-প্রকৃতি, প্রাণিজগত, উদ্ভিদরাজ্য। করোনার ওপিঠে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে উঠেছে মেতে। গড়ন-গঠন, প্রজনন-জাগরণের উৎসব চারদিকে।

এশিয়ায় মিঠাপানির রুই কাতলা বড় (কার্প) জাতের মাছের সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক জোয়ার-ভাটা নির্ভর হালদা বাংলাদেশের ‘অর্থনৈতিক নদী’ ও ‘মাছের ব্যাংক’। মানুষের হাতের কোনো পরিচর্যা এমনকি স্পর্শ ছাড়াই প্রকৃতির আপন নিয়মের ধারায় রুই কাতলা মৃগেল মা-মাছ হালদা নদীতে প্রাকৃতিক উৎস থেকেই খাদ্য গ্রহণ করে পরিপুষ্ট হয়। স্বাধীন পছন্দমতো নদীটির বাঁকে বাঁকে ও ঘূর্ণিস্রোতে বিচরণশীল থাকে। প্রজনন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। এরপর ডিম ছাড়ার সময় যখন হলো তখনই নদীর বুকে দলে দলে ভেসে উঠে এসে ‘নিষিক্ত’ প্রক্রিয়ায় ডিম ছাড়লো। সেই ডিম সংগ্রহ করে অভিজ্ঞ জেলেরা বিশেষ পদ্ধতিতে।
১৪ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ-

প্রসঙ্গত হালদায় গত ২২ মে ডিম ছাড়ায় ও আহরণের দিনটিতে প্রাথমিক হিসাবে জানা গিয়েছিল যে, ১২ বছর তথা এক যুগের রেকর্ড ভঙ্গ হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন তথ্য থেকে নিখুঁত হিসাবে স্পষ্ট, এক যুগ নয়; বরং গেল ১৪ বছরের রেকর্ড অতিক্রম হয়েছে। এবার রুই কাতলা মা-মাছের ডিম সংগ্রহের পরিমান ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি। আর ১৪ বছর পূর্বে ২০০৬ সালে সর্বোচ্চ ডিম ছাড়ায় এবং সংগ্রহের রেকর্ড ছিল ৩২ হাজার ২৫০ কেজি।
অর্ধ লাখ কেজির সম্ভাবনা ছিল-

এ বিষয়ে আজ রোববার হালদা বিশেষজ্ঞ চবি অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, যদি ওইদিন (২১ ও ২২ মে) মানিকছড়ির উজানে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণে পাহাড়ি ঢলের তোড় বা ঘোলাস্রোত আরও তীব্র আকার ধারণ করতো তাহলে হালদায় মা-মাছেরা প্রায় দ্বিগুণ অর্থাৎ অর্ধ লাখ কেজি ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা ছিল। তাহলে সর্বকালের রেকর্ডই ভঙ্গ করতো হালদা। খাগড়াঠড়ির মানিকছড়ি থেকে উত্তর চট্টগ্রামের রাউজান-হাটহাজারী উপজেলার প্রায় ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকা জুড়ে খরস্রোতা পাহাড়ি হালদার গতিপথ। নদীটি সবদিক থেকেই ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।

করোনাকারণে লকডাউনে হালদা গত টানা তিনটি মাস মানুষের আগ্রাসী থাবা থেকে প্রায় মুক্ত। এরফলে স্বাভাবিক পরিবেশে ঘুরে-বেরিয়ে, খেয়ে মা-মাছে পরিণত পুষ্ট হয়েছে এবার ব্যাপক সংখ্যক রুই কাতলা। মিলেছে সর্বোচ্চটুকু ডিমের উৎপাদনশীলতা। করোনার ওপিঠে এ যেন প্রকৃতিরাজ্যে সৃষ্টি সুখ, সতেজতা ও আত্মবিকাশের উল্লাস। প্রকৃতির সুসময়। গড়ন-গঠন, প্রজনন-জাগরণের উৎসব। রেকর্ড আর বাম্পার উৎপাদনের বুঝি এই তো সময়।
মঙ্গলবার পোনা যাবে সারাদেশে-

অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া আজ জানান, সংগৃহীত সাড়ে ২৫ হাজার কেজি ডিম থেকে এখন রেণু-পোনা ফোটানোর ব্যস্ততার পালা চলছে। হালদা পাড়ে শীতল মাটির ছোট ভোট কুয়ায় ডিম সংরক্ষণ করা হচ্ছে। চার দিনের ব্যবধানে পরিণত হবে রুই কাতলা মাছের রেণু-পোনা। সেই হিসাবে আগামী ২৬ মে মঙ্গলবার থেকে পুরোদমে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল ছাড়াও সমগ্র দেশে বিভিন্ন ছোট ছোট পরিবহনে হালদার অর্থকরী মৎস্যবীজ পৌঁছে যাবে সারাদেশে।
চট্টগ্রামে বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় প্রশাসন তা সারাক্ষণ সমন্বয় ও মনিটরিং করছে। হালদার উন্নতজাতের ডিমে ফোটা রেণু-পোনা থেকে মাছচাষীরা সারাদেশে পুকুরে-খামারে আবাদ উৎপাদন করবেন শত শত কোটি টাকার সুস্বাদু রুই কাতলা মৃগেল। মাছে ভরপুর হবে দেশ।

এরজন্য ড. কিবিরীয়সহ বিশেষজ্ঞ, প্রশাসন, মৎস্য বিভাগের সমন্বয়ে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটি সূত্র জানায়, ডিমে ফোটা প্রতিটি রেণু-পোনা সুরক্ষা এবং গণনা করা হবে। আগেই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয় অপচয়রোধে। হালদার রুই কাতলা মৃগেল এশিয়ায় মৌলিক জাতের। ফলে হালদার পোনা অল্প সময়েই দ্রুত বর্ধনশীল। হয় ঢাউস আকারের। বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ সারাদেশের মৎস্য চাষীরদের কাছে প্রধান আকর্ষণ হালদার ডিমের ফোটানো রেণু পোনা। সবাই এ সময়ের জন্য মুখিয়ে থাকেন। করোনাকালেও হালদাপাড়ের জেলেসহ এলাকাবাসীর মাঝে এবার অন্যরকম ঈদের আনন্দ। প্রকৃতির উদার দানে তারা আপ্লুত।
হালদায় রেকর্ডের নেপথ্যে : করোনাকারণে মানুষের থাবামুক্ত-

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক, হালদা নদী গবেষণাগারের সমন্বয়ক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, করোনা সংক্রমণরোধে গত কয়েক মাস যাবৎ দেশে লকডাউন, যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় পরিবেশ-প্রকৃতি, প্রাণিজগতেও পড়েছে ইতিবাচক প্রভাব। হালদা নদী ও এর পাশের পরিবেশ-প্রকৃতির উপর দূষণ, দখল, বর্জ্য নিক্ষেপ রোধ, আগ্রাসন, ধ্বংসলীলা, পর্যটক বোটসহ অধিকাংশ নৌ-যান চলাচল, বেপরোয়া মাছ শিকার ইত্যাদি ক্ষতিকর দিক বন্ধ রয়েছে।
এরফলে মা-মাছেরা স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে পেয়েছে। কোভিড-১৯ লকডাউনের ফলে পরিবেশে ভারসাম্য বজায় থাকে। এরফলে আসে প্রত্যাশিত সুফল। অনুকূল আবহাওয়া, পরিবেশ-প্রকৃতির মাঝে বেশিহারে ডিম ছেড়েছে। যদিও উপযুক্ত আবহাওয়া না থাকায় পরপর তিন ‘জো’ ডিমশূণ্য অবস্থায় গেছে। ঘূর্ণিঝড় কেটে যাওয়ার পরই হালদায় মা-মাছ ডিম ছেড়েছে।

তাছাড়া এবার বছরজুড়ে হালদা দূষণ, দখল, বর্জ্য-আবর্জনা ডিম্পিং, বালু তোলা, ড্রেজিং, চোরা শিকারিদের মা-মাছ নিধন, নদীতে গোপনে জাল ফেলা, চাঁদাবাজি কঠোরভাবে রোধ, দূষণকারী হিসেবে আগেই চিহ্নিত ও হাতেনাতে প্রমাণিত এশিয়ান পেপার মিলস, একশ’ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টসহ বিভিন্ন কারখানা, পোলট্রি ফার্ম ও বর্জ্যরে উৎসগুলো বন্ধ করা, নদীর উজানে খাগড়াছড়ির মানিকছড়ির পাহাড়ি এলাকায় বিষাক্ত তামাক চাষ বন্ধ করে দেয়া, নদীর গতিপথ স্বাভাবিক থাকতে দেয়া ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

মৎস্য বিভাগ ও মাঠ প্রশাসনের এসব বিষয়ে ছিল কড়া নজরদারি। ফলে উদ্যোগগুলো সুফল দিয়েছে। রেকর্ড অতিক্রম করেছে ডিম ছেড়েছে হালদার রুই কাতলা মৃগেল কালিবাউশ মা-মাছেরা। তাছাড়া হালদা পাড়ের নানাশ্রেণি পেশার জনগণকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করে আসছে পিকেএসএফ, আইডিএফ (ইন্টেগ্রেটেড ডেভেলাপমেন্ট সার্ভিস)। প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব ড. এম আবদুল করিমের নিজ গ্রাম হালদা এলাকায়। নদীটির জাতীয় অর্থনৈতিক, জেলেদের পেশা ও কর্মসংস্থান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের গুরুত্বের সঙ্গেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উৎসাহের পরিপ্রেক্ষিতে ড. এম এ করিম হালদা সুরক্ষায় আগেই বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান মুখ্য সচিব চট্টগ্রামের কৃতিসন্তান ড. আহমদ কায়কাউস করোনাসঙ্কটসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ নাগরিক সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট। করোনাকালে চট্টগ্রাম বন্দর সার্বক্ষণিক সচল রাখা, করোনা টেস্টে কিট সঙ্কট নিরসনে দৃশ্যমান তার প্রয়াস ও অবদান।

হালদার ক্ষয়ক্ষতি ও আইনভঙ্গের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন গত এক বছরে ১০৯ দফায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করেন। পোড়ানো হয় সোয়া দুই লাখ মিটার অবৈধ জাল, ড্রেজার, ইঞ্জিন নৌকাসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম।
সাফল্য ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জÑ

এবার ২২ মে সারাদিনে হালদায় রুই কাতলা মৃগেল মা-মাছেরা ডিম ছাড়লো ও আহরণ হলো ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি। গতবছর ২০১৯ সালের ২৫ মে ডিম পাওয়া গেছে ৭ হাজার কেজি। ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল ডিম ছাড়ে ২২ হাজার ৬৮০ কেজি। যা দশ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ। ২০১৭ সালে ডিম ছাড়ে এক হাজার ৬৮০ কেজি। ২০১৬ সালে ৭৩৫ কেজি, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি এবং ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫শ’ কেজি ডিম।

১৪ বছর পূর্বে ২০০৬ সালে সর্বোচ্চ ডিম ছাড়ে মা-মাছ। সংগ্রহ হয় ৩২ হাজার ২৫০ কেজি। তবে এবার ভারী বর্ষণ ও বজ্রবৃষ্টির মাত্রা আরও বেশি হলে ডিম ছাড়া এবং প্রাপ্তির পরিমান দ্বিগুণ অতিক্রম করতো এ ধারণা বিশেষজ্ঞণেরই জোরালো ধারণা। তারা যোগ করেন, মা-মাছের ডিম সংগ্রহে রেকর্ড সাফল্য ঝুড়িতে তোলার পরই বির্বিকার হয়ে বসে থাকা যাবে না। মাছের ব্যাংক এবং অর্থনৈতিক নদীটি জাতীয় স্বার্থে সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অর্জিত এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে। হালদার সরাসরি অর্থনৈতিক অবদান ৮শ’ কোটি টাকা।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হালদা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ