Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বহির্বিশ্বে ক্ষুন্ন করবে দেশের ভাবমর্যাদা

বিদেশ ভ্রমণে করোনার জাল সনদ দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১৯ জুন, ২০২০, ১২:০৩ এএম

মামলার কাজে আদালতে বা অফিসে প্রমান হিসেবে কারো অসুস্থতার মেডিকেল সার্টিফিকেট প্রয়োজন পড়লেই হাসপাতালে না গিয়ে জালিয়াত চক্রের কাছে গেলেই মিলছে। এটা দীর্ঘদিনের স্বাভাবিক চিত্র। বর্তমান করোনার সময়ে এই জালিয়াতচক্র আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে ভিন্ন আঙ্গিকে। এই কাজে সাহায্য করছেন বিভিন্ন হাসপাতালের কর্মচারীরা বলেও অভিযোগ রয়েছে। চাকরি বাঁচাতে, বিদেশ ভ্রমণে বা অন্য প্রয়োজনে দরকার করোনা পরীক্ষার নেগেটিভ রিপোর্ট। আবার অফিস-আদালতে যোগদান করবেন না, অথবা ভ্রমণে যাবেন কিংবা সরকারি ছুটি ও বিভিন্ন প্রকার সুযোগ-সুবিধার আশা করছেন, এমন ব্যক্তিরা চান করোনা পজিটিভ রিপোর্ট। এমন দুই ধরনের অসাধু মানুষেরই চাহিদা মেটাতে সক্রিয় হয়ে ওঠেছে এই জালিয়াত চক্র। যারা টাকার বিনিময়ে করোনার নেগেটিভ বা পজিটিভ রিপোর্ট বা সনদপত্র দিচ্ছেন। করোনায় বিশ্বব্যাপি বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থায় আনা হয়েছে করোনা সনদ দেখানোর নিয়ম। আর বিদেশ ভ্রমণের জন্য অসাধু চক্রটি এই সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে ঢাকা থেকে চীনের গুয়াংঝু শহরগামী একটি ফ্লাইটে ১৭ জন বাংলাদেশি যাত্রীর করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়ার তথ্য মিলেছে। যাদের প্রত্যেকেরই বাংলাদেশ থেকে নেয়া করোনার নমুনা পরীক্ষার নেগেটিভ সনদ ছিল।

ভুয়া সনদ নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করে বহির্বিশ্বের কাছে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে চক্রটি। এক্ষেত্রে বিদেশ ভ্রমণে করোনা সনদের জন্য নির্দিষ্ট হাসপাতাল এবং সনদের নির্দিষ্ট সময় বেধে দেয়ার কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ অনেক সময় করোনা নমুনা পরীক্ষার ফলাফল অনেক দিন আগের হলে ওই লোক আবার করোনা রোগীর সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই এই সনদের ক্ষেত্রে অবশ্যই নির্ধারিত একটি সময় নির্ধারণ করে দেয়ার কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে নির্ধারিত হাসপাতাল বা ল্যাব ভুল সনদ দিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রাখার কথা বলেছেন তারা।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও মিডিয়া সেলের মুখপাত্র হাবিবুর রহমান খান ইনকিলাবকে বলেন, একটু অসাধু চক্র বিদেশ ভ্রমণে ভুয়া সনদ নিচ্ছে জেনেছি। যা শুধু বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট নয়; দেশের সর্বনাশ করে ফেলবে। প্রত্যারক চক্রকে ধরতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সজাগ থাকার আহবান জানিয়েছেন। পাশাপাশি একজনকে ধরে এর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত শাস্তির আওতায় আনার কথা বলেন তিনি।

হাবিবুর রহমান খান বলেন, ভুয়া সনদ ঠেকাতে ইতোমধ্যে আলোচনা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে নির্দিষ্ট হাসপাতাল অথবা ল্যাব যৌথভাবে প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকে দেয়া সনদ ছাড়া বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ বন্ধ করা হবে। একই সঙ্গে দেয়া হবে সনদের নির্দিষ্ট সময়সীমা। শিগগরিই এ পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। অন্যথায় জালিয়াত চক্রের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। যা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে বলে উল্লেখ করেন মিডিয়া সেলের এই মুখপাত্র।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক জনসংযোগ মো. কামরুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, এভাবে জাল সনদ চক্র সক্রিয় থাকলে এয়ারলাইন্সগুলো বিপাকে পড়বে। দেশের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে নষ্ট হবে। তিনি বলেন, শুধুমাত্র বিমান যাত্রীদের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সিভিল এভিয়েশনের পৃথকভাবে করোনা ল্যাব চালু করা উচিত। যাত্রীদের জন্য এ ধরণের ব্যবস্থা না করতে পারলে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ হওয়া কঠিন হবে। এতে জালিয়াতির সুযোগ কমে যাবে।

সূত্র মতে, এক ধরনের অসাধু মানুষের চাহিদা মেটাতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে জালিয়াত চক্র। যারা টাকার বিনিময়ে করোনার নেগেটিভ বা পজিটিভ রিপোর্ট বা সনদপত্র দেওয়ার ফাঁদ পেতে বসেছে। চাহিদা অনুযায়ী যার যেমন দরকার-নেগেটিভ অথবা পজিটিভ রিপোর্ট। মাত্র ৬ হাজার টাকা দিলেই মুগদা জেনারেল হাসপাতালের প্যাডে দেয়া হচ্ছে ভুয়া সনদ।

গত সোমবার রাজধানীর মুগদা এলাকা থেকে এমন বিপুল পরিমাণ ভুয়া সনদপত্রসহ জালিয়াত চক্রের চারজনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। তারা হলেন- ফজল হক (৪০), শরিফ হোসেন (৩২), জামশেদ (৩০) এবং লিয়াকত আলী (৪৩)। তাদের কাছ থেকে শতাধিক করোনার ভুয়া সনদপত্র, দুটি কম্পিউটার, দুটি প্রিন্টার এবং দুটি স্ক্যানার উদ্ধার করা হয়। র‌্যাব-৩ এর পরিচালক লে. কর্নেল রকিবুল হাসান বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশ্বের এই পরিস্থিতিতে করোনার দৃশ্যমান উপসর্গবিহীন ব্যক্তিরা করোনা টেস্টে পজিটিভ হওয়ার পরও ভুয়া নেগেটিভ সনদ নিয়ে বিভিন্ন অফিস-আদালতে যোগদানসহ বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করছেন এবং অনেকেই আবার সরকারি ছুটি ও বিভিন্ন প্রকার সুযোগ-সুবিধা পেতে ভুয়া পজিটিভ সনদ নিচ্ছেন।

টাকার বিনিময়ে ওই ভুয়া নেগেটিভ-পজিটিভ সনদ দিচ্ছে এ ধরনের জালিয়াত চক্র। বিষয়টি নজরে আসলে করোনার ভুয়া সনদ প্রস্তুতকারী ও বিক্রয়কারী চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। র‌্যাব জানায়, ওই জালিয়াত চক্রটি দেড় শতাধিক মানুষের কাছ থেকে ৬ হাজার করে টাকা নিয়ে করোনার ভুয়া নেগেটিভ ও পজিটিভ সনদ দিয়েছে। আরও শতাধিক লোককে ভুয়া সনদ দেওয়ার প্রুতিশ্রুতি দিয়ে আরো পাঁচ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়েছে চক্রটি।

মুগদা জেনারেল হাসপাতালের কোনো কর্মচারী এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কিনা জানতে চাইলে র‌্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, সেটা খতিয়ে দেখছি। তবে চক্রের সদস্যরা মুগদা হাসপাতাল থেকে দেয়া করোনা রোগীর রিপোর্টের কপি সংগ্রহ করে তা স্ক্যান করে সেখানে নাম বসিয়ে বিক্রি করে আসছিল।

গত বৃহষ্পতিবার ঢাকা থেকে চীনের গুয়াংঝু শহরগামী একটি ফ্লাইটে ১৭ জন বাংলাদেশি যাত্রীর করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়ার পর চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্সের বাংলাদেশ-গুয়াংঝু রুটে বিমান চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বেইজিং। অথচ তাদের প্রত্যেকেরই করোনা নেগেটিভ সনদ ছিল।

নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় আগামী ২ জুনের পর চার সপ্তাহ চীনের এই বিমান সংস্থা বাংলাদেশ-গুয়াংঝু রুটে বিমান চলাচল করতে পারবে না। গত রোববার চীনের বেসামরিক বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা জারি করেছে। এতে চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্সের বাংলাদেশ-গুয়াংঝু ফ্লাইট চলাচলে ওই নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা জানানো হয়।

নতুন বিধি অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সের কোনও রুটের ফ্লাইটে যদি পাঁচজন যাত্রীর করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়, তাহলে সেই রুটের ফ্লাইট এক সপ্তাহ স্থগিত থাকবে। এছাড়া যদি করোনা আক্রান্ত যাত্রীর সংখ্যা ১০ ছাড়িয়ে যায় তাহলে সেই বিমানসংস্থা চার সপ্তাহ ফ্লাইট বন্ধ রাখবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত ইনকিলাবকে বলেন, করোনার জাল সনদে বিদেশ ভ্রমণ বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করবে। কোন কোন দেশ ওই দেশে ভ্রমণে নিষেধজ্ঞাও আরোপ করতে পারে। যা আমাদের জন্য চরম লজ্জার হবে। তাই অত্রি দ্রুত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া। নির্দিষ্ট হাসাতালের সনদের মাধ্যমে ভ্রমণের অনুমতি। আবার ওই নির্দিষ্ট হাসপাতালের সনদেও ভুল থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ারও বিধান থাকতে হবে। পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনেিক দ্রুত এই জালিয়াত চক্রকে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার কথা বলেন প্রফেসর প্রাণ গোপাল।##



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ