Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মহাকবি শামসুদ্দিন হাফিজ : জীবন ও কর্ম

আব্দুল কাদের শাহ নেওয়াজ | প্রকাশের সময় : ৩ জুলাই, ২০২০, ১২:০৪ এএম

পূর্ব প্রকাশিতের পর
তিনি প্রধানত প্রেমের কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতা গুলো যেন প্রেমের এক অমর কাব্য। তিনি যা কিছু রচনা করতেন তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করত। তাঁর কাব্যখ্যাতি দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে।

কবিতা সংগ্রহ: হাফিজ নিজে তাঁর কবিতাগুচ্ছ সংগ্রহ করেননি। এমনকি তাঁর জীবদ্দশায়ও এগুলো সংগ্রহ করা হয়নি। তবে তাঁর কবিতা গুলো লোকমুখে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। হাফিজের মৃত্যুর প্রায় ২১-২২ বছর পর তাঁর বন্ধু মুহাম্মদ গোলামন্দ ৮১৩ হিজরী মোতাবেক ১৪১০ খ্রিস্টাব্দের দিকে তাঁর কবিতাগুচ্ছ সংগ্রহ ও সংকলন করেন। তার সংগৃহীত কবিতার সংখ্যা ছিল (৫০০) পাঁচশরও বেশি। তবে বর্তমানে এ সংকলন গ্রন্থটি পাওয়া দুষ্পাপ্য।

গজল রচনা: আজকের দিনে হাফিজকে বলা হয় গজলের অনুপম স্রষ্টা। কেননা তিনি গজল রচনায় এক সুন্দর র্নিমাণ কৌশল অবলম্বন করেছেন। তাঁর গজলের প্রতিটি বাক্য পাঠক হৃদয়ে প্রেম, ভালোবাসা, উদারতা ও মুক্তচিত্তের চেতনা জাগিয়ে তোলো। তাঁর গজলে সাদীর গজলের প্রভাব ও রুমীর গজলের মূল বিষয় পরিস্ফুটিত হয়েছে। তবে সাদীর গজলের ন্যায় তাঁর গজল এত সহজ ছিল না এবং মাওলানা রুমীর গজলের ন্যায় এত কঠিনও ছিল না।তাঁর প্রতিটি গজল সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং খোদার প্রশংসা ও প্রেমে ভরপুর। পাঠক মহলে তাঁর গজলগুলো প্রেমের এক অমর কাব্যে পরিণত হয়েছে। পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যাই ছিল তাঁর গজলের অধিকাংশ ভাষ্য। তাঁর একটি গজলে বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন এবং তাঁর তিন সেবিকার কথা উল্লেখ আছে।

দিওয়ান-ই হাফিজ: দিওয়ান-ই হাফিজ দুনিয়া জোড়া সাড়া জাগানো এক পুস্তক। কবি হাফিজের একমাত্র কাব্যগ্রন্থ দিওয়ান-ই হাফিজ। তাঁর কবিতা সমূহ সংগ্রহ করে দিওয়ান-ই হাফিজ নামে প্রকাশ করা হয়। হাফিজের মৃত্যুর পর তাঁর এক ভক্ত সাইয়্যেদ করিম আনোয়ার তাঁর সমস্ত কবিতা সংগ্রহ করে দিওয়ান-ই হাফিজ নামে প্রকাশ করেন। এ কাব্যে ৫৯৯ টি কবিতা রয়েছে। কবিতাগুলোর অধিকাংশই আধ্যাত্মিক ভাবধারায় পরিপূর্ণ। বর্তমানে সাইয়্যেদ আব্দুর রহিম খালখালীর সম্পাদনায় প্রকাশিত দিওয়ান কাব্যে ৪৯৬ টি গজল, ৪২ টি রুবাইয়াত ও একটি মসনবী কবিতা রয়েছে। তাঁর রচিত কবিতাগুচ্ছ দিওয়ান সৃষ্টিতত্ত¡, প্রেমতত্ত্ব ও দর্শনের খনিরূপে সমগ্র দুনিয়ায় আলোচিত। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় হাফিজ জ্ঞানের বিশাল ভান্ডারে রয়েছে রহস্যের নানা অধ্যায়। গুপ্ত, সুপ্ত, ব্যক্ত-অব্যক্ত জ্ঞানের দ্যুতি ছড়িয়ে হাফিজ বিশ্বকে মাতিয়ে গেছেন তারঁ কাব্যের জাদুকরী ছন্দ মুর্ছনায়। তাঁর দিওয়ান কাব্যের প্রতিটি গজলের মধ্যেই ইসলামী চেতনা পরিস্ফুটিত হয়েছে। তাঁর দিওয়ান কাব্যটি প্রমাণ বহন করে তিনি একজন ইসলামী রেঁনেসার কবি ও আধ্যাত্মিক কবি ছিলেন। কেননা তাঁর দিওয়ান কাব্যের একমাত্র সুর ছিল আল্লাহর প্রেম ও আনুগত্য। যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকগণ এ কাব্য অধ্যায়নে আকৃষ্ট হয়ে বাংলা, ইংরেজি, জার্মান, ফ্রেন্স, ল্যাটিন, স্প্যানিশসহ বিভিন্ন ভাষায় গদ্য ও পদ্যে অনুবাদ প্রকাশ করেন। ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে জার্মান কবি গ্যেটে হাফিজের দিওয়ান কাব্য পাঠ করে মন্তব্য করেন, “হঠাৎ প্রাচ্যের আসমানী খুশবু এবং ইরানের পথ-প্রান্তর থেকে প্রবাহিত চিরন্তন প্রাণ সঞ্জীবনী সমীরণের সাথে পরিচিত হলাম। আমি এমন এক অলৌকিক ব্যক্তিকে চিনতে পেলাম, যার বিস্ময়কর কবিতাগুচ্ছ আমাকে তাঁর জন্য পাগল করেছে।”

কবির শ্রেষ্ঠত্ব: হাফিজ তাঁর কাব্যখ্যাতি ও দর্শনতত্তে্বর মাধ্যমে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম কবিদের অন্যতম কবি বলে পরিগণিত হয়েছেন। প্রাচীন ও আধুনিক উভয় যুগেই তাঁর উক্ত মর্যাদা স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্রাচীন যুগে রচিত তাঁর দিওয়ানের বিপুল সংখ্যক ভাষ্যগ্রন্থ প্রাচীন যুগে তাঁর কাব্য প্রতিভার স্বীকৃতি লাভের প্রমাণ বহন করে। প্রাচীন যুগে কবি হাফিজ এমন জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন যে, লোকেরা তাঁর কবিতার সাহায্যে শুভাশুভ লক্ষণ বের করে তাদের কার্যাবলী ও বিষয়াবলীর ব্যাপারে পথ নির্দেশ লাভ করত। আর আধুনিক যুগের কবি-সাহিত্যিক ও গবেষকগণ হাফিজের কাব্য ও দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাঁর উপর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা হাফিজের কবিতা ও কাব্য প্রতিভা সম্বন্ধে যে সকল গবেষণা করেছেন তা থেকেও হাফিজের উচ্চ মর্যাদার সন্ধান বা স্বীকৃতি পাওয়া যায়। তাঁর কাব্য প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি নজরুল, কবি গ্যেটেসহ একাধিক জার্মান কবি তাঁর প্রশংসায় মন্তব্য করেছেন। এছাড়াও অধ্যাপক ব্রাউন ‘পারস্য সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে এবং মাওলানা শিবলী নু’মানী ‘শিরুল আজম’ গ্রন্থে কবি হাফিজের কাব্য প্রতিভা সম্বন্ধে সুবিশদ ও তৃপ্তিদায়ক আলোচনা করেছেন। গ্যেটে মন্তব্য করে বলেন, “হে হাফিজ তোমার বাণী চিরন্তনের মত মহান। কেননা, তার জন্য আদি ও অন্ত নেই। তোমার ভাষা আসমানের গম্বুজের মত একাকী নিজের উপরই স্থিত। তোমার গজলের অর্ধেকটায় বা প্রথম কলিতে কিংবা অন্য কোনো অংশের মধ্যে মোটেও পার্থক্য করা যায় না। কেননা এর সবটাই সৌন্দর্য ও পূর্ণতার নির্দশন। একদিন যদি পৃথিবীর আয়ু ফুরিয়ে যায়, হে আসমানী হাফিজ! আমার প্রত্যাশা যে, একমাত্র তোমার সাথে ও তোমার পাশে থাকবো। তোমার সঙ্গে শরাব পান করব। তোমার প্রেমে আত্মহারা হব। কেননা এটাই আমার জীবনের গৌরব ও বেঁচে থাকার পাথেয়।”

মৃত্যু: মহাকবি হাফিজ সিরাজী ১৩৮৮/১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুবরণ করার পরও কবি অদ্যবধি পর্যন্ত প্রতিটি পাঠক হৃদয়ে তাঁর কবিতা ও গজলের মাধ্যমে অমর হয়ে আছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ