Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জীবনের চেয়ে সময়ই মূূল্যবান

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৬ জুলাই, ২০২০, ১২:০১ এএম

১৯৭৪-৭৫ সালের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতোকত্তর ‘ম্যানেজমেন্ট’ ডিপার্টমেন্ট নতুন চালু করেছে। এলএলবি শেষ বর্ষের ছাত্র থাকাবস্থায় নতুন ডিপার্টমেন্টে টেস্ট পরীক্ষায় কতৃকার্য হয়ে মাস্টার্স কোর্সে ভর্তির সুযোগ পেলাম। কলা ভবনের পূর্ব দিকের চতুর্থ তলায় ক্লাস রুম। ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক দূর্গাদাস ভট্টাচার্য (পরবর্তীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) প্রথম ক্লাসে এসে সিলেবাস বহির্ভূত একটি ছোট সূচনা বক্তৃতা করেন। বক্তৃতাটি আমার মনপূত হয়েছিল এবং আমি এখনো তা মনে রেখেছি। তিনি বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি ফুলের মতো, এখানে মৌমাছি মধু আহরণ করে, প্রজাপতি আহরণ করে বিষ এবং কিছু কিটপতঙ্গ বা পাখি আছে যারা শুধু আসে, আর ঘুরে ফিরে চলে যায়। সে সময়ে তার পাতলা গড়ন শরীর ও বক্তব্যটি এখনো আমার চোখে ও মনে পরিষ্কারভাবে পরিস্ফুটিত হয়। তিনি ছাত্রদের আপনি বলেই সম্বোধন করে উক্ত ছোট বক্তব্য রেখে অর্থনীতির ক্লাস শুরু করলেন। অধ্যাপক মহোদয়ের প্রথম ক্লাসের সূচনালগ্নের বক্তব্যে তিনি যা বুঝাতে চেয়েছেন বলে আমি বুঝে নিয়েছিলাম, তা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ইমারত, বড় লাইব্রেরি, আভিজাত্যের সুনসান, ঠাটফাটের চাকচিক্য কোনো ছাত্রকে কিছু দিতে পারে না, যদি না শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়কালীন সময়কে কাজে লাগিয়ে নিজ জীবনকে গড়তে না পারে। এখনতো আর্দশ লিপি বইটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উঠে গেছে। আমাদের সময় প্রাথমিক স্কুল জীবনে আর্দশ লিপিতে বারংবার একটি কবিতা পড়েছিলাম, তা হুবুহু মনে নাই তবে মর্মার্থ এটুকু মনে পড়ে যে, সময় চলে গেলে আসবে না ফিরে, অতএব, হেলায় খেলায় সময় নষ্ট করিও না। প্রবাদ রয়েছে যে, ‘সময় ও নদীর স্রােত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।’ ইংরেজিতে যা একটি প্রতিষ্ঠিত প্রবাদ, Time & Tide Wait For
None. প্রবাদটি অনেকে জেনেও তা কোনো প্রকার মূল্যায়ন করে না। আমার নিকট সময়ের মূল্যায়নটি গোড়া থেকেই অনেক মহা মূল্যবান বিবেচিত হতো বলেই অধ্যাপক দূর্গাদাস মহোদয়ের ছোট বক্তৃতার ব্যাখ্যাটি অনুরূপভাবে বুঝেছিলাম। যখন থেকেই আমি ‘জীবনের চেয়ে সময় অনেক মূল্যবান’ বাক্যটি আমার ব্রত হিসাবে নিয়েছি, তখন থেকেই নিজের জীবনে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছি, কিন্তু বাস্তবায়ন করতে পারিনি, যার পিছনে অনেক কারণ, ঘটনা অঘটনা, অযোগ্যতা, পারিপার্শ্বিক অবস্থান প্রভৃতি রয়েছে। তবুও শত প্রতিকূলতার মধ্যে জীবনের চেয়ে সময় অনেক মূল্যবান- একে অনুসরণীয় বাক্য হিসাবে গ্রহণ করেছি এবং প্রত্যাশা করি যে, ভবিষ্যত প্রজন্ম হয়তো আমার বিশ্বাসের উপর আস্থা জ্ঞাপন করে নিজ নিজ সময়কে যথাযথ মূল্যায়ন করে সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাবে। মানুষের দেহ, সুনাম, অর্থ, জমি, সন্তান, ব্যবসা, বাণিজ্য যেমন একটি সম্পদ, সময় (অর্থাৎ সময়ের সঠিক ব্যবহার) এর চেয়ে দামি সম্পদ বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সনদ প্রাপ্ত হয়ে ১৯৭৮ সালের ২৮ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ মহকুমা আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ গ্রহণ করে আমার পূর্বতন সংগঠন শ্রমিক, মানবাধিকার ও সামাজিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করি। সে সময়ে নারায়ণগঞ্জ পুরাতন কোর্ট মসজিদের উল্টো দিকে আমার একটি সুসজ্জিত মানসম্পন্ন আইন পেশার চেম্বার ছিল। আল্লাহর রহমতে উক্ত চেম্বারের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে নারায়ণগঞ্জের অনেক আইনজীবী এখন প্রতিষ্ঠিত (উল্লেখ্য, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তৎকালীন ক্ষমতাসীনেরা ১৯৯০ সালে চেম্বারটি জ্বালিয়ে দেয়)। ‘গণডাক’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা আমার সম্পাদনায় উক্ত সময়ে প্রকাশিত হতো। বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি পদে ৪ বছর দায়িত্ব পালন করে ১৯৮২ সালে অবসর গ্রহণের পর একটি মানবাধিকার সংগঠনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখার জন্য নারায়ণগঞ্জ বার লাইব্রেরিতে এলে, অনুষ্ঠান শেষে আপ্যায়নের জন্য আমার চেম্বারে আসার অনুরোধ করলে তিনি সদয় সম্মতি প্রদান করেন। সাথে আরো অনেকেই ছিলেন। তখন আমার চেম্বারে প্রবেশ পথে বড় করে লিখা ছিল, জীবনের চেয়ে সময় অনেক মূল্যবান, কথাটি দেখে অনেকেই টিপ্পনী কেটে বিভিন্নভাবে আলোচনা, সমালোচনা করতে থাকেন। কিন্তু আল্লাহর মেহেরবাণী সাবেক প্রধান বিচারপতি বললেন যে, ‘কথাটি সঠিক এবং কোরানিক দৃর্ষ্টিভঙ্গিতেও কথাটি দ্রুব সত্য।’ জীবনের প্রারম্ভে অর্থাৎ ১৯৬৮ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার পূর্ব থেকেই যে কথাটি আমি বিশ্বাস করতাম, শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক দূর্গাদাসের পর প্রধান বিচারপতির (সাবেক) পক্ষ থেকে স্বীকৃতি পেয়ে আশ্বস্থ হয়ে ছিলাম।

কোথাও থেকে সমর্থন না পেলেও জীবনের চেয়ে সময় অনেক মূল্যবান কথাটি আমার পেশাগত প্যাড (রাইটিং লেটার হেড), ভিজিটিং কার্ড, আমার ব্যবহৃত ইনভেলাপ, ছাপানো ফাইল এবং ব্যক্তিগত চেম্বারে লিখে রাখা অব্যাহত রাখি, এতে অনেক অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছি। মনে হয়েছে, পৃথিবীতে আমার এ বিশ্বাসকে একমাত্র আমিই বিশ্বাস করি, এমনকি নিকটস্ত লোকজন বিষয়টি নিয়ে এখনো প্রশ্ন করে, জীবন না থাকলে সময় কোন উপকারে আসবে? জবাবে আমি বলি, নিজ জীবন যদি যথাযথভাবে ব্যবহৃত না হয়, একটি জীবন যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিজ, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র বা জাতির কোনো উপকার বা কাজে না লাগে তবে সার্থকহীন জীবন নিয়ে বেঁচে থেকেই কি লাভ? জিজ্ঞাসা করতে চাই মানুষের জীবন বা জীবন কাল অর্থাৎ আয়ুষ্কাল বাড়ে না কমে? একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একজন মানুষের পৃথিবীতে আগমন ও প্রস্থান, যার নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে নাই। ফলে গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিতে হবে যে, বয়স বাড়ে না কমে? যে জিনিসটি স্বাভাবিক নিয়মে কমে যায় সে বিষয়টিই তো মূল্যবান? একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যদি জীবনকে সার্থক করে তুলতে হয় তবে অবসর বা আমোদ-আহ্লাদে, ফুর্তিতে সময় কাটানোর অবকাশ কোথায়? নিবিড়ভাবে আত্মদর্শন বা আত্মজিজ্ঞাসা থেকেই সার্বিক বিষয় আমাদের বোধোদয় হওয়ার কথা।

২০০১ সালের ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের (বিআরটিসি) চেয়ারম্যান পদে বিএনপি সরকার আমাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দান করে। ২০০৬ সালের ৫ নভেম্বর পর্যন্ত একটানা এ দায়িত্বে ছিলাম। চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে রাষ্ট্রীয় পরিবহনের অনেক বাস ট্রাক বহর তো বটেই, বিভিন্ন রুটে অনেক প্রাইভেট মালিকানাধীন বাস সার্ভিস আমাকে উদ্বোধন করতে হয়েছে। ঢাকা-আগরতলা আন্তর্জাতিক বাস সার্ভিস আমার তত্ত্বাবধানে, সক্রিয় প্রচেষ্টায় চালু হয়েছে। তখন দেখেছি যে, সরকারি ও বেসরকারি সকল পরিবহনের গায়ে লিখা ছিল ‘সময়ের চেয়ে জীবন অনেক মূল্যবান’ যা ছিল আমার বিশ্বাসের। অর্থাৎ ‘জীবনের চেয়ে সময় অনেক মূল্যবান’ কথাটির ঠিক উল্টো। যা বিশ্বাস করি না, তা মেনে নিয়েই দীর্ঘ পাঁচ বছর রাষ্ট্রীয় পরিবহনের কর্ণধারের দায়িত্ব পালন করাটা কঠিনই বটে। পরিবহন ব্যবস্থাকে কীভাবে ঢেলে সাজিয়ে যানজট ও দুর্ঘটনা মুক্ত করা যায়, এ মর্মে অধ্যাপক মরহুম ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে প্রধান করে বিএনপি সরকার উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে, যার একজন সদস্য হিসাবে বিশেষজ্ঞ কমিটির সভায় আমাকে উপস্থিত হতে হয়েছে। মিটিংয়ে যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সাথে আলোচনা হতো, রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থার প্রধান হিসাবে আলোচকের পরিবর্তে আসামীর কাঠগড়ায় (মানসিক) দাঁড়িয়ে আমাকে জবাব বা নিজের মতামত ব্যক্ত করতে হতো। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য চালকদের পর্যাপ্ত ট্রেনিংয়ের অভাবে দুর্ঘটনা বেশি হয় মর্মে বিশেষজ্ঞরা সুপারিশ প্রদান করলে দেশব্যাপী ড্রাইভিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করার জন্য বিআরটিসি’র উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। যেখানে বিআরটিসির ডিপো, কারখানা স্থাপনা প্রভৃতি ছিল, সে সব জেলায় উদ্যোগ নিয়ে ১৮টি ড্রাইভিং ট্রেনিং স্কুল চালু করি। যারা কথিত ‘ওস্তাদ’ ধরে ড্রাইভিং শিখেছে তাদের বিভিন্ন সেন্টারে ট্রেনিং দিয়ে পরীক্ষা নিয়ে সনদপত্র প্রদান করি, মহাব্যবস্থাপক (ট্রেনিং) সার্টিফিকেট স্বাক্ষর করতেন, যাতে চেয়ারম্যান হিসাবে আমি প্রতিস্বাক্ষর দিয়েছি, যাতে কোন ভুয়া সার্টিফিকেট ইস্যু না হয়। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে বিআরটিসি’র ড্রাইভিং ট্রেনিং ইন্সটিটিউট ছাড়া সরকারি অন্য কোনো এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান ছিল না, যাতে পর্যাপ্ত ট্রেনিং নিয়ে কারিগরি প্রাথমিক জ্ঞান সম্পন্ন একজন দক্ষ ড্রাইভার গড়ে উঠতে পারেন, যার অটোমোবাইল জ্ঞানসহ রাস্তায় দায়িত্ব নিয়ে গাড়ি চালানোর সচেতনা ও অভিজ্ঞতা থাকতে পারে। ভাবতে অবাক লাগে যে, আমাদের দেশে মেক্সিমাম ড্রাইভিং লাইসেন্সই দুই নাম্বার। গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা থাক বা না থাক টাকা দিলেই ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায়। সরকারি উচ্চ পদস্থ অনেক কর্মকর্তার ড্রাইভারের লাইসেন্স দু’নম্বর, এমন অনেক তথ্য পেয়েছি। Colour Blind ব্যক্তির গাড়ি চালানো নিষেধ থাকা স্বত্তে¡ও অনুরূপ অনেক ড্রাইভার পেয়েছি যারা ‘রাত কানা’ রোগ থাকা স্বত্তে¡ও ড্রাইভিং করে যাচ্ছে। প্রতি বছর গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করার বিধান চালু থাকলেও বাংলাদেশে ড্রাইভারদের শারীরিক ফিটনেস পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। আইএলও’র বিধান মতে, এক টানা ৮ ঘণ্টার বেশি পরিশ্রম করার বিধান নেই। অথচ লং রুটে একটানা ১০/১২ ঘণ্টা, অধিকন্তু যানজট প্রভৃতির কারণে ড্রাইভারগণ মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম করার কারণে চলন্ত অবস্থায় গাড়ির ড্রাইভিং সিটেই ঘুমিয়ে পড়ে। ফলে সংগঠিত হয় মারাত্মক, মারাত্মক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানী। মাদকাসক্ত হয়ে গাড়ি চালানো, চলন্তাবস্থায় মোবাইলে কথা বলা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। যাহোক, অভিজ্ঞতার আলোকে আমি একথাগুলি বললেও আমার মূল আলোচনা সময়ের মূল্যায়ন নিয়ে।

সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বাংলাদেশ পৃথিবীর যে কোনো রাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে। কোনো সরকারই এ মহামারীকে রোধ করতে পারেনি, বরং দিন দিন জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমতাবস্থায়, যাত্রী, পথচারীদের সচেতন রাখার জন্যই প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে উদ্যোক্তারা ‘সময়ের চেয়ে জীবন অনেক মূল্যবান’ কথাটি প্রতিটি পরিবহনের বডিতে লিখে রেখেছে, যা উদ্যোক্তাদের মতে যথার্থ। কিন্তু আমার বিচার বিশ্লেষণ ও বিশ্বাস মতে, ‘জীবনের চেয়ে সময় অনেক মূল্যবান।’ যদিও ‘জীবনের চেয়ে সময় অনেক মূল্যবান’ শ্লোগানটি পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। মাঝে মধ্যে মনে হয়েছে যে, ‘দুর্ঘটনা রোধে সাবধানতা অবলম্বন করুন’, ‘তাড়াহুড়া করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেবেন না’, ‘গাড়িতে উঠা নামায় নিজে সচেতন হউন, অপরকে সাবধান করুন’, ‘চলার পথে তাড়াহুড়া আপনার মৃত্যু ডেকে আনবে’ প্রভৃতি বাসের বডিতে লেখার চিন্তা করেও নানা কারণে অগ্রসর হইনি। ঢাকাকে বায়ু দূষণমুক্ত করার জন্য বিএনপি সরকার ডিজেল চালিত বেবি টেক্সির পরিবর্তে সিএনজি চালিত বেবি টেক্সি চালু করার সিদ্ধান্ত নিলে সেখানেও ব্যাপক ভূমিকা রাখতে হয়। ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগটা শহরে অন্যান্য উচ্চপদস্থ আমলাদের সাথে পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি সাধনের জন্য আমাকে উচ্চতর ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়। ট্রেনিং থেকে যা বুঝলাম, দুর্ঘটনার জন্য শুধু ড্রাইভার, পথচারী বা যাত্রী দায়ী নয়। এর অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট গাড়ির মেশিনারিজ ত্রু টি, তাছাড়া রাস্তা শাসন বা সড়ক নিয়ন্ত্রেণের জন্য একটি শক্ত ম্যানেজমেন্ট সড়ক দুর্ঘটনা রোধে অত্যান্ত জরুরি। আমাদের দেশে নদী শাসনের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, কিন্তু রাস্তা শাসনের যে প্রতিষ্ঠান রয়েছে তারাই মাসোহারা গ্রহণ করে সড়কে শৃঙ্খলা আনার পরিবর্তে নিজেদের ভাগ্য গড়ে নিচ্ছে। এ ট্রেনিং থেকে একটি বিষয় আমার বদ্ধমূল ধারণা হলো, যে সড়কে দ্রুতযান ও ধীরে চালিত যান এক সাথে চলে সে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটনার অনেক কারণ রয়েছে। আমাদের দেশে বাস, ট্রাক, নছিমন, করিমন, ভটভটি, বেবি টেক্সি এমনকি রিক্সা ও ঠেলাগাড়ি পর্যন্ত একই রাস্তায় চলে। বোগটা ট্রেনিংয়ে মূল সুপারিশ নিম্নরূপ ছিল:

(ক) প্রত্যেকটি শহরে ২/১টি রাস্তা সংরক্ষিত রাখতে হবে, যা শুধু সাইকেল চলাচলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
(খ) সপ্তাহে অন্তত একদিন শহরে যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখে শুধুমাত্র সাইকেল আরোহী ও পথচারীদের জন্য উন্মুক্ত থাকতে হবে (জরুরি সার্ভিস ব্যতীত)।

(১) এতে একদিকে শহরের বায়ু দূষণমুক্ত হতে সহায়ক হবে, অন্যদিকে নাগরিকদের শারীরিক ফিটনেস বাড়বে, (২) দ্রুত যান ও ধীরে চালিত যানবাহনের জন্য রাস্তায় আলাদা আলাদা লেইন থাকতে হবে, (৩) সড়ক শাসনের অর্থাৎ সড়কে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য শক্তিশালী ম্যানেজমেন্ট এবং (৪) যানবাহন ও চালকদের শারীরিক ফিটনেস নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে। এমনিভাবে বিআরটিসির চেয়ারম্যান হিসাবে আমার ৫টি বছর কেটে গেলো। ১/১১ সরকার ক্ষমতায় এসে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দুই নেত্রীসহ অনেক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে আমাকে কারাগারে আবদ্ধ রাখে ২৬ মাস, ১/১১ সরকারের দৃষ্টিতে নারায়ণগঞ্জের লোকজনকে বিআরটিসিতে চাকরি দেয়ার অপরাধ, কোনো দুর্নীতি প্রমাণ না হওয়ায় ২০১৮ সালে হাইকোর্ট থেকে নির্দোষ প্রমাণিত হই। তবে এটাই আমার প্রথম বা শেষ কারাবাস নয়, আগে পরে অনেক বার কারারুদ্ধ হতে হয়েছে, মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়েছি, একই ব্রাসফায়ারে সাথী ইব্রাহিম নিহত হয়, বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ হয়েছে, আত্মগোপনে চলে যেতে হয়েছে বহুবার। এ নিয়ে পরবর্তীতে হয়তো আলোচনা করা যাবে, এখন মূল আলোচনায় ফিরতে চাই।

ফকির লালন শাহ বলেছেন যে, ‘সময় গেলে সাধন হবে না।’ কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করে হে প্রভু।’ সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের আধার দুই পন্ডিত ব্যক্তির বক্তব্যে এটাই প্রমাণিত হয় যে, সর্ব ক্ষেত্রে ‘সময়ই’ একটি ফ্যাক্টর। অথচ সময়কে যথাযথ মূল্যায়ন করাকেই আমরা ভুলে গেছি।

আল্লাহপাক বলেছেন যে, ‘মানুষকে আমি শ্রম নির্ভর করেই সৃষ্টি করেছি’ (সূরা-বালাদ, আয়াত-৪)। এর অর্থ কী দাঁড়ায়? বিত্তবান বা রাজা বাদশাহ বা ক্ষমতাবান হলেই আরাম-আয়াসে, আমোদ-ফুর্তিতে সময় অপচয় করার জন্য নির্দেশ আল্লাহপাক দেন নাই, বরং শ্রমনির্ভর হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। অবসর সম্পর্কে বলেছেন যে, ‘যখনই তুমি অবসর পাবে, তখনই কঠোর ইবাদতে রত হও, আর তোমার রবের প্রতি আকৃষ্ট হও’ (সূরা ইনশিরাহ: ৭-৮)। সময়ের সদ্ব্যবহারের জন্য আল কোরআনে আরো অনেক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জীবন

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন