Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্ভাবনার দিগন্তে চা শিল্প

প্রকাশের সময় : ৫ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সোয়া ২ হাজার কোটি টাকার বাজার : উত্তর ও পার্বত্য জনপদে বাড়ছে আবাদ
শফিউল আলম : অর্থকরী ও ঐতিহ্যবাহী চা শিল্পখাত এখন সম্ভাবনার নতুন দিগন্তে উপনীত হয়েছে। চায়ের অভ্যন্তরীণ ও রফতানি বাজার চাহিদাকে ঘিরেই এই উজ্জ্বল সম্ভাবনা রচিত হচ্ছে। সুদূর অতীতকালে এদেশের মসলিন কাপড় কিংবা নিকট অতীতে পাট-চামড়া শিল্পের মতোই সুপ্রাচীন শিল্প ও বাণিজ্য খাত চা। সগৌরবে এগিয়ে চলেছে সম্ভাবনার হাতছানি দিয়ে। চা শিল্প এখন আর অবহেলিত নয়। প্রচলিত এই রফতানি পণ্যটি তার সুবিশাল বাজার সহসাই ফিরে পেতে পারে। দীর্ঘদিন যাবৎ চা শিল্প খাতকে উপেক্ষা, অবহেলার কারণে কালের বিবর্তনে হারাতে যাচ্ছিল তার সুখ্যাতি। এবার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের জন্য সময়োপযোগী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যাতে বনেদি চা শিল্প অচিরেই ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
জাতীয় অর্থনীতিতে শ্রমনিবিড় চা খাত রাখবে আরও ব্যাপক অবদান, এমনটি প্রত্যাশা শিল্পোদ্যোক্তাদের। কেননা স্থানীয় (অভ্যন্তরীণ) ও আন্তর্জাতিক বাজারে চায়ের চাহিদা ও দাম দুইই বেড়ে চলেছে। চট্টগ্রামস্থ দেশের অর্ধশতাব্দীরও বেশি প্রাচীন আন্তর্জাতিক চা নিলাম বাজার অনলাইনের মাধ্যমে পরিচালনাসহ অত্যাধুনিক ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে চায়ের রয়েছে প্রায় সোয়া ২ হাজার কোটি টাকার জমজমাট বাজার। সেই সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিস্তৃত হচ্ছে চায়ের আবাদ। এমনকি চট্টগ্রামের মিরসাইয়ের পাহাড়-টিলাভূমিতেও চা চাষের সম্ভাবনা ফুটে উঠেছে। এতে রয়েছে আরও ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে চা আবাদ ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায়। এ বছর দেশে সাড়ে ৬ কোটি কেজির কাছাকাছি অর্থাৎ রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদিত হয়েছে। চায়ের প্রধান আবাদক্ষেত্র বৃহত্তর সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে এবার প্রাক-বর্ষা ও বর্ষায় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত চায়ের ফলন, উৎপাদনে সহায়ক হয়েছে। শতাব্দী প্রাচীন চা শিল্পখাত টিকে আছে এর সাথে জড়িত বনেদী উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতা ও পেশাদারী উদ্যমী মনোবলের পাশাপশি কয়েক লাখ চা শ্রমিকের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে।    
বাংলাদেশ চা বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তারা জানান, পরিমিত হারে বৃষ্টিপাত, উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক পদক্ষেপ, নতুন নতুন চা আবাদের এলাকা সম্প্রসারণ, উন্নততর ক্লোন চায়ের চারা লাগানোর হার বৃদ্ধি, সীমিত আকারে হলেও শ্রমিকদের প্রণোদনা প্রদানের ফলেই এবার বাম্পার পরিমাণ চা উৎপাদিত হয়েছে। গত ১০ বছরে দেশের উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরে প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে চায়ের বাড়তি আবাদ ও উৎপাদন করা হয়েছে। সেখানে উন্নততর ক্লোন জাতের চায়ের চারাগাছ লাগানো হয়েছে, ফলনও দিচ্ছে ভাল।  
তবে অভিজ্ঞ চা বাগান মালিক ও শিল্পোদ্যোক্তাদের মতে, দেশে ও বিদেশে চা পানের চাহিদা ক্রমাগত বাড়লেও সেই সমানুপাতে বাংলাদেশে বাড়ছে না চায়ের উৎপাদন। স্থানীয়ভাবে চা পানের চাহিদা বার্ষিক ৫-৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উৎপাদন খরচ ও চাহিদা বৃদ্ধির সমানুপাতে অভ্যন্তরীণ বাজারদর সারাবছরই থাকে বেশ চাঙ্গা। বর্তমানে ভাল মানের বিশেষত ক্লোন, কাজী ব্রান্ডের চাপাতার দাম প্রতিকেজি ৩৮০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা। সীমিত উন্নতমানের অর্গানিক ও গ্রীন টি বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭৫০ টাকায়। সেই চা চলে যাচ্ছে লন্ডন শহরসহ বিশ্বের অনেকগুলো শহরের চা রসিকদের কাছে। অথচ চায়ের আবাদ ও উৎপাদনে এক ধরনের স্থবিরতা এখনও কাটেনি। ঐতিহ্যবাহী প্রচলিত পণ্যটির রফতানি ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে এখন মাত্র ১.৫৫ ভাগে নেমেছে। তাও আবার রফতানিকারক অথবা তাদের কোটা ব্যবহার করে স্থানীয় প্যাকেটিয়াররা চা কিনে নিয়ে থাকে। আর ৯৮.৪৫ শতাংশ চা কিনছেন স্থানীয় ভোক্তারা। রফতানি সংকুচিত হতে হতে এখন প্রায় শূন্যের কোটায়। আর বাংলাদেশী চায়ের বাজার নীরবে আয়ত্ত করে নিয়েছে অন সব দেশ। বরং দেশে সীমিত পরিসরে চা এখন আমদানি করা হচ্ছে, যার বেশিরভাগই নি¤œমানের। দেশের প্রচলিত ও ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে সুরক্ষা দেয়ার স্বার্থে চা আমদানিতে অধিক হারে শুল্কারোপসহ কড়াকড়ির তাগিদ দিয়েছেন এ খাতের শিল্পোদ্যোক্তারা।    
এদিকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ৬৭ বছরের সুপ্রাচীন আন্তর্জাতিক চা নিলাম ট্রেডে বিদেশি আমদানিকারক কিংবা তাদের প্রতিনিধিরা তেমন কেউ এখন আর অংশ নেয় না। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান, রাশিয়ার মতো বাংলাদেশে উৎপাদিত চায়ের প্রধান সবক’টি ক্রেতাদেশ দীর্ঘদিন বাজার থেকে উধাও। এর পেছনে রয়েছে প্রধানত চারটি কারণ। তা হলোÑচায়ের স্থানীয় বাজার দর চড়া থাকা, হাইব্রিড জাতের চায়ের আবাদ প্রসারে এখনও অনগ্রসরতা, আধুনিক যুগোপযোগী প্রযুক্তি ও গুণগত মানের উৎকর্ষ (রঙ, ঘ্রাণ ও স্বাদ) বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক উদ্যোগের অভাব, উৎপাদনে স্থবিরতা এবং বাংলাদেশে উৎপাদিত চায়ের আন্তর্জাতিক বাজারে আকর্ষণ বা ভালো অবস্থান তৈরির লক্ষ্যে ‘ব্র্যান্ড নেইম’ (যা রফতানিমুখী গার্মেস্টস খাতের অনুরূপ) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রফতানি মূল্য বৃদ্ধির ব্যাপারে সমন্বিত প্রচেষ্টার অভাব। তবে ইতোমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এর নিয়ন্ত্রিত চা বোর্ড সার্বিক দক্ষতা, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিয়ে দেশের অন্যতম প্রধান শ্রমনিবিড় খাত চা শিল্পের কাক্সিক্ষত বিকাশের জন্য গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। তবে বোর্ডের আওতায় চা গবেষণা ইনস্টিটিউটকে (বিটিআরআই) আরও সক্রিয় ও গতিশীল গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা, এর জনবল সংকট নিরসন এ মুহূর্তে আশু করণীয় বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। এককালে বিটিআরআই উদ্ভাবিত উন্নত জাতের (সিলেক্টিভ স্পেশাল) চা বিক্রি হয় সর্বোচ্চ সোয়া দু’ হাজার টাকা কেজি দরে। সেই দিন এখন অতীত।  
বাংলাদেশে উৎপাদিত চা দু’দশক আগেও বিশ্বের ২০-২২টি দেশে রফতানি করা হতো নিয়মিতভাবে। অন্যতম প্রধান ক্রেতাদেশ পাকিস্তান, আফগানিস্তান, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সিআইএসভুক্ত দেশগুলো, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহ, মিসর, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ড দীঘদিন ধরে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা বিকল্প চা উৎপাদক দেশগুলোর দিকেই ঝুঁকে পড়েছে। বাংলাদেশ থেকে চা কেনার জন্য পুরনো ক্রেতা বিভিন্ন দেশ শুল্কমুক্ত রফতানি, অগ্রিম পেমেন্টসহ সুযোগ-সুবিধা ঘোষনা করলেও তা কাজে আসেনি। বর্তমানে বিশ্বের ১৭টি চা রফতানিকারক দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৫ নম্বরে কোনোমতে টিকে আছে।
অথচ পঞ্চগড় জেলাসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে একদা যেখানে তামাকের চাষ হতো সেসব এলাকায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাণিজ্যিকভিত্তিতে চায়ের আবাদ বিস্তৃত হচ্ছে। এর ফলে চা শিল্প বিকাশের সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছে। নতুন নতুন এলাকায় গড়ে ওঠা চা বাগানে উন্নতমানের ফলনও পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারিখাতের সমন্বিত উদ্যোগ নিয়োজিত হলে এবং সম্ভাব্য সবরকম সুযোগ ও সম্ভাবনাকে সদ্ব্যবহার করা হলে চা শিল্পখাতটি জাতীয় অর্থনীতিতে আগামীতে অধিক অবদান রাখতে সক্ষম হবে। সেইসঙ্গে প্রান্তিক কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মোচিত হবে।
দেশে মোট ১৫৮টি চা বাগানের জমি রয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার ১৭০ একর। যার অধিকাংশই বৃহত্তর সিলেটে অবস্থিত। এরপর রয়েছে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও উত্তরাঞ্চল। অনেক বাগানের বিরাট অংশই চা চাষের আওতায় নেই। তাছাড়া বিশ্বে ধান, গমের মতো অনেক ফসলের মতোই উচ্চ ফলনশীল ও উন্নতজাতের চায়ের আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তির সমাহারে ভারত, মালয়েশিয়া, কেনিয়া, শ্রীলঙ্কার মতো বিভিন্ন চা উৎপাদনকারী দেশে চা শিল্প অনেকদূর এগিয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে রয়েছে। এসব কারণে বার্ষিক উৎপাদন ৬ কোটি কিংবা সাড়ে ৬ কোটি কেজিতেই ওঠানামা করছে। চা শ্রমিকদের জীবনধারণ এবং জীবনযাত্রার মান বলতে গেলে নাজুক। তাছাড়া দেশে বৈরী আবহাওয়া সহনশীল ভাল জাতের চায়ের আবাদ বৃদ্ধি বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ অবস্থায় টেকসই চা চাষ প্রসারকল্পে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে উদ্যোক্তারা মনে করেন। বিশ্বজুড়ে ক্রেতারা চায়ের রঙ, ঘ্রাণ ও স্বাদÑএই তিনটি বিষয়ে গুণগত মান উন্নত করার ওপরই জোরালো তাগিদ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে চা শিল্প ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেও যুগোপযোগী আধুনিকায়ন ও প্রত্যাশিত মানে উন্নীত হয়নি। তবে সুযোগ-সম্ভাবনা রয়ে গেছে অপার।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সম্ভাবনার দিগন্তে চা শিল্প
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ