Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার সম্পর্ক

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২১ আগস্ট, ২০২০, ১২:১০ এএম

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আমার জন্ম একই বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় হওয়ার কারণে অনেকেরই ধারণা, আমাদের দু’জনের মধ্যে বুঝি দীর্ঘদিনের পরিচয় ছিল। কিন্তু এ ধারণা যে সম্পূর্ণ সঠিক নয়, তার একাধিক কারণ আছে। প্রথমত: আমাদের দু’জনের মধ্যে পারিবারিক ঐতিহ্যগত অবস্থার পার্থক্য। তিনি জন্মগ্রহণ করেন এক জোতদার পরিবারে। আমি জন্মগ্রহণ করি এক ধর্মপ্রাণ কৃষিজীবী পরিবারে। দ্বিতীয়ত: আমাদের দু’জনের শিক্ষা জীবনের পার্থক্য। তিনি গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতা চলে গিয়ে ইসলামিক কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হন এবং সেই কলেজ থেকেই বিএ পাস করেন।

কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ছাত্র থাকা কালেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দীর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার মাধ্যমে। অবিভক্ত বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের মধ্যে তখন দু’টি পরস্পরবিরোধী গ্রুপ ছিল। একটি মওলানা আকবর খাঁ-খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন, আরেকটি সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের নেতৃত্বাধীন। শেখ মুজিব ছিলেন দ্বিতীয় গ্রুপের অন্তর্গত।

ইতিহাসের পর্যবেক্ষক মাত্রই জানেন, অবিভক্ত ভারতবর্ষ অখন্ড ভারত হিসাবে স্বাধীন হবে, না হিন্দু প্রধান ও মুসলিম প্রধান এলাকা নিয়ে দুটি আলাদা রাষ্ট্র হিসাবে স্বাধীন হবে, এ নিয়ে বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের দুই প্রবীণ দল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস ও অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। কংগ্রেস অখন্ড ভারতের সমর্থক হলেও মুসলিম লীগ হিন্দু ও মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে আলাদা আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিল। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস মুসলিম লীগের দাবি মেনে নেয়। তবে কংগ্রেস নেতাদের বিশ্বাস ছিল দেড় হাজার মাইল ব্যবধানে দুটি স্বতন্ত্র ভৌগোলিক ভাগে বিভক্ত এ রাষ্ট্র বেশি দিন টিকবে না, অচিরেই ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। বিশেষ করে আজ যে এলাকায় বাংলাদেশ নামের স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র অবস্থিত তার চারদিকেই অমুসলিম অধ্যুষিত জনপদ থাকায় তাদের এ মতামতকে অনেকেই বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু এক্ষেত্রে বাস্তবতা ছিল তাদের এসব মতামতের পরিপন্থী। এর কারণও ছিল।

বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষের শেষ দিনগুলোতে আজ যেসব অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান নামের স্বাধীন রাষ্ট্র অবস্থিত সেসব অঞ্চলের কোনো প্রদেশেই মুসলিম লীগ সমর্থিত সরকার ছিল না। তখন একমাত্র অবিভক্ত বাংলায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন সরকার থাকার কারণে কায়েদে আজমের পাকিস্তান দাবির প্রতি সমর্থন যুগিয়ে চলতে সক্ষম হয়েছিল। ঊনিশশ’ সাতচল্লিশের চৌদ্দই আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান নামের স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার সময় ঢাকা ছিল একটি জেলা শহর মাত্র। স্বাভাবিক কারণে নবজাত পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রথম রাজধানী নির্বাচিত হয় করাচি। পরবর্তীকালে অবশ্য রাওয়ালপিন্ডি অস্থায়ী রাজধানী হিসাবে ঠিক হয় এবং স্থায়ী রাজধানী হিসাবে নির্বাচিত হয় ইসলামাবাদ। সমগ্র পাকিস্তানের জনসংখ্যার অধিকাংশ ছিল পূর্ব বাংলার অধিবাসী। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের প্রাক্কালে আসাম প্রদেশের সিলেট ছিল মুসলিম প্রধান এবং তারা ছিল সবাই বাংলাভাষী। এই সিলেট পাকিস্তান তথা বাংলার সাথে যোগ দেবে নাকি ভারতে যোগ দেবে এ প্রশ্নে সিলেটে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এ গণভোটে যোগদানের সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।

ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেম নিজে গণভোটে যেতে না পারলেও তমদ্দুন মজলিসের অন্যতম সহ-প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সিলেট গণভোটে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অধ্যাপক আবুল কাসেম তাঁকে বলেছিলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রকে সার্থক করার উদ্দেশ্যে তারা একটি আদর্শবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠন (তমদ্দুন মজলিস) প্রতিষ্ঠার চিন্তা-ভাবনা করছেন। এরকম চিন্তার কোনো ব্যক্তির সাক্ষাৎ পেলে তাকে যেন জানান এবং ওই ব্যক্তিকে সাথে ঢাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে যেন অনুরোধ করেন। সেই অনুরোধের আলোকেই পাকিস্তান সৃষ্টির অল্পদিন পর বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক শাহেদ আলী ঢাকায় এসে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং এক পর্যায়ে ১৯ নং আজিমপুর রোডস্থ অধ্যাপক আবুল কাসেমের বাসায় ওঠেন।

এদিকে আমার সাথে ঢাকার বংশাল রোডস্থ বালিয়াদি প্রিন্টিং প্রেসে অধ্যাপক আবুল কাসেমের প্রথম সাক্ষাৎ হলেও তাঁর কথাবার্তা আমাকে তেমন আকৃষ্ট করতে পারেনি। অন্যদিকে কলিকাতা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় অধ্যাপক কথাশিল্পী শাহেদ আলীর একাধিক গল্প পাঠ করে আগে থেকেই আমি তাঁর মুগ্ধ পাঠক ছিলাম।

উনিশশ’ সাতচল্লিশ সালের চৌদ্দই আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আমি প্রথমে অর্থনীতিতে ও পরে বাংলা অনার্সে ভর্তি হই। সে সময়ে একদিন তমদ্দুন মজলিসের অঘোষিত মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার সম্পাদক এনামুল হকের সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় সূত্রে (তাঁর বাড়ি বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী থানার দুর্গাপুর গ্রামে হওয়ার সুবাদে) একদিন তিনি আমার সাথে কথাশিল্পী শাহেদ আলীর পরিচয় করিয়ে দেন। এর পর আমি সুযোগ খুঁজছিলাম তাঁর সাথে অন্তরঙ্গ আলোচনার। ইতোমধ্যে একদিন আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার জায়গীর বাড়ি (ভাটির মসজিদের কাছে) ফেরার পথে দেখতে পেলাম পলাশী ব্যারাকের কাছে একটা চায়ের দোকানে তিনি চা পান করছেন। যদিও আমার চা খাওয়ার অভ্যাস ছিল না, তবু আমি চা খাওয়ার নামে তাঁর পাশের চেয়ারে বসে পড়লাম। চা পান শেষে তিনি আজিমপুর আম বাগানের (এখন সেখানে আজিমপুর কলোনী) ভেতর দিয়ে নিয়ে গেলেন অধ্যাপক আবুল কাসেমের ১৯ নং আজিমপুরস্থ ভাড়া করা বাসায় এবং জানালেন, তিনি আপাতত এখানেই থাকেন। আমিও তাঁকে নিয়ে গেলাম ভাটির মসজিদের নিকট আমার জায়গীর বাড়ি। আমি আশ্চর্যের সাথে অবিষ্কার করলাম, এই ১৯ নং আজিমপুর রোডের আবুল কাসেম সাহেবের বাসার পাশ দিয়েই প্রত্যেক দিন আমি বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া আসা করি। এরপর থেকে কবে যে আমি শাহেদ আলীর প্রভাবে তমদ্দুন মজলিসের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে উঠলাম, তা নিজেও বুঝিয়ে বলতে পারব না।

এরপর ১৯৫০ সালে তমদ্দুন মজলিসের এক সভায় তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেম বললেন, তমদ্দুন মজলিসের মতো আদর্শবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্য এমন একজন একনিষ্ঠ কর্মী প্রয়োজন, যিনি জীবনে কোনো চাকরি করবেন না, বিবাহ বা সংসার করবেন না, শুধু আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবন বিলিয়ে দেবেন। তিনি আরও বললেন, তিনি নিজেই এ কাজে ব্রতী হতে পারতেন যদি তাঁর পরিবার-স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে না থাকত। তখন তমদ্দুন মজলিসের অন্যতম কর্মী বিশিষ্ট সাহিত্যিক-সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী অধ্যাপক আবুল কাসেমের বোন রহিমা খাতুনকে বিবাহ করায় তার নাম উঠলো না। কথাশিল্পী শাহেদ আলীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বললেন, তিনি সংসারের বড় ছেলে হওয়াতে তাঁর দায়িত্ব অনেক। তাঁকে চাকরি করতে হবে। তাই তমদ্দুন মজলিসের সার্বক্ষণিক কর্মী হওয়া সম্ভব হবে না। অগত্যা আমার ওপর সবার নজর পড়লো। আমিও সরল মনে রাজি হয়ে গেলাম এই কঠিন দায়িত্ব পালনে। ফলে আমাকে পরবর্তী দিনই জায়গীর বাড়ি ত্যাগ করে চলে আসতে হলো ১৯ নং আজিমপুর রোডে এক বিশাল আদর্শিক দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে।

অবশ্য আমার এ অকল্পনীয়-অবাস্তব দায়িত্ব পালন বেশি দিন করতে হয়নি। কারণ, ইতোমধ্যে আমার এ মনোভাবের কারণে আমার আব্বা ভীষণভাবে ভেঙে পড়েন এবং কয়েক বিঘা জমি বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আর তাঁকে হজ্জে যাবার জন্য চট্টগ্রাম পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। তাঁকে হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে জাহাজে তুলে দেয়ার সময় তিনি যেমন করুণভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন তাতে আমার মনে ভীষণ আঘাত লাগল এবং আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আব্বাকে সন্তুষ্ট করে তুলতে আমার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে হবে।

সেই হিসাবে আমি ১৯৬২ সালে সামাজকল্যাণ বিষয়ে মাস্টার ডিগ্রি লাভ করেছি এবং তাঁর পূর্বে ১৯৫০ সালের ২৪ ডিসেম্বর আমি বিবাহ পর্বও সমাধান করেছি। পরবর্তীতে একটি পরিবার প্রধান হয়ে তিন মেয়ে ও তিন ছেলের পিতা হয়েছি। আমি চেষ্টা করেছি আমার সন্তানদের যথাসাধ্য উচ্চ শিক্ষা দিতে। আমার প্রথম সন্তান মেয়ে। সে একজন এমবিবিএস ডাক্তার। তার বিয়ে হয়েছে। তার বড় মেয়েও একজন ডাক্তার। তাদের স্বামীরাও চিকিৎসক। আমার বড় ছেলে সাংবাদিক, মেঝো ছেলে সরকারি অফিসার। আমার মেঝো মেয়ে বিএসসি পাশ করে অসুস্থতার জন্য আর পড়তে পারেনি। তবে আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পর সে আমার সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করছে। মোটামুটিভাবে বলতে গেলে আমার তিন মেয়ে তিন ছেলে নিয়ে আমার পারিবারিক জীবনে এই বৃদ্ধ বয়সে আমি বাসায়ই আছি বলা চলে। এজন্য আমার হাজার শোকর গোজারি করতে হয় আল্লাহর দরবারে।

আজকের এ লেখা শুরু করেছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আমার সম্পর্ক নিয়ে। যদিও আমার জীবনের বেশিরভাগ কেটেছে সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। সে হিসাবে আমি দেশের একজন প্রবীণ সাংবাদিক ও ভাষা সৈনিক হিসাবে বহুলভাবে পরিচিত। এই ভাষা আন্দোলন সূত্রেই আমার অন্তরঙ্গ পরিচয় গড়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। আমি নব্বইঊর্ধ্ব জীবনে এখনও অনেকটা সুস্থ জীবনই যাপন করতে পারছি। আর বঙ্গবন্ধু আমার চাইতে বয়সে বড় হলেও আমার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এজন্য আমি আন্তরিক শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি তাঁর শোকার্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি। আমি বঙ্গবন্ধুর রূহের মাগফিরাত কামনা করছি সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার কাছে। আর আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যতদিন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে পৃথিবীতে টিকে থাকবে ততদিন এদেশের ইতিহাস থেকে কেউই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম মুছে ফেলতে পারবে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বঙ্গবন্ধু

৮ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন