Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জোয়ারে ভাসছে উপক‚ল

নোনা পানি ঢুকলে জমিতে ৪ থেকে ৫ বছর ফসল হয় না

ইনকিলাব রিপোর্ট | প্রকাশের সময় : ২১ আগস্ট, ২০২০, ১১:৫৯ পিএম

# বেড়িবাঁধ সময় মতো মেরামত করা হয়নি : # দক্ষিণাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত


টানাবর্ষণ ও অমাবশ্যার অস্বাভাবিক জোয়ারে তলিয়ে গেছে গোটা উপলক‚লীয় অঞ্চল। অনেক স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। ভেসে গেছে মানুষের বসত বাড়ি, পুকুরের মাছ, নষ্ট হয়েছে আউশ ধানসহ ক্ষেতের অন্যান্য ফসল। বিভিন্ন সময় ঝড়-জলোচ্ছ¡াসে ক্ষতিগ্রস্ত উপক‚লীয় এলাকার বেড়িবাঁধ মেরামত না করায় এসব অঞ্চলে জোয়ারের পানি সহজেই ঢুকে প্লাবিত করে বিস্তীর্ণ এলাকা। এতে বছরের পর বছর ধরে উপক‚লবাসীর চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। জোয়ারের লোনা পানি একবার ফসলের জমিতে ঢুকলে সে জমিতে ৪ থেকে ৫ বছর আর ফসল ফলে না। এতে ওই এলাকার মানুষের অভাব অনটন বাড়তে থাকে।
২০০৯ সালে প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড় আইলার তাÐবের পর নার্গিস, বুলবুল, ফনী এসব ঝড়ের পর সর্বশেষ এ বছর আম্পানের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় উপক‚লীয় এলাকা। ঝড় ও জলোচ্ছ¡াসে উপক‚লের যে ক্ষতি হয় তা সহজে কাটিয়ে ওঠা যায় না। আইলায় উপক‚লীয় অঞ্চলের বেড়িবাঁধ ভেঙে যে সব অঞ্চলে লোনা পানি ঢুকে ছিল সেসব এলাকার জমিতে পাঁচ বছরেও ফসল ফলেনি। পুকুরে লোনা পানি ঢুকে পড়ায় সে পানি ব্যবহার করা যায়নি। আইলার কারণে খুলনার কয়রা ও দাকোপ উপজেলার অনেক এলাকা এখনও প্রায় ফসলশূন্য। বিকল্প কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় মানুষের অভাব অনটন বেড়েই চলেছে। এভাবে প্রতিবারই ঝড়-জলোচ্ছ¡াসের পর ফসলি জমিতে লোনা পানি ঢুকে পড়ায় তাতে কয়েক বছর কৃষক আর ফসল ফলাতে পারে না। বৃষ্টির পানিতে এ লবণাক্ততা দূর হতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন বছর সময় লাগে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক পানিসম্পদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, আইলা কিংবা সিডরের পর ভাঙা বেড়িবাঁধ দ্রæত মেরামত করতে দেখা যায়নি। জোয়ারের পানি ঢুকে ফসলি জমি লবণাক্ত করেছে। এসব জমিতে চার-পাঁচ বছর ফসল হয়নি। স্থানীয় জনগণের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। আম্পানে উপক‚লে বাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সে সব দ্রæত মেরামত করা হয়নি বলে এবার জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে উপক‚লীয় অঞ্চল। এর ফলে পরিবেশ বিপর্যয় ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
চট্টগ্রাম থেকে রফিকুল ইসলাম সেলিম জানান, প্রবল জোয়ারে ভাসছে বন্দরনগরীর বিশাল এলাকাসহ উপক‚লীয় জনপদ। দেশের অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, আগ্রাবাদ, হালিশহরসহ নগরীর বিশাল এলাকা জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে। এসব এলাকার গুদাম, আড়ত, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। তাতে দেশের সবচেয়ে বড় ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চাক্তাই, খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সরকারি ছুটির দিনেও জোয়ারের পানি থেকে মালামাল রক্ষায় ব্যস্ত ছিলেন ব্যবসায়ী, আড়ত ও গুদামের মালিকরা। নগরীর বৃহত্তর আগ্রাবাদ, হালিশহর, পাহাড়তলী, চান্দগাঁওসহ নগরীর বেশিরভাগ এলাকা হাঁটু সমান পানিতে ভেসে যায়। আগ্রাবাদ মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের নিচতলা তলিয়ে যাওয়ায় চিকিৎসাসেবা বিঘিœত হচ্ছে। হাসপাতালে রোগীদের কোলে করে আনা নেওয়া করতে হচ্ছে। নিচতলা প্লাবিত হওয়ায় বন্ধ রয়েছে হাসপাতালের লিফট। প্রবল জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে জেলার আনোয়ারা, বাঁশখালী, সীতাকুÐ, মীরসরাই, স›দ্বীপসহ উপক‚লীয় এলাকা। বাঁশখালীতে জোয়ারের পানিতে চারটি ইউনিয়নের অন্তত পাঁচটি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
বরিশাল ব্যুরো জানায়, উপক‚লভাগসহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল এখনো সাগর আর উজানের ঢলের পানিতে সয়লাব। দক্ষিণাঞ্চলের সবগুলো নদ-নদী গতকালও দুকুল ছাপিয়ে বিপদসীমার ওপরেই প্রবাহিত হয়। ফুসে ওঠা সাগরের জোয়ারের পনিতে তলিয়ে যাচ্ছে জনপদের পর জনপদ। উপক‚লের শতাধীক বিচ্ছিন্ন দ্বীপসহ চরসমূহ ৩-৫ ফুট পানির তলায়। খোদ বরিশাল মহানগরীর অনেক রাস্তায় এখনো ঢেউয়ের নাচন। নগরীর ১৪টি বস্তি এলাকায় জোয়ারের পানি থৈ থৈ করছে। হাজার হাজার ছিন্নমূল মানুষের দুর্গতির শেষ নেই। নগরীর অন্তত ৫০ ভাগ এলাকায় পানিতে সয়লাব। পটুয়াখালী ও বরগুনা শহরেও জোয়ারে পানি থৈ থৈ করছে। ভোলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি প্রবেশ করছে মূল ভ‚খÐে।
মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় রয়েছে। ৬০Ñ৮০ কিলোমিটার বেগের ঝড়বৃষ্টির আশঙ্কার কথা জানিয়ে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের সব নদীবন্দরকে ২ নম্বর নৌ-হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। ফলে অনধিক ৬৫ ফুট দৈর্ঘের সব যাত্রীবাহী নৌযানের চলাচল বন্ধ রয়েছে গত দু’দিন। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছধরা নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপক‚লের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। সাগর মাঝারি মাত্রায় উত্তাল রয়েছে। পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেতের আওতায় রাখা হয়েছে।
নোয়াখালী ব্যুরো জানায়, টানাবর্ষণ ও জোয়ারে বেড়িবাঁধ ভেঙে হাতিয়া উপজেলার কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে ঘরবাড়ি, জমির ফসল ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। গত বুধবার থেকে টানাবর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে হাতিয়া উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ইউনিয়নগুলো হচ্ছেÑ সোনাদিয়া, নলচিরা, তমরদ্দি, হরনী, চানন্দী, নিঝুমদ্বীপ, সুখচর ও চরঈশ^র। হাতিয়া মূল ভ‚খÐ রক্ষাকারী বেড়িবাঁধের বিভিন্ন অংশ জোয়ারের পানি বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে করে তীব্র জোয়ারে কমপক্ষে ৫০টি বসতঘর ভেসে যায়। বর্তমানে এসব পরিবার বেড়িবাঁধ ও খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিয়েছে। এদিকে পূর্বের বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় সুখচর ইউনিয়নের চর আমানুল্যাহ, বৌবাজার, চেয়ারম্যান বাজার, নলচিরা ইউনিয়নের তুপানিয়া, নলচিরা ঘাট, চরঈশ^ও ইউনিয়নের তালুকদার গ্রাম, ফরাজি গ্রাম, ৭নং গ্রাম ও মাইছ্যা মার্কেট এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার প্রায় ২০ সহস্রাধিক অধিবাসী পানিবন্দি রয়েছে।
ভোলা থেকে মো. জহিরুল হক জানান, ভোলায় মেঘনার উত্তাল জোয়ারের চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে ভোলা সদর, বোরহানউদ্দিন ও দৌলতখান উপজেলার অন্তত ২০টি গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় ২০ হাজার মানুষ। গত বুধবার থেকে বৃষ্টি ও অমাবশ্যার জোয়ারের ফলে বেড়িবাঁধের ভেঙে গিয়ে এলাকায় পানি ঢুকে দু’দিন ধরে পানিবন্দি হয়ে দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন বানভাসি মানুষ।
ঝালকাঠি থেকে মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ জানান, সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর পানি বেড়ে অন্তত ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানি ঢুকে পড়েছে শহরের অলিগলি ও রাস্তাঘাটে। বসতঘরে পানি প্রবেশ করায় দুর্বিষহ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন জেলার নদী তীরের বাসিন্দারা।
ল²ীপুর থেকে এসএম বাবুল জানান, রামগতি, কমলনগর, ল²ীপুর সদর এবং রায়পুর উপজেলার মেঘনা তীরবর্তী এলাকায় ১৫ দিনের ব্যবধানে বন্যা ও অস্বাভাবিক জোয়ারে পানিতে প্লাবিত হয়ে ৪ উপজেলার ৪০ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগে পড়েছে।
মাদারীপুর থেকে আবুল হাসান সোহেল জানান, আবার শিবচরে পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁ নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপর প্রবাহিত হচ্ছে। কাঁঠালবাড়ী, চরজানাজাত, পশ্চিম বন্দরখোলা, সন্ন্যাসীরচর, বহেরাতলা, নিলুখী অনেক এলাকায় বন্যার পানি বৃদ্ধিতে প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি ওই সব এলাকায় চলছে নদীভাঙন।
সাতক্ষীরা থেকে আবদুল ওয়াজেদ কচি জানান, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায় কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর একাধিক স্থানে জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে ভেসে গেছে হাজার হাজার বিঘা মৎস্য ঘের ও ফসলি জমি। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ও শ্রীউলা এবং শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ। গতকাল সকাল থেকে টানা বৃষ্টির সাথে বর্তমানে নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩-৪ ফুট পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতাপনগর ইউনিয়নের চাকলা, কুড়িকাউনিয়া ও হরিশখালী এবং শ্রীউলা ইউনিয়নের হাজরাখালী ও কোলা পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে হু হু করে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে জোয়ার-ভাটা বইছে লোকালয়ে। ভেঙে পড়েছে স্যানিটেশন ব্যবস্থা। দেখা দিয়েছে সুপেয় খাবার পানির অভাব।
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থেকে আবদুল হালিম দুলাল জানান, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্ন চাপের প্রভাবে অবিরাম ও অমাবস্যার জোয়ারে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। স্বাভাবিকের চেয়ে ২/৩ ফুট পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী তীরবর্তী অনেক গ্রাম ও হাট বাজার, আমনের বীজতলা, রোপা আমনের ক্ষেত ও বাড়ির আঙ্গিনার শাকসবজির ক্ষেত ডুবে গেছে।
ঝালকাঠির রাজাপুর থেকে মো. এনামুল হোসেন খান জানান, উপজেলার ৫৪টি গ্রামে দক্ষিণের হাওয়া ও ভরাকাটাল এবং গত ২ /৩ দিনের ভারীবর্ষণে স্বাভাবিক জোয়ারের তুলনায় ৫ থেকে ৬ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি ঢুকে পড়েছে রাজাপুর, বড়ইয়া, সাতুরিয়া, মঠবাড়ি ইউনিয়নের নদী তীরবর্তীসহ শহরের বাগানবাড়িতে ও রাস্তাঘাটে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উপকূল


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ