Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

করোনাকালে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি ও করণীয়

আমজাদ হোসেন | প্রকাশের সময় : ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

পৃথিবী আজ এক ভয়ংকর দুঃসময় সময় পার করছে। চীনের উহান নগরী থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস পুরো বিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছে। বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তের হার দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। গত ২৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার কওমি মাদ্রাসা ছাড়া দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার পর এবার চলতি বছরের অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষাও বাতিল করা হয়েছে। স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন রুটিনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা মূলত ঘরবন্দি জীবনযাপন করছে। নিজেদের প্রয়োজনে বড়রা ঘর থেকে বেরুতে পারলেও ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে শিশুরা। সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাওয়ার কোনো তাড়া নেই। শিক্ষকের দেওয়া বাড়ির কাজ নেই। নিয়মিত পড়ালেখা নেই। অলস সময় কাটছে। একটা অনিয়মিত রুটিনের জীবনযাপন শিশুদের মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে। যেকোনো পরিবর্তনের সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যত সহজে খাপ খাওয়াতে পারে, শিশুদের কিন্তু একটু বেগ পেতে হয়। শিশুরা করোনাভাইরাসে অপেক্ষাকৃত কম আক্রান্ত হলেও তারা মূলত এই মহামারীর নীরব শিকার।

আজকের শিক্ষার্থীরাই আমাদের আগামী দিনের বাংলাদেশ। ভবিষ্যতে তাদের মধ্য থেকেই আমরা পাব একেকজন বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ, দক্ষ প্রশাসক, উদ্যোক্তা, খেলোয়াড়, সমাজকর্মী, শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক ইত্যাদি। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বকল্যাণে কাজ করবে তারাই। ওদের সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার। দীর্ঘদিনের আবদ্ধ অবস্থা শিশুর সকল ধরনের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। চারিদিকে শুধু শঙ্কার আবহ শিশুর মনোজগতের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। সারাক্ষণ দুঃশ্চিন্তা করা, ঘুমের সমস্যা হওয়া, দুঃস্বপ্ন দেখা, খাবারে অনীহা প্রকাশ, পড়াশোনা বা যেকোনো কাজে মনোযোগ দিতে না পারার মতো মারাত্মক উপসর্গ দেখা দিতে পারে তাদের। নেতিবাচক চিন্তার ফলশ্রæতিতে তারা ভীষণ একাকিত্ব, অসহায়, বিষণœ আর আশাহত অনুভব করতে পারে। আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুদের থেকে সামাজিক দূরত্বে থাকার কারণে এসময় শিশুদের মনে একটা হারানোর ভয় কাজ করতে পারে। দীর্ঘ সময় বাইরে না যাওয়ার ফলে শিশুরা বিরক্ত হতে পারে, ভয় পেতে পারে। অল্পতেই রেগে যেতে পারে। হতাশায় ভুগতে পারে। ঘরবন্দি শিশুদের এই দুঃসময়ে অতিরিক্ত বকাঝকা দেওয়া থেকে অভিভাবকদের বিরত থাকতে হবে। অতিরিক্ত বকাঝকা শিশুকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতে পারে। এতে করে এই কঠিন সময় আরো দুর্বিষহ হতে পারে। করোনাভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটায় বেকারত্ব, দারিদ্র, ক্ষুধাও যেন কোভিড-১৯ এর উপসর্গ হয়ে উঠেছে। পরিবারে খাদ্য সংকটের কারণে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগবে। দারিদ্র্যের কারণে শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বাড়বে। লক্ষ লক্ষ শিশু আবারো শিশুশ্রমে যুক্ত হতে বাধ্য হবার আশংকা রয়েছে।

করোনা মহামারীর এই সময়ে পরিবারের শিশুদের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। শিশুরা কীভাবে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারে বিশেষ করে করোনা থেকে নিরাপদে থাকতে সর্বোত্তম পদ্ধতিতে হাত ধোয়া ও স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন পদ্ধতি তাদের শিখাতে হবে। ভয় যেন শিশুদের মনকে ঘিরে ধরতে না পারে সেদিকে বেশি খেয়াল রাখতে হবে। শিশুরা যাতে একটি মানসিক চাপমুক্ত পরিবেশ পায় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। অন্যান্য সময় শিশুদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য অভিভাবকরা তেমন একটা সুযোগ পান না। এখন শিশুদের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত যাতে আনন্দময় হয়। এছাড়া তাদের একঘেঁয়েমি কাটাতে ক্যারম, দাবা, লুডু, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিসের মতো ইনডোর খেলার ব্যবস্থা করতে হবে।শিশুরা এই পরিস্থিতিতে কী ভাবছে এবং কী অনুভব করছে তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। ছবি আঁকার জন্য শিশুদের হাতে এই সময়ে রং পেন্সিল আর আর্ট বোর্ড তুলে দেওয়া যেতে পারে। শিল্পচর্চা শিশুদের অসাধারণভাবে ভাবতে ও চিন্তা করতে শেখায়, যা তাকে যেকোনো পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সহায়তা করে। নিয়ম করে করে ঘুমানো এবং সকালে নির্দিষ্ট সময় ঘুম থেকে উঠে স্বাভাবিক নিয়মে দিন শুরু করতে তাদের সহযোগিতা করতে হবে। সকালের প্রার্থনা, হালকা ব্যায়াম, নাস্তা, একটু বিশ্রাম, দুপুরে ও রাতে নিদিষ্ট সময়ে খাবার এবং রাতে ঠিক সময়ে ঘুমাতে যাওয়ার নিয়মবাঁধা সুন্দর অভ্যাসগুলো অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। বই পড়ায় তাদেরকে উৎসাহিত করতে হবে। ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ প্রোগ্রামের আওতায় সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে পাঠদান পরিচালনা একটি ভালো উদ্যোগ। অনলাইন শিক্ষার কৌশল ও শিক্ষার বিভিন্ন বিষয়কে বেতারের মাধ্যমে স¤প্রচারের মতো দূরবর্তী শিক্ষণ পদ্ধতিসহ শিক্ষার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হবে। বড় শহরে কিছু স্কুল অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও গ্রামের শিশুরা তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গল্পের বইসহ বাসায় বিভিন্ন লেখকদের যে বইগুলো আছে শিশুদের তা পড়তে দেওয়া যেতে পারে। এই পড়া তাদের জানার দিগন্ত প্রসারিত করে দেবে। ইংরেজি উচ্চারণ ও লিসেনিং স্কিল বাড়ানোর জন্য বিবিসি ও সিএনএন নিউজ শুনতে দেওয়া যেতে পারে।

শিশুর সামগ্রিক বিকাশের সঙ্গে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা নিবিড়ভাবে জড়িত। চারদিকের পরিবেশ শিশুদের অনেক বেশি প্রভাবিত করে এবং এর প্রতিফলন ঘটে তাদের ব্যক্তিত্বে। অভিভাবকদের এই বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহার করে গেমস, ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার ইত্যাদিতে যাতে শিশুরা আসক্ত হতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পরিবারের সবাই দীর্ঘ সময় একসঙ্গে অবস্থানের কারণে পারিবারিক সহিংসতা বাড়তে পারে। তাই সতর্ক থাকতে হবে অভিভাবকদের। অন্য সময় ব্যস্ততার কারণে শিশু মা-বাবাকে কাছে পায় না। এই সুযোগটা কাজে লাগানোর এখনই উপযুক্ত সময়। এতে করে শিশুর একঘেয়েমিও কাটবে, বাবা-মার সঙ্গে শিশুর বন্ধনও বাড়বে।

করোনা সংকট কোনো জাতীয় সমস্যা নয়, বৈশ্বিক। কোনো সংকটই চিরস্থায়ী নয়। এই আঁধার কেটে যাবে একদিন। সকল অনিশ্চয়তার হবে অবসান। আমাদের কোমলমতি সন্তানরা তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে। ফিরবে আপন জীবনের ছন্দে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পদচারণা আর নির্মল হাসি-আনন্দে মুখরিত হবে আবার। খোলা জনপদে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিবে সমাজ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কর্ণধাররা। সেদিনের অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনা

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন