Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যসাধকদের কতিপয় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ২২ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০২ এএম

সত্য মানুষকে রক্ষা করে এবং মিথ্যা ধ্বংস করে। ইসলামের এ চিরন্তন নীতিবাক্য মানব জীবনের অমূল্য সম্পদ। সকল ধর্মগ্রন্থেই সত্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং মিথ্যা পরিহার করতে বলা হয়েছে। অবশ্য চাণক্য নীতির কথা ভিন্ন, যাতে মিথ্যার বেসাতি কী করে করা যায়, সবক বলে দেয়া হয়েছে। তাই চাণক্যনীতির অনুসারীদের মধ্যে মিথ্যার প্রচলন অধিক। সত্য ও সত্যবাদিতা এবং মিথ্যা ও মিথ্যাবাদিতা দুটি বিপরীতধর্মী বিষয়। সত্য-সততার লালন-পালন করা যত কঠিন, মিথ্যা ও মিথ্যাচারের প্রসার তত সহজ। তবে সত্য সাধনার অসংখ্য দৃষ্টান্ত ইতিহাসে অলংকার হয়ে আছে।

সত্য বলা বা প্রকাশ করার মানসিকতা ও সৎসাহসের প্রয়োজন হয়। হাদীসে বলা হয়েছে: কারো মধ্যে কোন মন্দ কাজ দেখলে শক্তি থাকলে তা শক্তি প্রয়োগের দ্বারা পরিবর্তন করবে, শক্তি না থাকলে তা মুখের কথা দ্বারা পরিবর্তনের চেষ্টা করবে, আর সেটাও সম্ভব না হলে সে মন্দ কাজটিকে মনে মনে ঘৃণা করবে, যা সবচেয়ে দুর্বল ঈমানের লক্ষণ। ‘আস্ সাকেতু আনিল হাক্কে শায়তানুন আরছ।’ অর্থাৎ- সত্য বলা বা প্রচার করা হতে বিরত থাকা বোবা শয়তানের কাজ। এরূপ চরিত্রের অধিকারী বোবা শয়তানের দোসরের অস্তিত্ব প্রত্যেক সমাজেই বিদ্যমান। স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি বা দুর্বল ঈমানের অধিকারীরা সৎ সাহসের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়ে ‘মূক’ (বধির) হয়ে থাকে, যদি কোন বিপদের মুখোমুখি হতে হয়, এই ভয়ে। তাই সত্যের সাধকদের সংখ্যা সমাজে অধিক নয়। অবশ্য সত্যসাধকরা সংখ্যায় কম হলেও তাদের সাহসিকতা নজিরবিহীন। ইতিহাস হতে কিছুটা নজির তুলে ধরলে এ বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণিত হবে। সত্যের সাধক ইমাম-ওলি-দরবেশ, পীর-মাশায়েখ এমনকি রাজা-বাদশাহ, শাসকদের জীবনেও অনুরূপ দৃষ্টান্ত রয়েছে। এসব নানা শ্রেণির ঘটনাবলি হতে কতিপয় দৃষ্টান্ত নিচে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:

১। দামেস্কের খলিফা এজিদ ইবনে আবদুল মালেক ওমর ইবনে হোবায়রাকে ইরাক ও খোরাসনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। হোবায়রা ছিলেন নৃশংস হত্যাকারী ও জালেম শাসক। তিনি যখন ইরাকে আসেন তাঁর দরবারে খাজা হাসান বাসরী (রা.) ও ইমাম শা’বী (রা.) কে তলব করেন এবং তাদের সামনে ভাষণদান করেন, ‘এজিদ ইবনে আবদুল মালেককে আল্লাহতাআলা তার বান্দাদের উপর খলিফা নিযুক্ত করেছেন এবং তার (এজিদ ইবনে আবদুল মালেকের) আনুগত্য স্বীকারের জন্য তাদের নিকট হতে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন এবং আমাদের নিকট হতে (সরকারি কর্মচারীদের) তার নির্দেশনাবলী শোনার ও পালন করার প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন এবং আমাকে খেলাফতের পক্ষ হতে যা দান করা হয়েছে তা আপনারা সবাই অবগত আছেন। খলিফার পক্ষ হতে আমাকে যে হুকুম দেওয়া হয়, তা আমি বিনা দ্বিধায় পালন করে থাকি। এ সম্পর্কে আপনাদের রায় কি?’ এ সম্পর্কে খাজা হাসান বাসরী (রা.) ও ইমাম শা’বী (রা.) ইবনে হোবায়রাকে সৎ সাহসের সাথে যে উত্তর দিয়েছিলেন, তাতে ইবনে হোবায়রা অত্যন্ত বিস্মিত ও ক্রোধান্বিত হয়েছিলেন এবং তাঁদের প্রতি যে অসদাচরণ করেছিলেন ইতিহাসে তার বিবরণ রয়েছে। ইমামদ্বয় এ জালেম অত্যাচারী শাসকের ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে সত্য প্রকাশে বিন্দুমাত্র পরোয়া করেননি।

২। সুলতান মাহমুদ গজনভীর নিকট একজন ব্যক্তি এসে নালিশ করল যে, ‘আমি যখন ঘরের বাইরে চলে যাই, তখন জনৈক শাহজাদা আমার গৃহে আগমন করে এবং আমার স্ত্রীর সাথে জোরপূর্বক অবৈধ কর্মে লিপ্ত হয়।’ মাহমুদ শাহজাদার গঠন আকৃতি ও হুলিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে বললেন, ‘আগামীতে যখন শাহজাদা আসবে তৎক্ষণাৎ আমাকে এসে খবর দেবে।’ ঘটনাচক্রে দুই-তিন দিন পরই উক্ত শাহজাদা পূর্বের ন্যায় ঐ ব্যক্তির স্ত্রীর নিকট আগমন করলে সে গিয়ে সুলতান মাহমুদকে সংবাদ জানায়। সুলতান মাহমুদ তার সাথেই চলে আসেন। গৃহে এসে তিনি ঐ ব্যক্তিকে বললেন, ‘ভালো করে ঘরের বাতি নিভিয়ে দাও।’ অতঃপর মহিলার কাছে গমন করেন এবং তরবারি দ্বারা আগত ব্যক্তির শিরোচ্ছেদ করে দেন। তার পর বাতি জ¦ালিয়ে লাশ দেখেন, পানি আনিয়ে পান করেন এবং নামাজ পড়তে শুরু করেন। সুলতানের সুবিচার ও ন্যায় পরায়ণতা দেখে বিচারপ্রার্থীর মনোবল ও সাহস বেড়ে যায়। সে সুলতান মাহমুদের এসব ক্রিয়াকর্মের কারণ জিজ্ঞাসা করলে মাহমুদ বলেন, ‘তুমি যে ব্যক্তির হুলিয়া বর্ণনা করেছিলে, তার গঠন প্রকৃতি আমর ছেলের ন্যায় ছিল। বাতি আমি এই জন্য নিভিয়ে দিয়েছিলাম যে, পিতৃস্নেহ যেন আমার কর্তব্য পালনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে না পারে। নামাজ আদায় করার উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কেননা আমার ছেলে এই পাপ কার্যে লিপ্ত ছিল এবং পানি পান করার কারণ ছিল এই যে, তুমি যে দিন আমার নিকট নালিশ করেছিলে, ঐ দিন হতে আমি নিজের উপর পানি পান করা হারাম করেছিলাম।’

৩। সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের আমলে বদায়ুনের শাসনকর্তা মদ্যপান করে মাতাল অবস্থায় একজন কর্মচারীকে হত্যা করে। নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশগণ বলবনের নিকট বিচার প্রার্থণা করে। সুলতান হত্যাকারী শাসনকর্তাকে ডেকে প্রকাশ্য দরবারে মৃত্যুদন্ড দান করেন এবং তার লাশ বদায়ুন নগরীর রাজপথে লটকিয়ে রাখার নির্দেশ দান করেন, সেখানে তিন দিন তা ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে।

৪। সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের ইন্তেকালের পর বুগরাখান হিন্দুস্থান সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ক্ষান্ত হননি, তিনি স্বীয় পুত্র কায়কোবাদকে দিল্লীর শাসনকর্তা রূপে স্বীকৃতি দান করেন। বুগরাখান স্বয়ং বঙ্গদেশে শাসনকর্তা হিসেবে নিরব জীবন যাপন করাকেই পছন্দ করেন। কায়কোবাদ অল্প বয়সেই ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা উজিরদের হাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এই সংবাদ বুগরাখানের কাছেও পৌঁছেছিল। তিনি কায়কোবাদের সাথে সাক্ষাৎ করার বাসনা প্রকাশ করেন। বুগরাখান লাক্ষ্মৗ হতে অযোধ্যায় চলে আসেন। অপর পক্ষে কায়কোবাদ বিখ্যাত কবি আমির খসরুর সাথে আগমন করেন। ‘কেরানুস সাদাইন’ গ্রন্থে আমির খসরু এই সাক্ষাৎকারের বিবরণী লিপিবদ্ধ করেছেন এবং তিনি লিখেছেন, ‘বুগরাখান কায়কোবাদকে তিনটি উপদেশ দিন করেন। যথা: ১. উজিরদেরকে অস্বাভাবিক ক্ষমতা অর্পণ করবে না, ২. সম্রাটের স্বাস্থ্য ভালো থাকা এবং বিলাসিতা হতে বিরত থাকা চাই, এবং ৩. নামাজ, রোজা পালন করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য এবং কোন অর্থ খয়রাত ও দান-দক্ষিণা দ্বারা এসব ধর্মীয় অনুশাসন হতে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।’ এই সাক্ষাৎকারের পর কয়েক মাস যাবৎ কায়কোবাদ মদ পান ও সর্ব প্রকার বিলাসিতা হতে বিরত থাকেন। একদিন তিনি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে শিকারে যাচ্ছিলেন। এমন সময় অপর দিক হতে ঘোড়ায় আরোহণ করে কালো পোষাক পরিহিত ও মাথায় মুকুট ধারী একটি অত্যন্ত সুদর্শন ছেলে আসছিল, সে বাদশাহকে চিনে ফেলে এবং অতি বিনয় ও ভদ্রতার সাথে তাকে সালাম করে এবং একটি কবিতার এই লাইনটি আবৃত্তি করে, যার অর্থ: ‘আমার মুখের উপর যদি তিনি পদাঘাত করতেন।’ ঐ দিন হতে বাদশাহ মদ্যপান ও নাচগান পরিত্যাগ করেন।

৫। সম্রাট জাহাঙ্গীরের অতিপ্রিয় আমির খান আলমের ভ্রাতুষ্পুত্র হোসাং একজন নিরীহ দরিদ্র ব্যক্তিকে হত্যা করে। জাহাঙ্গীরের দরবার পর্যন্ত এর নালিশ আসে। সম্রাট অনতিবিলম্বে এই ঘটনার অনুসন্ধান চালানোর নির্দেশ দেন এবং হোসাংয়ের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর সম্রাট তাকে মৃত্যুদন্ড দান করেন। এই ঘটনা সম্পর্কে জাহাঙ্গীর স্বয়ং তার আত্ম বিবরণীতে লিখেছেন: ‘নিজের দরবারে তলব করে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করি এবং অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর তাকে মৃত্যুদন্ডের নির্দেশ দান করি। কস্মিনকালেও আমি কোন শাহজাদার প্রতি সুযোগ দান করিনি, আমির ওমরা ও জনগণতো দূরের কথা। আল্লাহ তাআলা আমাকে এ ধরনের শক্তি দান করুন।’

৬। গুজরাটের শাসনকর্তা আহমদ শাহের জামাতা বিপুল ঐস্বর্য ও ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে এক নিরীহ দরিদ্র ব্যক্তিকে হত্যা করে। তারপর হত্যাকারীর ভক্ত অনুসারীরা নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশগণকে ভয় ভীতি প্রদর্শন করে কিছু অর্থের বিনিময়ে মামলা নিষ্পত্তি করে ফেলে। কোন প্রকারে এই ঘটনার খবর আহমদ শাহর কানে পৌঁছে যায়। তিনি নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশগণকে ডেকে স্বয়ং ব্যাপারটির তদন্ত করেন এবং জামাতার অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর তাকে মৃত্যুন্ডে দান করেন, তার লাশ এক রাত্র এক দিন ফাঁসিকাষ্টে ঝুলিয়ে রাখা হয়। আহমদ শাহের অন্দর মহলে যখন তাকে বলা হয় যে, ‘আপনি তাকে (জামাতা) অর্থদন্ডেও দন্ডিত করতে পারতেন।’ তখন এ কথা শুনে তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন, ‘এভাবে আমির ও শাহজাদারা প্রজাদের খুন করা বৈধ মনে করবে এবং নিজেদের অর্থভান্ডার হতে খুনের পরিবর্তে অর্থ দিতে থাকবে, এটা শরীয়তের পরিপন্থি।’ সুলতান, রাজা, বাদশাহ, শাসকদের জীবনে এরূপ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার অভাব না থাকলেও এগুলোতে রয়েছে অনন্ত শিক্ষা। সত্যসাধনার এরূপ দৃষ্টান্ত সকল স্থানেই বিদ্যমান। মানুষের শিক্ষা গ্রহণের জন্য এসব উপেক্ষিত-বিচ্ছিন্ন ঘটনা, মূল্যবান দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য হবে। সত্য, বস্তুনিষ্ঠ এবং নিরপেক্ষ লেখক, ইতিহাসবিদগণ যুগে যুগে তাঁদের রচনাবলিতে এরূপ অজস্র ঘটনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। আবার অনেকে এরূপ ঘটনাবলি উপেক্ষাও করেছেন। বস্তুত গুরুত্বপূর্ণ ও অনুসরণীয় এধরনের ঘটনাগুলোকে একত্রে সংকলিত করা হলে মানব জীবনের জন্য এগুলো দিকদর্শন হয়ে থাকবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উজ্জ্বল-দৃষ্টান্ত
আরও পড়ুন