Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জেলহত্যা ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়

ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী | প্রকাশের সময় : ৩ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে সেনাবাহিনীর একটি অংশের সহায়তায় কিছু ‘বিপথগামী’ সেনা সদস্যকে দিয়ে সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এরই ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে সেই সেনা সদস্যরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে নির্মমভাবে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতাকে। কারাভ্যন্তরে কুচক্রী খুনিদের হাতে প্রাণ দেয়া জাতীয় এ চার নেতা হচ্ছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী সরকারের তথা বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ক্যাপ্টেন এম মুনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামান। কারাগারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকাবস্থায় এ ধরনের হত্যাকান্ড ইতিহাসে বিরল ঘটনা।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর এ চার নেতাকে ষড়যন্ত্রকারীরা এ দিন প্রথমে গুলি ও পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হাতে আটক বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন জাতীয় এই চার নেতা। মূলত যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, তারা স্বাধীনতার স্থিতিকেও গলা টিপে হত্যা করতে চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় হায়েনাদের পক্ষে যা সম্ভব হয়নি, তা-ই তারা করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির চার বছরের মাথায় জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে। তারা ভালো করেই জানতো, বঙ্গবন্ধু চলে গেলেও তার আদর্শের বাহক রয়ে গেছে অনেক। সেই অনেকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চারজনকে যখন একসঙ্গে জেলখানায় পাওয়া গেল, তখন হায়েনারা আর সময় নষ্ট করেনি।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর ট্যাংক, কামান ও মেশিনগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। শুধু ঢাকায় নয়, সারাদেশেই বাঙালি নিধনে মেতে উঠেছিল তারা। বাধ্য হয়ে বাঙালি জাতিও অস্ত্র হাতে রুখে দাঁড়িয়েছিল। সেই যুদ্ধেও জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ বিভিন্ন বাহিনী গড়ে তুলেছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর পাশাপাশি তারাও মুক্তিকামী মানুষকে হত্যার উত্সবে মেতেছিল। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে সেই যুদ্ধে বাঙালি বিজয়ী হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হেরে যায় তাদের এ দেশীয় দোসররাও। কিন্তু তারা সেই পরাজয় মেনে নেয়নি এবং নিজেদের অবস্থান থেকেও সরে আসেনি। তারাই পরবর্তীকালে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে এবং নানা রকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা ছিল সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ। এই হত্যাকান্ড শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, বিশ্বের ইতিহাসেও এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।

পৃথিবীর ইতিহাসে জেল হত্যা দিবস এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। কারাগারের অভ্যন্তরে এ ধরনের বর্বর হত্যাকান্ড পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। পৃথিবীর যে কোনো আইনে জেলের ভিতর হত্যা করা একটা ঘণ্যৃ অপরাধ। সেই অপরাধের বিচার বন্ধ করা আরো বড় অপরাধ। কিন্তু লজ্জাজনক হলেও সত্য, এই বিচার নিষিদ্ধ করে একটা সংশোধনী সংবিধানে সংযোজন করে হত্যাকারীদের নিরাপদে দেশ ত্যাগ করার সুযোগ করা হয়। পরে তাদের পররাষ্ট্র বিভাগের অধীনে চাকরি দিয়ে পুরষ্কৃত করা হয়।

জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যার এ ঘটনায় তখনই লালবাগ থানায় মামলা দায়ের করা হলেও দীর্ঘ ২১ বছর এ হত্যাকান্ডের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখে সেই সময়ের সরকারগুলো। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার জেল হত্যা মামলার প্রক্রিয়া পুনরুজ্জীবিত করে। এরপর দীর্ঘ ৮ বছরেরও বেশি সময় বিচার কাজ চলার পর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত মামলাটির রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ২০ আসামির মধ্যে ১৫ সাবেক সেনা কর্মকর্তার শাস্তি এবং অপর ৫ জনকে খালাস দেয়া হয়। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে পলাতক ৩ আসামির মৃত্যুদন্ড এবং অপর ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে হাইকোর্ট ২০০৮ সালে দেয়া রায়ে মোসলেমের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন। তবে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি মারফত আলী ও হাসেম মৃধাকে খালাস দেন। এছাড়া যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত ফারুক, শাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিন আহমেদকেও খালাস দেন হাইকোর্ট।

হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আপিলের আবেদন (লিভ টু আপিল) করে সরকার। ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি আপিল বিভাগ সরকার পক্ষের আপিল আবেদন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। আদেশে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত, তবে হাইকোর্টের রায়ে খালাস পাওয়া দফাদার মারফত আলী শাহ ও এলডি (দফাদার) আবুল হাসেম মৃধাকে অবিলম্বে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়। আত্মসমর্পণ না করলে তাদের গ্রেফতার করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়।

২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল ওই আপিলের ওপর রায় দেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। রায়ে জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলায় বহিষ্কৃত দুই সেনা সদস্য দফাদার আবুল হাসেম মৃধা ও দফাদার মারফত আলী শাহকে নিম্ন আদালতের দেয়া মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে তাদের খালাস দেয়া সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় বাতিল ঘোষণা করেন।

জেলহত্যার বিচার ও রায় কার্যকর করার ভেতর দিয়ে ইতিহাসের আরেক কলঙ্ক থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে। বিদেশে পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনতে হবে। দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করতেও এ মামলার আসামিদের দন্ড কার্যকর করার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: প্রধানমন্ত্রীর সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ এবং সমাজকল্যাণ বিষয়ক উপদেষ্টা ও চেয়ারম্যান কমিউনিটি ক্লিনিক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জেলহত্যা-ইতিহাস
আরও পড়ুন