Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা

চলতি বছরের প্রথমার্ধে কমেছে ১৯% অবকাঠামো ঘাটতিসহ নানা কারণে দেশে প্রত্যাশিত মাত্রায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না -বিশেষজ্ঞদের অভিমত

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৩ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

করোনার ধাক্কায় বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতি। দেশে দেশে চাহিদা পড়ে গেছে, সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। এই পরিস্থিতিতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই কমে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) প্রাক্কলন অনুযায়ী, বাংলাদেশে চলতি বছরের প্রথমার্ধে এফডিআই ১৯ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১১৬ কোটি ৪৩ লাখ ডলার, ২০১৯ সালের প্রথমার্ধে যা ছিল ১৪৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক বছরের প্রথম প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) বিদেশি বিনিয়োগের যে পূর্ণাঙ্গ উপাত্ত প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, বছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৫৮ কোটি ২১ লাখ ডলার। যা গত বছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় যা প্রায় ৪৮ শতাংশ কম। ২০১৯ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে দেশে নিট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১০৩ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংকের উপাত্তই আঙ্কটাড প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহার করে, তাই প্রথম প্রান্তিকের বা তিন মাসের নিট বিদেশি বিনিয়োগকে ছয় মাসে দ্বিগুণ ধরে নিয়ে জাতিসংঘের সংস্থাটি এই প্রাক্কলন করেছে। বছরের প্রথমার্ধে দক্ষিণ এশিয়ায় এফডিআই কমেছে ৩১ শতাংশ বা ২ হাজার কোটি ডলার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশি বিনিয়োগ না বাড়লে দেশি বিনিয়োগও বাড়বে না, ফলে মহামারীতে ওলটপালট অর্থনীতি আরও নাজুক হয়ে পড়বে। অবকাঠামো ঘাটতিসহ নানা কারণে দেশে প্রত্যাশিত মাত্রায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। একই সঙ্গে শুধু এফডিআই’র আশা করলে হবে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে হবে, কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে বলে উল্লেখ করেন তারা।
বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের চেম্বার অ্যামচেমের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেছেন, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ এর অর্থনীতির আকারের বিবেচনায় অনেক কম। এটা কমার কারণ শুধু বর্তমান করোনাই নয়; এর মূল কারণ অবকাঠামোর ঘাটতি এবং অর্থনৈতিক কুটনীতির অভাব। শুধু এফডিআই’র আশা করলে হবে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে হবে, কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এরশাদ আহমেদ বলেন, আমাদের বন্দরের সমস্যা আছে। এতদিনেও আমরা আমাদের বন্দরের অটোমেশন করতে পারিনি। এটা খুবই দুঃখজনক। তিনি বলেন, কাস্টমস অ্যাক্ট এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেটরি অ্যাক্ট পুরনো। এতে অনেক পরিবর্তন আনতে হবে। এটা না আনা গলে বিনিয়োগ বাড়ানো চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে বর্তমানে দেশে যে সব বিদেশী বিনিয়োগকারী আছে তাদের স্বার্থ দেখতে হবে। তারা যাতে কোনভাবে হয়রাণির স্বীকার না হয় সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যা করছে তা হলো-যারা ট্যাক্স-ভ্যাট দেয় তাদেরকেই হয়রাণি করছে। এ থেকে বের হতে হবে। আর এটা বর্তমানে যারা বিনিয়োগ করছে তাদের কাছে খারাপ ম্যাসেজ যাচ্ছে। বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, গত বছরের প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে গ্রামীণফোনের (জিপি) নিরীক্ষা আপত্তির টাকা নিয়ে বিটিআরসির সঙ্গে সমস্যা বাংলাদেশে এফডিআই আসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। এক্ষেত্রে বছরের হিসাব বছরে শেষ করা দরকার। ৫ বছর পর হিসাব করলে সমস্যা হবেই।
এছাড়াও সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে এফডিআইয়ের প্রধান সমস্যা হচ্ছে ‘ব্র্যান্ডিং’। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে আমরা এখনও আমাদের ব্র্যান্ডিং যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারিনি।
এ বিষয়ে অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, এখন করোনার কারণে সবকিছুই ওলটপালট। এফডিআইও কমবে, এটাই স্বাভাবিক। সেটা কোথায় গিয়ে নামবে সেটাই এখন উদ্বেগের বিষয়। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে চীন থেকে মুখ ফেরানো মার্কিনসহ অন্যান্য দেশে বিনিয়োগ বাংলাদেশে আনার উদ্যোগ নেয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তেমননি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, কেবল মুখে বললে হবে না; কার্যকর-সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথম যে কাজটি করতে হবে, তা হলো দেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তারপর বাড়তি বিদেশি বিনিয়োগের আশা করতে হবে। ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমাদের বন্দরের যে অবস্থা, এটা ঠিক না করে এফডিআই’র আশা করা ঠিক হবে না। এছাড়া অন্যান্য খাতেরও ব্যাপক সংস্কার করতে হবে।
দেশে বিদেশি বিনিয়োগ কমতে পারে ৬ শতাংশ
প্রায় চার মাস আগে দেয়া পূর্বাভাস যে অনেকটাই সত্যি হতে চলেছে, তার একটা প্রমাণ মিলল হালনাগাদ এই প্রতিবেদন থেকে। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, উন্নত দেশগুলোয় বিনিয়োগ এই সময়ে সবচেয়ে বেশি কমেছে। শুধু কমেছে বললে কম বলা হয়, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় তা ৭৫ শতাংশ কম। বিপরীতে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ১৬ শতাংশ। আঙ্কটাড বলছে, আশঙ্কা এর চেয়েও খারাপ ছিল।
লকডাউনের প্রভাব
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে লকডাউন আরোপ করা হয়। উন্নত থেকে উন্নয়নশীল-সব দেশই এই পথে হাঁটে। কিন্তু অর্থনীতিতে তা মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনে। কয়েকমাসব্যাপী এই লকডাউন চলেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ে। এর জেরে বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান নতুন বিনিয়োগ তো করেইনি, বরং বিদ্যমান বিনিয়োগও অনেক ক্ষেত্রে গুটিয়ে এনেছে বা সংকুচিত করেছে। আবার অনিশ্চয়তা ও গভীর মন্দার আশঙ্কায় অনেক নতুন বিনিয়োগ প্রকল্পের অগ্রগতি থমকে গেছে।
২০১৯ সালে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রাজিলে এ বছরের প্রথমার্ধে এফডিআই সবচেয়ে বেশি হারে কমেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি এফডিআই প্রাপ্তির দেশ ভারতে এই সময়ে কমেছে ২৯ শতাংশ। তবে ভারতের ডিজিটাল অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বাড়ছেই।
বিদেশি বিনিয়োগের একটি ধরন হলো ক্রসবর্ডার বা আন্তসীমান্ত মার্জার অ্যান্ড একুইজেশনস (এমঅ্যান্ডএ)। এর মানে হলো এক দেশের কোম্পানি আরেক দেশের কোম্পানির মালিকানা অধিগ্রহণ করে বা একাধিক দেশের কোম্পানি একত্র হয়ে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই আন্তসীমান্ত এমঅ্যান্ডএ বছরের প্রথম ৯ মাসে প্রায় ১৫ শতাংশ কমেছে-বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৯০০ কোটি ডলার।
তবে ভারতে এই এমঅ্যান্ডএর আর্থিক মূল্য এই সময়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ফেসবুকের মালিকানাধীন জাড্ডু কর্তৃক জিও প্ল্যাটফর্ম ক্রয়সহ রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের বেশ কিছু কোম্পানিতে বিদেশি বিনিয়োগ আসায় এমঅ্যান্ডএতে ভারত বেশ এগিয়েছে। আবার গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগ বছরের প্রথম আট মাসে ৩৭ শতাংশ কমে গেছে। বহুজাতিক কোম্পানি যখন অন্য কোনো দেশে একদম নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য বিনিয়োগ করে, তখন তাকে বলে গ্রিনফিল্ড। আর তাই আঙ্কটাড একে অভিহিত করেছে ভবিষ্যৎ বিদেশি বিনিয়োগের সূচক হিসেবে। এ ধরনের বিনিয়োগের পরিমাণ জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে ৩৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলার বলে আঙ্কটাড প্রাক্কলন করেছে।
প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ তৈরি পোশাক রফতানিনির্ভর হওয়ায় গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগ প্রাপ্তিতে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগ কমেছে ৭৮ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় কমেছে ৯৭ শতাংশ।
তবে এই পরিস্থিতিতেও আশাবাদী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম। তিনি বলেন, অতীতেও দেখা গেছে, বড় সঙ্কটের পর বাংলাদেশের জন্য সুফলও বয়ে এনেছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সবাই আশঙ্কা করেছিল ২০০৫ সালে কোটা উঠে যাওয়ার পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে ধস নামবে। কিন্তু সেটা না হয়ে উল্টো উল্লম্ফন হয়েছে। সেই সময়ের ৫ বিলিয়ন ডলারের রফতানি এখন ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
চীন থেকে মুখ ফেরানো বিদেশি বিনিয়োগ আশার যে প্রত্যাশা আমরা করছি, সেক্ষেত্রেও তেমনটি হতে পারে। তবে সেটার জন্য মহামারীতে যে ক্ষতি হয়েছে, তা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে হবে আমাদের। দ্রুত অর্থনীতিকে পূর্ণমাত্রায় সচল করতে হবে। শেখ ফাহিম বলেন, এখন সরকারি-বেসরকারি খাত মিলে ‘একসঙ্গে’ কাজ করতে হবে। সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তা বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোকে ‘আন্তরিক’ হতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি বাড়াতে হবে। তাহলে আমরা আবার সেই আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারব। আমদানি বাড়বে; রফতানি বাড়বে। দেশি বিনিয়োগ বাড়বে। আসবে বিদেশি বিনিয়োগ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিদেশি

২৭ জানুয়ারি, ২০২৩
২৯ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ