Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য প্রয়োজন স্বাধীন গণমাধ্যম

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৪ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

গণতন্ত্রে ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়া কর্তৃত্বের সুযোগ নেই। কারণ, ক্ষমতার মালিক জনগণ। পাঁচ বছর পর পর জনগণের ভোটে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। অতএব ক্ষমতায় টিকে থাকতে এবং পুনরায় ম্যান্ডেট পেতে হলে জনগণের স্বার্থ, মেজাজ-মর্জি, আবেগ ও প্রত্যাশার প্রতি খেয়াল রেখেই ক্ষমতাসীনদের কাজ করতে হয়। একদিকে জনগণের ভোটাধিকার অন্যদিকে অধিকারের প্রশ্নে কথা বলার স্বাধীনতা তথা স্বাধীন গণমাধ্যম গণতন্ত্রের অন্যতম রক্ষাকবচ। এই দু’টি বিষয়ের রক্ষণ রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও সক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের প্রয়োজনে রাষ্ট্রের এসব অঙ্গ সংগঠনগুলোর মধ্যে একটা ভারসাম্যপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার দার্য়িত্ব সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর। কিন্তু কোনো দলীয় সরকার যখন হীনস্বার্থে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যকার পার্থক্য ঘুুঁচিয়ে দিতে চেষ্টা করে, তখন দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে একদলীয় ও একদেশদর্শী মনোবৃত্তি থেকে সংজ্ঞায়িত করে একটি হুজুগে আওয়াজ, প্রোপাগান্ডার কাজে রাষ্ট্রের সব অর্গানকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। বিশেষত: যখন গণমাধ্যম ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে নিজেদের মত নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্বতনমূলক নতুন নতুন আইন প্রণয়ণ ও বাস্তবায়নে বেশি উৎসাহী হয়ে উঠে তখন গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতার অপমৃত্যু ঘটে, জননিরাপত্তা ও মানবাধিকারের বানী ক্ষমতাসীনদের প্রোপাগান্ডা মেশিনের ডামাডোলের আওয়াজে হারিয়ে যেতে থাকে। এভাবেই রাষ্ট্রে ও সমাজে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকা এক শ্রেণীর মানুষ ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করে। এভাবেই একেকজন সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী হয়ে উঠে ক্যাসিনো স¤্রাট, মাদক স¤্রাট, ইয়াবা বদি, তুফান সরকার, বছরের পর বছর ধরে এরা সমাজে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে পুরো সমাজকে একটি দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যে ঠেলে দেয়।

আধুনিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এই স্বাধীনতা এবং তার সংরক্ষণের মানদন্ডগুলো অতি সুক্ষè, আত্মনিয়ন্ত্রিত এবং বৈশ্বিক ও মানবিক দায়বোধের সাথে সম্পর্কযুক্ত। করোনা মহামারীতে আক্রান্ত বর্তমান বিশ্ব বড় ধরণের মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। কোটি কোটি মানুষ প্রাণঘাতি ভয়াবহ ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে, এক মিলিয়নের বেশি মানুষ নিহত হওয়ার পরও তার বিস্তার ও প্রভাব নির্মূলের কোনো সক্রিয় ব্যবস্থা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। করোনার লক-ডাউনে কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে চলেছে। তখন এসব মানবিক দিকগুলোকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে ইচ্ছাকৃতভাবেই অহেতুক অমানবিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন পরাশক্তি দেশগুলোর শাসকদের কেউ কেউ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোর সাম্প্রতিক ইসলাম বিদ্বেষ ও মানবেতিহাসে বিশ্ব শান্তির অন্যতম অগ্রদূত ইসলামের প্রফেট মুহাম্মদের লিগ্যাসি নিয়ে তার কুরুচিপূর্ণ অবস্থান খুবই উদ্বেগজনক। বিশ্বনবীকে নিয়ে ফ্রান্সে ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন ছাপা ও অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টির এই প্রবণতা খুব নতুন বিষয় নয়। শার্লি এবদোর রক্তাক্ত ঘটনার অভীজ্ঞতার পর হোলি প্রফেটের অবমাননার কার্টুন আঁকতে যখন সেখানকার কার্টুনিস্টরাও বিরত থাকতে চাইছে, তখন ইমানুয়েল ম্যাক্রোর অহেতুক প্রকাশ্য ইসলাম বিদ্বেষী ভ’মিকার নেপথ্যে বড় ধরণের ভ’-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে কিনা তা’ই এখন দেখার বিষয়। ইউরোপীয় কোর্ট অব হিউম্যান রাইটস (ইসিএইচআর) ২০১৮ সালে প্রদত্ত এক রায়ে বলা হয়েছে, ‘ ডিফেইমিং দ্য প্রফেট মোহাম্মদ(স.) গোজ বিয়ন্ড দ্য পারমিসিবল লিমিটস অব অ্যান অবজেক্টিভ ডিবেইট’ অ্যান্ড ‘কুড স্টায়ার আপ প্রিজুডিস অ্যান্ড পুট এট রিস্ক রিলিজিয়াস পীস’ অ্যান্ড দাস এক্সিডস দ্য পারমিসিবল লিমিটস অব ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন’। অর্থাৎ বিশ্বনবী মোহাম্মদ(স.)এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা বা অপপ্রচার গঠনমূলক বিতর্কের মানদন্ড বর্হিভুত এবং এ ধরণের তৎপরতা অসহিষ্ণুতা উস্কে দেয় এবং ধর্মীয় শান্তি ও সহাবস্থানের পরিবেশকে নস্যাৎ করে, যা’ মত প্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে গন্য হতে পারে না’। এতদ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে এক অস্ট্রিয়ান নাগরিকের একটি সেমিনারে ইসলামের নবী মোহাম্মদ(স.)এর বিবাহ সংক্রান্ত বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ে করা একটি মামলায় নি¤œ আদালতের রায় বহাল রেখে ইসিএইচআর এই পর্যবেক্ষণমূলক রায় প্রদান করেন। এই রায়ের কথা প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোর অজানা থাকার কথা নয়।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোর অনৈতিক ইসলাম বিদ্বেষের জেরে সারাবিশ্বে প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে। ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য প্রকাশের আগে মধ্যপ্রাচ্যসহ সারাবিশ্বের মুসলমানদের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের ধারাবাহিক অপপ্রচার, সামরিক আগ্রাসন এবং নির্বিচার বোমা বর্ষণ করে লাখ লাখ মুসলমানকে হত্যা, কোটি কোটি মানুষকে গৃহহীন উদ্বাস্তু করে তোলার সময় যদি সব মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে এমন জোরালো প্রতিবাদী ভ’মিকা গ্রহণ করত, তাহলে হয়তো আরো অনেক আগেই মধ্যপ্রাচ্যে রক্তাক্ত ওয়ারফ্রন্ট বন্ধ হয়ে যেত। মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার শতকোটি মানুষের শ্রমে অর্জিত সম্পদগুলো হাজার হাজার টন বোমা, যুদ্ধবিমান, ট্যাঙ্ক-গোলাবারুদ বিক্রির বিনিময়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে পাচার হয়ে যেত না। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেন ও লিবিয়ায় সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের উপর কোটি কোটি শিশু এমন ক্ষুধার্ত- জীবন্ত কংকালে পরিনত হওয়ার দৃশ্য আমাদের দেখতে হত না। ক্রমাগত অপপ্রচার ও ভ্রান্ত জুজু সৃষ্টির মাধ্যমে পশ্চিমারা মুসলমানদের মধ্যে অন্তর্ঘাত সৃষ্টি করে শক্তি ও সম্পদ নষ্ট করে দুর্বল করে পরোক্ষভাবে একটি অর্থনৈতিক ও ভ’-রাজনৈতিক উপনিবেশ কায়েম রাখতে চাইছে। আট বছর ব্যাপী ইরান-ইরাক যুদ্ধের ব্যয় মিটাতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত ও দেউলিয়া হয়ে পড়া ইরাকি অর্থনীতি চাঙ্গা করতে মার্কিনীরা প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে কুয়েত দখলের গ্রীন সিগনাল দিয়েছিল। এর পরের ইতিহাস সবারই জানা। প্রথম গাল্ফ ওয়ারের পর ইরাকের বিরুদ্ধে আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে লাখ লাখ ইরাকি শিশু ক্ষুধা ও অপুষ্টির শিকার হয়ে মারা গিয়েছিল। নব্বই দশকের শুরুতে সংঘটিত সেই যুদ্ধে ইরাকের উপর ভয়াবহ পরিনতির বিষয়ে এক ইন্টারভিউতে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডেলিন অলব্্রাইটকে প্রশ্ন করেছিলেন সিবিএস নিউজের প্রেজেন্টার, তার প্রশ্নটি ছিল, আপনাদের যুদ্ধ ও অবরোধের কারণে ইরাকে ৫ লাখের বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে, এটাকি আপনি যর্থাথ বলে মনে করেন? অলব্রাইটের সাফ জবাব ছিল, ‘দ্য প্রাইস দে ওর্থ ইট’-এটাই তাদের যর্থাথ মূল্য। যে পশ্চিমারা শুধুমাত্র লুন্ঠনের নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখতে প্রতিদিনই অসংখ্য শিশুর রক্ত ঝরাচ্ছে, তারাই বিশ্বশান্তির অগ্রদূত ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে মুসলমানদের সাথে সহাবস্থানের পরিবেশ নস্যাৎ করে বিশ্বকে চরম পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে চাইছে।

তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে ইসলামোফোবিক প্রোপাগান্ডারও বিশ্বায়ণ ঘটেছে। ইউরোপ আমেরিকা থেকে শুরু করে শতকরা ৯০ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশেও একশ্রেনীর নামধারি মুসলমান ইসলামের মৌলিক আক্বিদা ও বিশ্বাসের উপর আঘাত করে নিজেদের আধুনিক ও প্রগতিশীল বলে জাহির করার চেষ্টা করছেন। ইদানিং বিভিন্ন টিভি টকশো তে সমাজে সুপরিচিত ও সময় রাষ্ট্রের উচ্চ আসনে দায়িত্ব পালনকারি কিছু কথিত শিক্ষিত মানুষের ইসলাম বিদ্বেষ দেখে হতবাক হতে হয়। এদের সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ মানুষের যে প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য তা অনেকাংশেই প্রণিধানযোগ্য নয়। তবে ইসলামের ইতিহাস, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা ও মূর্খতা সাধারণ মানুষের কাছেও ধরা পড়ে যাচ্ছে। অথবা কোনো নেপথ্য শক্তির পেইড এজেন্ট হয়ে তারা আমাদের সমাজের ধর্মভীরু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসের উপর আঘাত করে তাদেরকে রাস্তায় নামাতে বাধ্য করতে চাচ্ছে। অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক নানা কারণে তৃতীয় বিশ্বের সরকারগুলো তাদের এই অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বা কথা বলতে পারে না। তবে সাম্প্রতিক ম্যাক্রোর ইসলাম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানসহ বেশকিছু নেতার সাহসী ও দৃঢ় ভ’মিকা কিছুটা হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে রাষ্ট্রশক্তি কায়েমি স্বার্থবাদের কাঝে জিম্মি হয়ে পড়লেও মুক্ত গণমাধ্যম, গণমাধ্যমকর্মী, সাংবাদিক-লেখকদের সাহসী, দলনিরপেক্ষ, অনুসন্ধানি ও দূরদৃষ্টিপূর্ণ লেখনি জাতিকে সঠিক পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিতে পারে। চলমান সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিশ্বের কোথাও গণমাধ্যম সেই ভ’মিকা সঠিকভাবে পালন করতে পারছে না। তবে আমাদের দেশে এই বাস্তবতা অনেক বেশি পীড়াদায়ক-অর্গলবদ্ধ। সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু গণমাধ্যমে উঠে এসেছে শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে। দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি মোবাইলফোন ইন্টারনেট সেবা গ্রহিতা এবং ফেইসবুক-ইউটিউবের মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী সিটিজেন জার্নালিস্টের ভ’মিকা পালন করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া তথ্য, ছবি ও ভিডিও ক্লিপিংস মুহূর্তে কোটি কোটি মানুষের মধ্যে ভাইরাল হয়ে একেকটি প্রতিবাদী অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করে তথাকথিত প্রভাবশালী ক্ষমতাধর দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীদের গডফাদারদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

ঢাকার একজন প্রভাবশালী ধনাঢ্য এমপি’র পুত্র ও দেহরক্ষীদের হাতে নৌবাহিনীর একজন ল্যাফট্যানেন্ট লাঞ্ছিত-রক্তাক্ত হওয়ার পরের ভিডিও ক্লিপিংস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর সারাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ার প্রেক্ষাপটে সেই এমপিপুত্র কাউন্সিলরকে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে আইনরশৃঙ্খলা বাহিনী। সেই অভিযানে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্যাবলী। আগের দিনের জমিদারবাবুরা খাজনা প্রদানে ব্যর্থতা এবং জমিদারের হুকুম অমান্যকারীদের জন্য নিজস্ব বাহিনী ও টর্চারসেল তৈরী করত। এখন ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা সন্ত্রাসী, দখলবাজ, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজরাও যার যার মত করে নিজস্ব বাহিনী ও টর্চারসেল গড়ে তুলেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক শ্রেণীর সদস্য তাদের সহযোগী এবং আজ্ঞাবহ ভ’মিকা পালন করে চলেছে। কক্সবাজারের সেই কুখ্যাত ওসির হাতে দুই বছরে দুইশত মানুষের ক্রসফায়ারে মৃত্যুর অভিযোগ তখনি উঠে আসে যখন তার নির্দেশে একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা নিহত হন, এর প্রতিক্রিয়ায় দেশের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এই হত্যাকান্ডের বিষয়ে বিশেষ উদ্বেগ ও বার্তা প্রকাশ করা হয়। একইভাবে নিজের পরিচয় দেয়ার পরও নৌবাহিনীর লেফট্যানেন্ট ওয়াসিফকে মেরে রক্তাক্ত করে দাঁত ভেঙ্গেফেলা এবং হত্যাচেষ্টার ঘটনাটি ভাইরাল হওয়ার পর দেশের মানুষ এবং সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের বার্তা প্রকাশিত হওয়ার পর অভিযান চালানোর আগে কত মানুষ তাদের হাতে লাঞ্ছিত, প্রহৃত, দখলবাজি-চাঁদাবাজির শিকার হয়েছেন তার খতিয়ান এখনো অজানা। বিশেষ বাহিনীর সদস্য বা প্রভাবশালী কারো গায়ে হাত দেয়ার পরই কেবল তাদের কুকর্মের ইতিহাস মানুষ জানতে পারছে। নচেৎ সবকিছুই ডালভাত। স্থানীয় সাধারণ মানুষ তাদের ভয়ে মুখ খুলতেও যখন সাহস পায় না, তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্য সহযোগি ও আজ্ঞাবহের ভ’মিকা পালন করে তাদেরকে আইনের ঊর্ধ্বে তুলে দেয়। তবে যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, নিপীড়কের শেষরক্ষা কখনোই হয়না।

গণতন্ত্রহীনতা ও বিচারহীনতার কারণে কিছু(হয়তো অধিকাংশ)জনপ্রতিনিধি অত্যাচারি জমিদারের ভ’মিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার থেকে শুরু করে পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের মেয়র-কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার জন্য জনগণের ভোটের প্রয়োজন হয়নি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কয়েকটি উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল শতকরা ১০ ভাগের মত। অর্থাৎ শতকরা ৯০ভাগ ভোটার এই নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখতে পারেনি। প্রতিটি নির্বাচনে সরকারী দলের প্রার্থীরা একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রের সৌন্দর্য, প্রত্যাশা ও আবেদন খর্ব করেছে। মামলা, হামলাসহ রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের তৎপরতা সীমিত ও দুর্বল করার সবার্ত্মক অপপ্রয়াস কখনো বন্ধ হয়নি। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নিস্ক্রীয়তায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমত গঠনে শুণ্যস্থান পুরণ করতে পারে স্বাধীন গণমাধ্যম ও মুক্ত সাংবাদিকতা। কিন্তু বিচারহীনতার সংস্কৃতি মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধুমাত্র পেশাগত দায়িত্বশীলতার কারণে সাংবাদিকরা বার বার প্রভাবশালীদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। সবচেয়ে বিষ্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে সাংবাদিক হত্যা নির্যাতনের কোনো ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দৃষ্টান্ত নেই। সেই চারদলীয় জোট সরকারের আমলে খুলনা প্রেসক্লাবের সভাপতি হুমায়ুন কবির বালু ও দৈনিক সংবাদের খুলনা ব্যুরো চীফ মানিক সাহা সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছেন, গত ১৬ বছরেও সেই ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সাগরসরওয়ার ও মেহেরুন রুনী নিজ বাসায় নিহত হওয়ার পর দেশের সব সাংবাদিক ইউনিয়ন নিজেদের সব ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘন্টার মধ্যে অপরাধীদের খুঁেজ বের করার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। এরপর সাংবাদিকদের আন্দোলনের মাঝপথে অঘোষিত বিভক্তি ঘটে যাওয়ার পর সবকিছু থেমে গেছে।

গত ৮ বছরেও সাগর-রুনী হত্যা মামলার বিচার কাজ শুরু হয়নি। দেশের গণমাধ্যম ও সংবাদকর্মীদের কণ্ঠরোধ করতে একদিকে শত শত সন্ত্রাসী-গডফাদার সব সময় রক্তচক্ষু প্রদর্শন করছে, অন্যদিকে একচেটিয়া ক্ষমতার ব্যবহার নিশ্চিত রাখতে নতুন নতুন নির্বতনমূলক আইন তৈরী করছে সরকার। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধের আশঙ্কায় বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে দেশের সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সরকারের তরফ থেকে এই আইনের অপব্যবহার না করার বিষয়ে নিশ্চয়তা দেয়া হলেও সেই নিবর্তনমূলক আইনের প্রতিবাদে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলার অগ্রসেনানী প্রবীন সাংবাদিক নেতা, দেশের বৃহত্তম সাংবাদিক সংগঠন বাংলাদেশ ফেডারেল ইউনিয়নের(বিএফইউজে) নির্বাচিত সভাপতি রুহুল আমীন গাজীকে সেই আইনে গ্রেফতার করে জেলে দেয়া হয়েছে। এখন সাংবাদিক সমাজের একাংশ তার মৃুক্তির দাবিতে আন্দোলন করছে। প্রবীণ বর্ষিয়ান লেখক-সাংবাদিক আবুল আসাদসহ আরো বেশ কয়েকজন সাংবাদিক বিতর্কিত তথ্যপ্রযুক্তি আইনে এই মুহূর্তে কারারুদ্ধ আছেন। এ সপ্তাহে চট্টগ্রামে সাংবাদিক গোলাম সারওয়ারকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তিনদিন তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। অবশেষে একটি অ্যাস্বুলেন্স থেকে রাস্তার পাশে তাকে ছুঁড়ে ফেলে ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। এরা কারা। হাজী সেলিমের বাড়িতে টর্চার সেল, অবৈধ অস্ত্র, হ্যান্ডকাফ, মাদক, ওয়াকিটকিসহ নিজস্ব অবৈধ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ও সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে র‌্যাব। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে লোকজনকে ধরে এনে টর্চার করে বড় স্বার্থ হাসিল অথবা মুখ বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা করত বলে সংশ্লিষ্টদের ধারনা। গোলাম সারওয়ার হয়তো প্রাণে বেঁচে গেছেন, তবে তিনি একটি ভয়াবহ ট্রমায় ভুগছেন। উদ্ধার হওয়ার পর অর্ধচেতন অবস্থায় বার বার বলেছেন, আমাকে মারবেন না, আমি আর নিউজ করব না। এ থেকেই অনুমান করা যায়, আমাদের গণতন্ত্র, জননিরাপত্তা, আইনের শাসন ও গণমাধ্যমকর্মীদের অবস্থান আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদের হুমকি ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ঠেলে দিয়ে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গণমাধ্যম


আরও
আরও পড়ুন