Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ব্যারিস্টার রফিক-উল হক কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ | প্রকাশের সময় : ১০ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

বাংলাদেশের সচেতন সমাজে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের নাম জানেন না এমন লোক কমই আছেন। তিনি ছিলেন দেখতে ছিমছাম, চলাফেরায় স্মার্ট ও আচরণে গাম্ভির্যপূর্ণ। তৎকালীন পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালতে বিলেত থেকে পড়াশুনা করে যে ক’জন ব্যারিস্টার আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন তার মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। বাংলাদেশ সৃষ্টি থেকে যে কয়জন আইনজীবী পেশায় সর্বোচ্চ আসনে স্থান পেয়েছেন তার মধ্যেও তিনি অন্যতম। আইন পেশায় আসার আগে ছাত্র অবস্থায় মিডিয়ার মাধ্যমে যে কয়জন আইনজীবী সম্পর্কে আমি জেনেছি তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক।

আমি সুপ্রিম কোর্টে রেগুলার প্রাকটিস শুরু করি ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের সাথে। স্যার যেহেতু আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ ও বার কাউন্সিলের নেতৃত্ব দিতেন, সে কারণে যে সকল সিনিয়ররা বার রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন তাদের সকলের নিকট থেকেই স্নেহ পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তবে ২০০০ সালের পূর্ব পর্যন্ত ব্যারিস্টার রফিক-উল হক স্যারের তেমন কোন সান্নিধ্য আমি পাইনি, যদিও বিভিন্ন আদালতে তার উপস্থিতি, শুনানি ও যুক্তিতর্ক দেখেছি। সকলেই হয়ত জানেন সর্বোচ্চ আদালতে বিচারপ্রার্থীরা বিশেষ করে বিত্তশালী ও বিভিন্ন প্রভাবশালী উচু-স্তরের মানুষজন সিনিয়র, বিজ্ঞ ও নামকরা আইনজীবীদের নিয়োগ করে থাকেন। একপক্ষ যখন ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে নিয়োগ করতেন অন্যপক্ষ তখন ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ড. জহির বা অন্য কোন সিনিয়র আইনজীবীকে নিয়োগ করতেন। উদ্দেশ্য হলো, আইনি প্রক্রিয়াতে যেন দুর্বলতা না থাকে। সে কারণে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সাহেব যে মামলায় একপক্ষে নিয়োজিত থাকতেন অনেক সময় উক্ত মামলায় ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে নিয়োগ করা হতো এবং তার জুনিয়র হিসেবে আমাকে ফাইলপত্র নিয়ে স্যারের সাথে সাথে থাকতে হতো তাঁকে সহযোগিতা করার জন্য। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম তার জুনিয়র থাকা অবস্থায় সরাসরি কোনো মামলায় রফিক-উল হক স্যারের বিপক্ষে দাঁড়ানোর সুযোগ হয়নি। তবে যতদূর মনে পড়ে, প্রথম ২০০১ সালে একটি আদালতে প্রথম তাঁর শুনানির পরে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের অনুপস্থিতির কারণে আমাকে শুনানিতে দাঁড়াতে হয়েছিল। আমি আদালতে কিছু বিষয় উস্থাপন করার পরে সময়ের আবেদন জানাতেই সাথে সাথে রফিক-উল হক স্যার উঠে দাঁড়িয়ে তীব্র ভাষায় আপত্তি জানিয়ে আমাকে ভর্ৎসনা করেন। আমি মনে করেছিলাম যে, বিচারক হয়ত হস্তক্ষেপ করবে সে জুনিয়র হিসাবে যা বলছে, বলতে দিন। কিন্তু কিছু সময় পরে সেরকম কিছু না হওয়ায় আমিও জোরে জোরে রফিক-উল হক স্যারের বক্তব্যের বিরোধিতা করে কথা বলা শুরু করলাম। এক পর্যায় মামলায় পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হলো। আমি ভয়ে ছিলাম যে, স্যার হয়ত আমার সিনিয়রের নিকট আমার সম্পর্কে অভিযোগ করতে পারেন। কিন্তু কয়েকদিন পরে বুঝলাম, না, সেরকম কিছু হয়নি। আমরা মনে একটা ধারণা সৃষ্টি হলো, স্যার এটাকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নেননি, যেটা আমাদের প্রাকটিসে অনেকটা স্বাভাবিক ঘটনা।

ব্যারিস্টার রফিক-উল হক স্যার বার রাজনীতিতে দলীয় ফোরামে জড়িত ছিলেন না ঠিকই, তবে বিশেষ ক্ষেত্রে সকল ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা থাকত। একবার সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হল, তখন বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। সকল আইনজীবী মাননীয় প্রধান বিচারপতির অফিসে যাচ্ছিলেন, আমিও গেলাম। সেখানে পৌঁছে দেখলাম, অন্য সিনিয়রদের সাথে রফিক-উল হক স্যারও উপস্থিত আছেন। বারের বর্তমান দলীয় বিভক্তি যখন তত জোরালো ছিল না তখন যে কোনো সমস্যা সমাধানে সকল সিনিয়র যখন বসতেন তার মধ্যে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকও থাকতেন।

ওয়ান ইলেভেনের সময় বিভিন্ন ব্যক্তির রাস্তার পাশ্ববর্তী স্থাপনা উচ্ছেদ করা শুরু হয়েছিল বিভিন্ন বাহিনীর উদ্যোগে। তারই ধারাবাহিকতায় একসময় ব্যারিস্টার রফিক-উল হক স্যারের গাজীপুরে রাস্তার পাশে তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের একটি অংশ ভেংগে দেয়া হয়। তিনি তখন হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করলে আদালত রুল জারি করেন এবং সেনাবাহিনীর একজন অফিসারকে আদালতে তলব করা হয়। এরকম একটি ঘটনা বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে। কারন তৎকালীন উক্ত উচ্ছেদে সাধারণত কোনো বাধা দেয়ার সাহস কেউ দেখাতে চাইতেন না। পরবর্তীতে তৎকালীন সেনা সমর্থিত সরকার তাদের বিভিন্ন তৎপরতা বৃদ্ধি করে ব্যবসায়িক ও রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি তদন্ত ও গ্রেফতার শুরু করে। তখন উক্ত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রধান দলগুলোর সাথে সম্পর্কিত সিনিয়র আইনজীবীরা মামলা করতে কিছুটা বিব্রত বোধ করতেন। যেহেতু ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সাহেব ইতোমধ্যে আইনি লড়াইয়ে যুক্ত হয়েছেন সে কারণে তখন অনেকে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ তাঁকে আইনি লড়াইতে নিয়োগ করেন এবং তিনি একটার পর একটা মামলা লড়তে থাকেন। আপনারা হয়ত ভুলে জাননি যে তৎকালীন সেনা কর্মকর্তারা আইনগত বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য আইনজীবীদের নিয়ে একটি সভা করেছিলেন, যেখানে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন বা আছেন এরকম অনেকে উপস্থিত ছিলেন, এমনকি অনেক সিনিয়র আইনজীবীরাও উপস্থিত ছিলেন। আমাকেও বলা হয়েছিল কিন্তু যাওয়া হযনি। উক্ত সভার উদ্দেশ্য ছিল সেনা সমর্থিত সরকারের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মামলা লড়তে অনুৎসাহিত করা। তারা অনেকটা কৃতকার্য হয়েছিল। সেনা সমর্থিত সরকার যখন ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের হয়রানি বা মামলা দেয়ার ক্ষেত্রে দুদককে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করত এবং সে সময় বর্তমান আইনমন্ত্রী ছিলেন দুদকের অন্যতম আইনজীবী। এক পর্যায় প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেত্রীকে গ্রেফতার করে বিভিন্ন অভিযোগে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়। যেহেতু একটি সভা ডেকে আইনজীবীদের মামলা পরিচালনায় নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল, সে ভয়ভীতির কারণে আনেক নামকরা আইনজীবী রাজনৈতিক নেতাদের মামলা পরিচালনায় উৎসাহ দেখাননি। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে অনেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রীর মামলা নিম্ন আদালতে ট্রায়াল করেছেন। তবে উচ্চ আদালতে দুই দলীয় প্রধানের মামলা পরিচালনার প্রসংগ যখন আসে তখন বিভিন্ন ভয়ভীতির কারণে সংশ্লিষ্ট দলের অনেক সিনিয়ির আইনজীবী মামলা পরিচালনায় উৎসাহ না দেখানোর কারণে দুই দলীয় প্রধানের পক্ষে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আইনি লড়াই করতে এগিয়ে আসেন। সকলেই স্বীকার করবেন, ওই সময়ে যুগোপযোগী সাহসিকতা তিনি দেখিয়েছেন। সে সময় সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এবং তাকে সহযোগিতা করেছেন শাহ মঞ্জুরুল হক, এহসানুল করিম, ফাহিমুল হকসহ আরও অনেকে। আমার মতে, ওয়ান ইলেভেনের পরে একটি বিরাট পরিবর্তন সাধিত হল আইন পেশায়। এর আগে যেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্য সিনিয়র আইনজীবীরা গুরুত্ব পেতেন কিন্তু ওয়ান ইলেভেনের পরে অনেক ব্যবসায়ী বা রাজনীতিককে মামলা পরিচালনায় ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের দারস্ত হতে দেখেছি।

২০০৯ সালের জনস্বার্থের মামলায় ব্যপক প্রসার ও ঐজচই এর পক্ষ হতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলায় আমার সৌভাগ্য হয়েছে আদালতে আইনি লড়াইতে সম্পৃক্ত হবার, যে কারণে অনেক মাললায় আমার বিপক্ষে রফিক-উল হক স্যার থাকতেন। আমি তাকে ব্যক্তিক্রম হিসেবে পেয়েছি। আমার বিপক্ষে জনস্বার্থের মামলায় অন্য অনেক সিনিয়র আইনজীবী বা অ্যাটর্নি জেনারেল মামলা পরিচালনার সময় যুক্তি উপস্থাপন করতেন যে, জনস্বার্থের মামলাটি কারও স্বার্থে করা হয়েছে বা বিদেশি অর্থে করা হয়েছে বা সরকারকে বিব্রত করতে করা হয়েছে বা উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ করতে করা হয়েছে, এছাড়া আরও অনেক আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেয়া হত, কিন্তু ব্যতিক্রম হল ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। তিনি শুনানিতে ওরকম বক্তব্য দেননি বরং আইনি মারপ্যাঁচ জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন। যদিও ২০১৫ সালের পরে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে কারণ এর মধ্যে সকলেই জানতে পেরেছেন যে, ঐজচই শুধুমাত্র জনস্বার্থে পরিবেশ ও মানবাধিকার বিষয় কাজ করে। শুধু তাই নয় আদালতে জনস্বার্থের মামলায় আমার বিপক্ষে মামলা পরিচালনা করলেও বাাইরে এসে অনেক সিনিয়র আইনজীবী আমাকে উৎসাহ দেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক প্রসংগে বলতে হচ্ছে যে, তিনি কোন শুনানিতে ঐজচই এর বিপক্ষে কোন আক্রমণাত্মক বক্তব্য রাখেননি। তবে এটা তিনি বিশ্বাস করতেন কিনা যে ঐজচই পক্ষে আমি যে মামলাগুলি করছি তা জনস্বার্থেই করা হচ্ছে, তা আমার ধারণা ছিল না। ধারণটা স্পষ্ট হল সুপ্রিম কোর্টের অডিটিরিয়ামে ড. ভ্যালেরি টেলরকে ঐজচই অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে স্যারের একটি বক্তব্যে। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক স্যার উপস্থিত থাকায় তাকে বক্তব্য দেবার জন্য ডাকা হয়, তিনি তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট করলেন আমাদের সম্পর্কে তাঁর ধারণা। তিনি বলেছেন ও প্রসংশা করেছেন ঐজচই এর জনস্বার্থের কাজের। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা বিশেষভাবে প্রয়োজন তা হল, সুপ্রিম কোর্টের সম্পত্তি উদ্ধারে আমি যখন মামলাটি করেছিলাম তখন যে কোন পক্ষের একটি জবাব তিনি সুন্দরভাবে নিজে লিখে দিয়েছিলেন, যা মামলায় দাখিল করা হয়েছে। জবাবটা তিনি লিখে দিয়েছিলেন বিশেষ একটা অনুরোধে, যা আমি পরবর্তীতে জানতে পেরেছি।

আমার মতে রফিক-উল হক স্যার নিজ চেম্বারের মামলায় যে সকল রায় পেয়েছেন অনেক ক্ষেত্রেই তা মক্কেলদের কাজে লেগেছে। কিন্তু যে সব মামলায় স্যার এমিকাস কিউরি ছিলেন সে সব মামলা থেকে আমরা সাধারণভাবে উপকৃত হয়েছি। সাংবিধানিক ইস্যু নিয়ে সকল গুরুত্বপূর্ণ মামলায় তিনি কোন না কোনভাবে সংযুক্ত ছিলেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলায় আপিল বিভাগে এমিকাস কিউরি হিসাবে শুনানি করতেন স্যার এবং সংবাদ পেলেই যেতাম। এমিকাস কিউরি হিসাবে স্যারের শুনানি থেকে অনেক কিছু জানতে পেরেছি এবং অনুসরণ করছি। আমার জানা মতে, ষোড়শ সংশোধনী মামলা ব্যতিত প্রায় সকল সাংবিধানিক ইস্যুর মামলায় তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন এবং অবদান রেখেছেন। তাঁর পরিচালিত সে সব মামলার রায় বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আইনজীবীরা তা থেকে উপকৃত হবেন বলে আমার বিশ্বাস। স্যার অসুস্থ হবার আগ পর্যন্ত কয়েকটি জনস্বার্থ মামলায় আমার বিপক্ষে ছিলেন, শুনানি শেষ করে স্যার আমার পিঠে হাত দিয়ে ডায়াসে এগিয়ে দিতেন শুনানি করার জন্য। এমন স্নেহ, আদর আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এছাড়া ব্যারিস্টার রফিক-উল হক স্যারের শুনানির প্রস্তুতির বিষয় সম্পর্কে আইনিজীবী সূত্রে মিডিয়ায় অনেক বক্তব্য এসেছে, আমিও একমত, স্যার যেভাবে সকল ফাইলে প্রস্তুতি নিতেন, যা বিভিন্ন রঙিন ট্যাগ ব্যবহার করা থেকে বোঝা যেত, এমনটি সাধারণত দেখা যায় না।
লেখক: প্রসিডেন্ট, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন