Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ফলাফলে শহর-গ্রামের পার্থক্য ঘোচাতে পদক্ষেপ অত্যাবশ্যক

প্রকাশের সময় : ২০ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বিশিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষাবিদদের অভিমত
শফিউল আলম : ‘মেধা’ ও ‘ভাল’ ফলাফল মানে যেন শহর। ভাল ফলাফল হয়ে গেছে অনেকটাই শহর-নগরে কেন্দ্রীভূত। গ্রাম বা মফস্বল পেছনেই পড়ে থাকছে। দেশের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ দু’টি পাবলিক পরীক্ষা মাধ্যমিক (এসএসসি) ও উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) বছর বছর তারই সুস্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। আগের মতো এবারও উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমমানের পরীক্ষার ফলাফলে শহর-নগরের তুলনায় গ্রামাঞ্চল তথা মফস্বলে পাসের হার অনেক কম। জিপিএ-৫-এর প্রাপ্তি আরও কম। এতে করে গ্রামাঞ্চল বা মফস্বল থেকে আসা শিক্ষার্থী যারা ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, যশোরসহ বড় বড় শহর-নগরের সরকারি এবং ‘নামকরা’ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যলয়সমূহে ভর্তিযুদ্ধের জন্য প্রতিযোগিতায় লড়ছে তাদের মধ্যে ভর্তির জন্য বাছাই হয়ে টিকতে পারছে খুবই স্বল্পসংখ্যক। শহর-গ্রামের ব্যবধান আরও বেড়ে যাচ্ছে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শহর-গ্রামের ফলাফলের পার্থক্য পরিকল্পিতভাবে ঘোচাতে দ্রুত পদক্ষেপ অত্যাবশ্যক এমনটি অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিশিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষাবিদগণ। সদ্য প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের নিরিখে গতকাল (শুক্রবার) দৈনিক ইনকিলাবের সাথে আলাপকালে তারা উপরোক্ত অভিমত দিয়েছেন।
সবক’টি শিক্ষাবোর্ডের ফলাফল অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, শহর-নগরের পরীক্ষার্থীরা নিরঙ্কুশ সফলতা অর্জন করলেও গ্রাম বা মফস্বল অনেক পিছিয়ে আছে। গ্রামের অধিকাংশ কলেজ আশানরূপ ভাল ফলাফল করতে না পারার কারণেই সার্বিক ফলাফলে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। গ্রামাঞ্চলের কলেজগুলো যদি শহর-নগরের কলেজগুলোর মতো ভালো ফলাফল করতে পারতো তাহলে শিক্ষাসমূহের সার্বিক ফলাফল আরও উন্নত হতো।
উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়Ñ চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ২ হাজার ২৫৩ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১ হাজার ৯৬৫ জনই হচ্ছেন বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরকারি কলেজগুলোসহ বিভিন্ন ‘নামী’ কলেজের। অথচ মহানগরী ছাড়া চট্টগ্রাম জেলাজুড়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে মাত্র ৪১৭ জন। পাসের হার ৫০ শতাংশেরও নিচে এমন কলেজ জেলায় বেশি রয়েছে। এ বোর্ডে পাসের হার ৫০ শতাংশের নিচে এমন প্রতিষ্ঠান ৫৪টি। এরমধ্যে ৩৭টিই গ্রামে অবস্থিত।
চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মোঃ মাহবুব হাসান দৈনিক ইনকিলাবের সাথে আলাপকালে জানিয়েছেন, গ্রাম বা মফস্বলের কলেজগুলোর অনেক সমস্যা-সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে শহর-গ্রামের মধ্যকার ফলাফলে ব্যবধান অনেকাংশে কমে আসবে। অবশ্য সরকার সেই উদ্যোগ দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, গ্রাম বা মফস্বলের কলেজগুলোতে ইংরেজি ও বিজ্ঞান বিষয়সমূহের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। তদুপরি শ্রেণিকক্ষ, পাঠদান, অবকাঠামো সুবিধা, দক্ষ ও অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং শিক্ষা উপকরণ শহরের তুলনায় গ্রামে কম। গ্রামের চেয়ে শহরাঞ্চলের অভিভাবকরা সন্তানদের পড়াশোনা নিয়ে বেশি সচেতন। শহরের অনেক অভিভাবক সন্তানদের কোচিংসহ বিভিন্ন শিক্ষাখাতে যে অর্থ ব্যয় করেন আবার সে ক্ষেত্রে গ্রামের অভিভাবকদের সামর্থ্য সে তুলনায় কম। এসব ব্যবধান ক্রমান্বয়ে ঘুচিয়ে আনা সম্ভব হলে গ্রামের পরীক্ষার্থীরাও ভাল ফলাফল অর্জন করবে। তিনি মনে করেন, গ্রামের কলেজগুলোর ফলাফল আরও ভালো করার সুযোগ নিশ্চয়ই আছে। আমাদের গ্রামেও যথেষ্ট মেধা রয়েছে। তাদের উপযুক্ত পরিচর্যা প্রয়োজন। গ্রামের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের আরও সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই সার্বিক ফলাফলের চিত্র আমুল পাল্টে যাবে।
এই বিষয়ে দৈনিক ইনকিলাবের সাথে আলাপকালে সরকারি হাজী মুহম্মদ মহসিন কলেজের গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেছেন, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গ্রাম বা মফস্বল এবং শহর-নগরের কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফলাফলে বিরাট পার্থক্য সূচিত হচ্ছে। যা কারও কাম্য নয়। এর পেছনে বিভিন্ন কারণও রয়েছে। এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলের তথা মফস্বলের কলেজগুলোতে নিবন্ধনের আগেই নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের উপযুক্ত দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের অভাব, বয়সের ভার, শিক্ষক স্বল্পতা ও একেকজন শিক্ষকের একাধিক বিষয়ে ক্লাস নেয়া ইত্যাদি সমস্যা জিইয়ে রয়েছে। মফস্বলের কলেজগুলোতে দেখা যাচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীরা পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, আইসিটি ও ইংরেজীতে তুলনামূলক খারাপ ফলাফল করছে। আর এসব বিষয়েই উপযুক্ত প্রশিক্ষিত, দক্ষ শিক্ষকের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে প্রায়ই বেসরকারি কলেজ হওয়ায় সেখানে সরকারি কলেজের সমান ও সমমানের শিক্ষক নেই। তিনি জানান, গ্রামের অভিভাবকরাও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন নন। সে তুলনায় শহর-নগরের অভিভাবকরা অনেক সচেতন। গ্রামের অভিভাবকদের আর্থিক সংগতির অভাব রয়েছে। সে কারণে তারা সন্তানদের চাহিদামতো ভাল শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট ও কোচিং করাতে চাইলেও পারেন না। গ্রামের কলেজসহ অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। শহর-নগরের তুলনায় মফস্বলের পরীক্ষার্থীরা ফলাফলে ভাল না করার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করে অধ্যাপক কামাল হোসেন জানান, এসএসসি পাসের পর গ্রামের মেধাবীরা অনেকেই শহরমুখী হয়ে যায়। ভাল ভাল কলেজে ভর্তি হয়। আর গ্রামের কলেজগুলোতে থেকে যায় তুলনামূলক কম মেধাবীরা। গ্রাম বা মফস্বলের কলেজগুলোর অবকাঠামো সমস্যা ও ঘাটতি দূরীকরণ, মেধাবী ও দক্ষ-প্রশিক্ষিত উপযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রয়োজন মেটানো হলে সেইসাথে গ্রামের মেধাবীরা যাতে শহরমুখী না হতে হয় সে ধরনের শিক্ষার পরিবেশ সামগ্রিকভাবে উন্নত হলেই গ্রাম-শহরের ফলাফলে ব্যবধান থাকবে না বলে তিনি দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করেন।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাইস্কুলের শিক্ষক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান গতকাল ইনকিলাবকে জানান, বিভিন্ন বিষয়ে সৃজনশীলের জন্য শহর-নগরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে দক্ষ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও যথোপযুক্ত শিক্ষকের অভাব প্রকট। গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষক নতুন পদ্ধতির সাথে একাত্ম হতে পারছেন না কিংবা সময় লাগছে। তাছাড়া সার্বিকভাবে গ্রামের অভিভাবকদের সন্তানদের প্রতি সচেতনতা কম। তাদের আর্থিক অস্বচ্ছলতাও রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে স্কুল-কলেজগুলোতে ইংরেজী ও গণিত বিষয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষিত ও দক্ষ-অভিজ্ঞ শিক্ষকের খুবই ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে পরীক্ষার্থীরা ফলাফল বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে অনেকেই। গ্রামে ভাল ফলাফলের হার বৃদ্ধি করতে হলে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ-অভিজ্ঞ ও উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে, পর্যাপ্ত শিক্ষকের প্রয়োজন মেটানো অপরিহার্য। তা না হলে ফলাফলে গ্রাম-মফস্বল বরাবরের মতোই পিছিয়ে থাকবে।
গ্রাম-শহরের সার্বিক ফলাফলের নেতিবাচক চিত্র প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষক আশেকুর রহমান বলেছেন, এক্ষেত্রে শিক্ষকদের গুণগতমান একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। গ্রামাঞ্চলের কলেজগুলোর অনেক শিক্ষক উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পান না। অনেকে প্রশিক্ষণ নিতেও চান না। শিক্ষক প্রশিক্ষণকে কেউ কেউ টিএ-ডিএ পাওয়ার সুযোগ হিসেবে নিচ্ছেন। অথচ শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ অত্যন্ত অপরিহার্য। উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবে গ্রামের অনেক কলেজ শিক্ষক যুগোপযোগী পাঠদান করতে পারেন না। কেননা তারা আপডেটেড থাকেন না। গ্রাম-শহরের এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে ভারসাম্য আনতে হলে বিশেষ করে গ্রামের বেসরকারি কলেজগুলোতে ভাল তথা দক্ষ, অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে হবে। তিনি বলেন, গ্রামের শিক্ষার্থীরা ভাল শিক্ষকের কাছে পড়ার জন্য এবং ভাল কোচিং-প্রাইভেটের খোঁজে প্রতিনিয়ত শহরমুখী হয়ে যাচ্ছে। এসব সুবিধা শহরে কেন্দ্রীভূত থাকায় শিক্ষার্থীরা গ্রামে থাকতে চায় না। গ্রামের কলেজগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ ও সুযোগ আরও উন্নত করলে গ্রামের মেধাবীরা গ্রামে থাকবে। পরীক্ষার ফলাফলেও ভারসাম্য আসবে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ফলাফলে শহর-গ্রামের পার্থক্য ঘোচাতে পদক্ষেপ অত্যাবশ্যক
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ