Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ডেঙ্গুর চোখ রাঙানি

গাণিতিক হারে বাড়ছে রোগী মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করতে হবে : প্রফেসর ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ সারা বছর মশা নিধন চালাতে হবে : অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম কারোনায় এ রোগ এতদিন চাপা ছিল : অধ্যাপ

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৩ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু গত বছর ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছিল। চলতি বছরের ৮ মার্চ করোনার পাদুর্ভাব ঘটার পর কোভিড-১৯ মহামারি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও করোনায় মারা গেছে সাড়ে ৬ হাজারেরও বেশি। গতকাল পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যাও চার লাখ ৬৯ হাজার ৪২৩ জন। করোনাভাইরাসের মধ্যেই শুরু হয়েছে ডেঙ্গুর চোখ রাঙানি। সরকারি হিসেবে মতেই গত অক্টোবরের চেয়ে নভেম্বর মাসে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে তিনগুন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার ডেঙ্গুর ধরন পালটাচ্ছে। আগে এটা ছিল মৌসুমি রোগ। এখন সারা বছর ধরেই হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মশা বেঁচে থাকলে বছরের যে কোনো সময় ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিতে পারে। ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শফি আহমেদ বলেন, ডেঙ্গু বাড়ছে। প্রতিদিন হাসপাতালে অনেক শিশু ডেঙ্গু রোগী আসছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার শিশু ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি।

জানতে চাইলে প্রফেসর ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এডিস মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করতে হবে। আর এ কাজটি সিটি করপোরেশনের। ডেঙ্গু জ্বর হলে প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধ ও বেশি করে পানি খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যাসপ্রিন জাতীয় কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না। শীতে আরো বাড়বে। তাই সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। বিশেষ করে মাস্ক পরলেই অনেকটা নিরাপদ থাকা যাবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, কোভিড-১৯ নিয়ে ভাবতে গিয়ে অন্যান্য রোগের বিষয়ে আসলে তেমন আলোচনা হয়নি। তবে ডেঙ্গু রোগ এখন বাড়ছে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। এটা বলা যেতে পারে যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু রোগীর শনাক্ত বাড়ছে। আসলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যেতে হবে সারাবছর। সমন্বিতভাবে বিভিন্ন সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে।

সরকারি হিসেন অনুযায়ী দেশে চলতি বছর এখন পর্যন্ত এক হাজার ১৯৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। মশাবাহিত এ রোগের প্রকোপ অন্যান্য বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর শেষে কমতে শুরু করলেও এ বছর নভেম্বরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা গাণিতিক হারে বেড়েছে। ২০১৯ সালের তুলনায় চলতি বছর ডেঙ্গু সংক্রমণ কম হলেও অক্টোবর মাসে দেশে ১৬৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। তবে নভেম্বরে মাসে মোট ৫৪৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। যা আগের মাসের তুলনায় ৩ দশমিক ৩৫ গুণ বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশে নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে যদি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে তবে তা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তাই ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে কর্মসূচি ও জনগণের মাঝে সচেতনতা খুবই জরুরি।

চিকিৎসা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, কোভিড-১৯ শনাক্ত হওয়ার পর একটা সময় মানুষজন হাসপাতালে যায়নি। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষজন হাসপাতালে যাচ্ছে। আর এ কারণে হয়তোবা এই সময়ে এসে দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে এর মানে এই নয় যে, অন্য সময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ কম ছিল। ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলে বছরব্যাপী কাজ করে যেতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের স্বাস্থ্য তথ্য ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সহকারী পরিচালক ডা. মো. কামরুল কিবরিয়ার সই করা বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ৩০ নভেম্বর থেকে থেকে গত মঙ্গলবার (১ ডিসেম্বর) ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২০ জন। অথচ এক মাস আগেও ২৪ ঘন্টায় ডেঙ্গু রোগী ভর্তির সংখ্যা ছিল অনেক কম।

ডেঙ্গু কার্যত মশাবহিত রোগ। ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। কয়েক বছর এ রোগের মৃত্যের সংখ্যা খুব কমই ছিল। তবে ২০১৯ সালের জুন মাসেই ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ে। ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়তে থাকে জুলাই মাসে। আগস্ট মাসে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। পরে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমতে শুরু করে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসেও দেশে ১৯৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসে। ওই মাসে ৪৫ জন আক্রান্ত রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। পরবর্তী সময়ে মার্চে ২৭ জন, এপ্রিলে ২৫ জন, মে মাসে ১০ জন, জুনে ২০ জন, জুলাইয়ে ২৩ জন, আগস্টে ৬৮ জন এবং সেপ্টেম্বরে ৪৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। অক্টোবর মাসে ১৬৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। কিন্তু নভেম্বরে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এই মাসে সর্বমোট ৫৪৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, জেলা শহরগুলোর মধ্যে চলতি বছর যশোরে সর্বোচ্চ ৩৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। বর্তমানে সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৯৪ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর মধ্যে রাজধানীতেই চিকিৎসাধীন ৮২ জন। রাজধানীতে এখন পর্যন্ত এক হাজার ৫২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

এছাড়াও রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন জায়গায় ১৪১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। এর মধ্যে ঢাকা ছাড়া এই বিভাগের অন্যান্য জেলায় ৪২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। খুলনা বিভাগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এছাড়াও ময়মনসিংহ বিভাগে ১৮ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১১ জন, বরিশাল বিভাগে তিনজন, সিলেট ও রাজশাহী বিভাগে একজন করে রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। রংপুর বিভাগে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ডেঙ্গু প্রতিরোধে নাগরিক সচেতনতা বাড়াতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। সিটি কর্পোরেশনকে কয়েক ভাবে বিভক্ত করে বাড়ি বাড়ি ঘুরে এডিস মশা নিধন করেছে। যে সব বাড়িতে এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে সে সব বাড়ির মালিকের জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও নাগরিক সচেতনতা বাড়েনি। ফলে এসিড মশা বিভিন এলাকায় বংশ বিস্তার করছে। এতে করে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ডেঙ্গু আক্রান্ত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ