Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

পঞ্চাশ বছরের অর্জন এবং আগামীর প্রত্যাশা

আবুল কাসেম হায়দার | প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০৬ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
দেশের উত্তরাঞ্চলে ফারাক্কা ও তিস্তা বাঁধের জন্য নদী নেই। পাল তোলা নৌকা আর দেখা যায় না। মাঝির সেই গান আর শোনা যায় না। আব্বাস উদ্দিনের গান আর গ্রামে গ্রামে শোনা বেশ কঠিন। মাঠে মাঠে গরু ছাগলও চরে না আর। এখন গরুর গোশত, ছাগলের মাংস দোকানে দোকানে সাজানো থাকে। মাছ, মাংসের খামার গ্রামে হয়েছে। এখন বাংলাদেশ ধনে-ধান্যে পূর্ণ। এখন সোনার বাংলা সোনায় ভরপুর। এখন শহর-গ্রাম সর্বত্র জিডিপি, উন্নয়ন, মেগা প্রকল্প প্রভৃতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা। পৃথিবীর কে কত ধনী। আমরা ধনীদের তালিকা কত নম্বরে। আমাদের দেশের কোন ধনী, কোন অবস্থায় প্রভৃতি এখন চায়ের দোকানে আলোচনার বিষয়বস্তু। ক্রিকেট খেলা ছাড়া শিল্প সাহিত্য, অন্যান্য খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা, লোকগীতি ইত্যাদি যেন পিছনে পড়েছে। এখন শহর-গ্রামের মানুষদের ভোগবাদিতা পেয়ে বসেছে। এখন টাকাই সব। টাকা উড়ছে সর্বত্র। অফিসের কেরানী, ড্রাইভার প্রভৃতির ব্যাংক হিসাবে পাওয়া যায় কোটি কোটি টাকা। ভালো-মন্দ মিলিয়ে আমাদের সোনার বাংলা এগিয়ে।

আমাদের প্রয়োজন: স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরকে সামনে রেখে এবারে বিজয় দিবস আমাদের নিকট অতি গুরুত্বপূর্ণ। এখনো অনেক কিছু করার আছে আমাদের। আমাদের পদ্মা সেতু হচ্ছে, মেট্রোরেল হচ্ছে, চট্টগ্রামে কর্ণফুলীতে ট্যানেল হচ্ছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লাইনের হাইওয়ে হয়েছে, আণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ স্থাপিত হয়েছে, আইটিতে আমরা বিশ^কে অবাক করে দিয়েছি। তারপরও কিছু অভাব আমাদের যন্ত্রণা দিচ্ছে। কী যেন আমাদের নেই। আমাদের অনেকের মনে যেন শান্তি নেই। আরও বেশ কিছু আমাদের প্রয়োজন। আমাদের জীবনকে আরও সুন্দর করার জন্য, আমাদের দেশকে আরও উন্নত করার জন্য কিছু বিষয় গুরুত্ব দিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তাতে সহজে, অল্প সময়ে, আমরা মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশে পৌঁছতে পারবো।

১. করোনা থেকে মুক্তি: আমাদের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানুষকে করোনা থেকে কীভাবে মুক্ত করতে পারি। এখনও আমাদের দেশে হাজার হাজার মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছে। ভ্যাকসিন এখনও আসেনি। শীঘ্রই ভ্যাকসিন আমরা পাবো আশা করি। সরকার অগ্রিম বুকিং দিয়েছে। দেশের সকল মানুষকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এই ক্ষেত্রে দুর্নীতি, অনিয়ম থেকে সকলকে দূরে থাকতে হবে। সরকারকে শক্ত হাতে বিষয়টি মোকাবেলা করতে হবে। দক্ষতা, সততা ও সঠিক ব্যবস্থাপনা এ ক্ষেত্রে আমাদের এই মহাসঙ্কট থেকে রক্ষা করতে পারে। আমাদের অর্থনীতি, উন্নতি, শিল্প-বাণিজ্য সকল কিছু করোনা মোকাবেলার উপর নির্ভর করছে। অর্থনীতি এখন কঠিন সময় অতিক্রম করছে। করোনা ব্যবস্থাপনার উপর সকল কিছু নির্ভর করছে।

২. সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের দক্ষতা: আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, আইন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, পুলিশ বিভাগ, সেনাবাহিনীসহ সকল বিভাগকে আরও বেশি শক্তিশালী, কার্যকর, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষতার মাধ্যমে কাজ করার শপথ নিতে হবে। এ সকল প্রতিষ্ঠান দেশের কোনো দলের বা ব্যক্তির নয়। প্রতিষ্ঠানগুলো যত বেশি শক্তিশালী, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও গতিশীল হবে, দেশ তত বেশি উন্নত হবে।

৩. নির্বাচন ব্যবস্থা: মানুষকে নির্বাচনমুখী করতে হবে। এখন মানুষ নির্বাচনের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। সকল মানুষকে তার ন্যায্য ভোটের অধিকার আরও বেশি নিশ্চিত করার জন্য সকল রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে আসতে হবে। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে মানুষের বাক স্বাধীনতা ও ভোটের অধিকার দিতে হবে।

৪. ব্যাংক ও আর্থিক খাতের উন্নয়ন: বিগত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকিং খাতে একটা টাল-মাটাল অবস্থা চলছে। পুঁজিবাজারসহ সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমাদের দুর্বল হয়ে পড়েছে। আজ সবচেয়ে যেটি প্রয়োজন তাহলো ব্যাংকিং খাতে আইনের শাসন নিশ্চিত করা। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে উধাও। অনেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে পড়ছে। পুঁজিবাজার এখনও আমাদের আস্থার মধ্যে আসেনি। শিল্প বিপ্লবের পূর্ব শর্ত হচ্ছে, শক্তিশালী, স্বচ্ছ আর্থিক খাত। এই বিষয়টিকে সরকার বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে কার্যকর উদ্যোগ আরও বেশি প্রয়োজন। মুদ্রা পাচার রোধ করার জন্য দেশে বেশি বেশি বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, সুযোগ দিতে হবে। দেশে লাভজনকভাবে বিনিয়োগ করতে পারলে বিদেশে টাকার পাচার বন্ধ হয়ে যাবে। টাকার অর্থাৎ পুঁজি রক্ষার নিশ্চয়তা পেলে মানুষ দেশে অধিক বিনিয়োগ করবে। তাতে কর্মসংস্থান বাড়বে, বেকারত্ব কমে আসবে। নতুন করে ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান না দিয়ে যে সকল প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোর মধ্যে সুশাসন ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
৫. শিক্ষা ও কৃষি: স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমাদের অর্জন শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষি ও প্রবাসে জনশক্তি রফতানি, তৈরি পোশাক শিল্পের উপর ভর করে আছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি অনেক। তবে আরও কিছু দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। শ্রীলঙ্কায় তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিক হতে হলে ইংরেজি মাধ্যমে এ লেভেল, ও লেভেল ছাত্রছাত্রী হতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষা ক্ষেত্রে এই উপমহাদেশে শ্রীলঙ্কা অনেক অগ্রসর। আমাদের দেশে এখনও অনেক গ্রাম রয়েছে, যেখানে একটি প্রাইমারি স্কুল নেই। সরকারকে এই সকল গ্রাম চিহ্নিত করে দ্রুত প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত আমাদের দেশ থেকে প্রচুর অদক্ষ শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশে চাকরিতে যাচ্ছে। অদক্ষ হওয়ার কারণে উপার্জনও কম, পরিশ্রম বেশি। রেমিটেন্সও তাদের মাধ্যমে কম আসে। তাই দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য করোনা পরবর্তী দক্ষ শ্রমিক যাতে আমরা বিদেশে পাঠাতে পারি তার জন্য প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে একটি করে হলেও ভোকেশনাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউট স্থাপন জরুরি। উক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রছাত্রীগণ ছয় মাস, এক বছর বা অধিক সময়ের কোর্স করে বিদেশে ও দেশে কর্মসংস্থান করতে পারবে। অন্যদিকে সরকারের উচিত হবে যে সকল স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাকে পাঠদানের অনুমতি দিয়েছে তাদের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করে নেয়া। এই সকল প্রতিষ্ঠান শিক্ষা ক্ষেত্রে তখন বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে।

বর্তমান কৃষি আমাদের জাতীয় আয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। সরকারের নানা উদ্যোগের ফলে খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। তারপরও কিছু কিছু খাদ্য পণ্য আমাদের আমদানি করতে হয়। নিত্য প্রয়োজনীয় এই সকল পণ্য দেশে উৎপাদনের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করে কার্যকর করা প্রয়োজন। বিশেষ করে পেঁয়াজ, মরিচ, হলুদ, রসুন ও নানা মসলা আমরা আমাদের দেশে উৎপাদন করে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে পারি। এই জন্য প্রয়োজন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের বিশেষ উদ্যোগ। আমাদের দেশের কৃষক বুদ্ধিমান-পরিশ্রমী। এক সময় কোরবানির সময় ভারত থেকে গরু আমদানি না করলে আমাদের কোরবানির পশুর সমস্যা হতো। এখন দেশে প্রচুর গবাদি পশু পালনের ফলে এই সমস্যা দূর হয়েছে। তেমনিভাবে প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। মৎস্য উৎপাদনে আমরা এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। নানা পদের মাছ আমাদের দেশে উৎপন্ন হচ্ছে। আমরা বিদেশে রফতানি করছি। করোনা পরবর্তী অর্থাৎ করোনার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউয়ের পর কৃষিপণ্যের চাহিদা পূরণে আমাদের এখন থেকে যত্নবান হতে হবে। (সমাপ্ত)
লেখক: গবেষক, শিক্ষানুরাগী, সম্পাদক ও শিল্প উদ্যোক্তা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আগামীর-প্রত্যাশা
আরও পড়ুন