Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

২ বছরে চট্টগ্রামে ১৫ হাতির মৃত্যু

জাকের উল্লাহ চকোরী, কক্সবাজার থেকে | প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০৫ এএম

২ বছরে চট্টগ্রামে ১৫ হাতির মৃত্যু হয়েছে। কারা হাতিগুলোকে গুলি করে হত্যা করছে তা জানা নেই কারোই। গত ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া এলাকার চাকফিরানির গ্রামের একটি বিলে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এক হাতি মারা গেছে। একই স্থানে এক বছর আগে গুলি লেগে মৃত্যু হয়েছিল আরেক হাতির। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন বনাঞ্চলে গত দুই বছরে এমন গুলিবিদ্ধ মৃত হাতি পাওয়া গেছে এক ডজনেরও বেশি। হাতি হত্যার সঙ্গে যুক্ত অপরাধীদের খুঁজে বের করতে আন্তরিক নয় বন বিভাগ। হাতিকে গুলি করার অপরাধে এ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি গ্রেফতারও হয়নি।
জানা যায়, গত পাঁচ দশকে দেশে হাতির সংখ্যা ৪৫০ থেকে কমে নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। অথচ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) বলছে, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় হাতি মহাগুরুত্বপূর্ণ এক প্রাণি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক ড. এ এইচ এম রায়হান সরকার বলেন, এই অঞ্চলের হাতিগুলোর দীর্ঘদিনের অভ্যাস হচ্ছে তারা ঘুরেফিরে বসবাস করে। একটি হাতি একবার হাঁটা শুরু করলে ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার হাঁটতে পারে। এটা তাদের অভ্যাস। মিয়ানমার কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার পাশাপাশি সীমান্তে মাইন পুঁতে রাখায় বেশ কিছু হাতির মৃত্যু হয়েছে। এখন নতুন দুই বিপদ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। প্রথমত, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘিরে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প হাতির জীবনচক্র এলোমেলো করে দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, একের পর এক হাতি হত্যা করা হচ্ছে গুলি করে।
এ ব্যাপারে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহাম্মদ ইয়াসিন নেওয়াজ জানান, রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের আট হাজার একর বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তে মাইন পুঁতে হাতি হত্যা করছে। বাংলাদেশেও গুলিবিদ্ধ হয়ে কয়েকটি হাতি মারা গেছে। এসব হাতিকে কারা, কেন গুলি করেছে, তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি। গুলিবিদ্ধ হাতির মৃত্যুর ঘটনায় কোথাও কেউ গ্রেফতার হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি খবর নিয়ে জানাতে হবে।
২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ইয়াংছা এলাকার একটি মৎস্য প্রকল্পের পানির মধ্যে থেকে হাতির একটি লাশ উদ্ধার করা হয়। এটি মাইন বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হয়েছিল। এর ১১ দিন পর ১৬ নভেম্বর উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের কুমারী এলাকার দুর্গম পাহাড়ি চাককাটার ঝিরিতে গুরুতর আহত আরেকটি হাতির লাশ পাওয়া যায়। ৩০ নভেম্বর উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের কুমারী এলাকার দুর্গম পাহাড়ের ইসকাটার ঝিরির হরিরঞ্জনের রাবার বাগানের পাশে আরও একটি হাতির লাশ পাওয়া যায়।
এর আগে লামা উপজেলার রহমত উল্যাহর রাবার বাগান থেকে একটি, গজালিয়া ইউনিয়নের হাইমারা ঝিরি থেকে একটি, ইয়াংছা এলাকার সেলিমুল হক চৌধুরীর বাগান থেকে একটি হাতির লাশ উদ্ধার করা হয়। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি রেঞ্জের আশাতলী বিজিবি ক্যাম্প এলাকার পাশে দুই দেশের নোম্যানস ল্যান্ড বা সীমান্ত শূন্যরেখায় মাইন বিস্ফোরণে এসব হাতি আহত হয় বলে ধারণা করা হয়। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের চাকঢালা, আষাঢ়তলী সীমান্তের ৪৮ নম্বর পিলারের কাছে নোম্যান্স ল্যান্ডে মিয়ানমারের পুঁতে রাখা স্থলমাইন বিস্ফোরণে আরেকটি হাতির মৃত্যু হয় মাস কয়েক আগে।
বাংলাদেশে একের পর এক হাতি মারা যাচ্ছে গুলিবিদ্ধ অবস্থায়। চলতি বছরের ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া এলাকার চাকফিরানির গ্রামের একটি বিলে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একটি হাতি মারা গেছে। স্থানীয় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুনাইদ জানান, কুমিরাঘোনা এলাকার চাকফিরানী দক্ষিণের ঘোনা বোইন্না বিলে ধানক্ষেতের পাশে বন্য হাতিটির লাশ পড়েছিল। খবর পেয়ে তারা বন বিভাগকে জানান। এই হাতির গায়ে গুলির চিহ্ন ছিল। গুলি করা স্থানে পচনও ধরেছিল। তবে এই ঘটনাতেও থানায় কোনো মামলা হয়নি।
লোহাগাড়া থানার ওসি জাকের হোসেন বলেন, বন্যহাতির মৃত্যুর ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন এক বন কর্মকর্তা। তবে কোনো মামলা হয়নি। হাতিটি কেন মারা গেছে তা আমাদের জানা নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একই স্থানে গুলিবিদ্ধ আরেকটি হাতি মারা গেছে বছরখানেক আগে। ওই ঘটনাতেও থানায় কোনো মামলা হয়নি। কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তেও গত দুই বছরে অন্তত চারটি হাতি মারা গেছে গুলি লেগে। এসব ঘটনাতেও গ্রেফতার হয়নি কেউ। রাঙামাটি ও বান্দরবান সীমান্তেও পাওয়া গেছে গুলিবিদ্ধ একাধিক হাতি। কারা এসব হাতিকে গুলি করেছে, তা জানা যায়নি।
গত ১৩ জুন চকরিয়া-লামা সীমান্তের লামার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি খালখুইল্যাখোলার একটি পাহাড়ি ঝিরিতে বন্যহাতির লাশ পড়ে থাকার খোঁজ পায় বন বিভাগ। হাতিটিকে গুলি করার পর আবার বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদে ফেলা হয়। হাতিটির শরীরজুড়ে ছিল বৈদ্যুতিক শকের দাগ। এছাড়া কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন চকরিয়ার ফুলছড়ি রেঞ্জের চারটি স্থানে চারটি হাতি, কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের ঈদগড়ের ভোমরিয়াঘোনায় একটি, উখিয়ায় একটি, টেকনাফের হ্নীলায় একটি, হোয়াইক্যংয়ে একটি, বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের কুমারী ফাঁসিয়াখালীতে তিনটিসহ মোট ১৫টি হাতিকে খুন করা হয়।
গত ১২ জুন টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের পশ্চিম পানখালীর খন্ডাকাটা এলাকায় ৩৫ বছর বয়সী একটি হাতিকে হত্যা করা হয়। এটির ওজন আনুমানিক সাতশ’ কেজি। এটির মাথার দিকে গুলির চিহ্ন ছিল। আবার শুঁড়ের ভেন্টাল রিজিয়নে কালো দাগ ছিল। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে গুলির পর বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে হাতিটি হত্যা করা হয় বলে উল্লেখ করা আছে। ১২ জুন বাঁশখালীর বৈলছড়ি ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকা অইব্যারখিলে একটি বন্যহাতির লাশ উদ্ধার করা হয়। এটিকেও হত্যা করা হয় গুলি করে।
পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী বলেন, প্রকৃতির বন্ধু হাতির ওপর যারা এমন বর্বর আচরণ করছেন, তারা সুস্থ প্রকৃতির মানুষ নন। বন বিভাগের উচিত, তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হাতি

১২ আগস্ট, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ