Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

দেশ ও জাতির কল্যাণে কওমী মাদরাসা ও উলামায়ে কেরামের অবধান অনস্বীকার্য- আমীরে হেফাজত আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী

অনুষ্ঠিত হলো দারুল উলূম হাটহাজারীর বার্ষিক মাহফিল ও দস্তারবন্দী সম্মেলন

হাটহাজারী সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২১, ৪:৪৩ পিএম

পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আলজামিআতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী চট্টগ্রাম এর বার্ষিক মাহফিল ও দস্তারবন্দী সম্মেলন আজ জুমাবার (পহেলা জানুয়ারি) জামিআর সুবিশাল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়।

জামিআর মজলিসে ইদারী‘র প্রধান মুফতী আজম আল্লামা আব্দুচ্ছালাম চাটগামী দা.বা. এর উদ্বোধনী বক্তব্যের মাধ্যমে মাহফিলের আনুষ্ঠিানিক কার্যক্রম আরম্ভ হয়।যথা নিয়মে অন্যান্য উলামায়ে কেরাম নির্ধারিত বিষয়ে তাকরীর পেশ করেন। চলমান বিভিন্ন ইস্যূতে মুসলিম উম্মাহকে দ্বীনি দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয়। একই দিন বা’দ ইশা দস্তারবন্দী সম্মেলনে গত বছরের দাওরায়ে হাদীস উত্তীর্ণ দুই সহস্রাধিক শিক্ষার্থীদের পাগড়ী সনদ প্রদান করা হয়।

বিশ্বখ্যাত দারুল উলূম হাটহাজারীর বার্ষিক মাহফিলের মূল অনুষ্ঠান বাদ ফজর থেকে আরম্ভ হয়ে ইশা পর্যন্ত চলমান থাকে। বাদ এশা গত বছর দাওরায়ে হাদীস উত্তীর্ণ ছাত্রদের সম্মাননা পাগড়ী প্রদানের মাধ্যমে মাহফিলের শুভসমাপ্ত হয়।

প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্ঠা আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী।

সভায় প্রধান আলোচক হিসেবে দেশ ও জাতির উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ নসীহত পেশ করেন জামিআর শায়খুল হাদীস ও আমীরে হেফাযতে ইসলাম বাংলাদেশ আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন-

মানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্ববাসীর জন্য রাহমাতুল লিল আলামিন বা শান্তির বার্তাবাহক হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন। নবুওয়াত প্রাপ্তির পর ইলমে ওহীর মাধ্যমে আইয়্যামে জাহিলিয়্যাত বা বর্বরতার যুগের নিকৃষ্ট মানুষগুলোকে সোনার মানুষে পরিণত করেছিলেন। তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন আত্মাগুলোকে নির্মল ও পরিশুদ্ধ করেছিলেন।

বর্বরতার যুগের সেই মানুষগুলোকে সরল সঠিক পথ সীরাতে মুস্তাকিমের উপর ফিরিয়ে আমার জন্য মক্কায় দারে আরকম এবং মদীনায় সুফফার মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বর্তমান প্রচলিত কওমী মাদরাসা সমূহ সেই দারে আরকম আর সুফফা মাদরাসার শাখা। কওমী মাদরাসা সমূহ মুসলিম উম্মাহর ঈমান আকিদা সংরক্ষণের মজবুত দূর্গ। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কওমী মাদরাসা দেশ ও জাতীর বিশাল খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। মুসলিম উম্মাহর ঈমান-আক্বিদা রক্ষা ও দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের সংরক্ষণে কওমী মাদরাসা ও ওলামায়ে হক্কানির অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে,থাকবে।

সূরা জুমুআ'র ২ নং আয়াত উল্লেখ করে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, পবিত্র কোরআনে নবী-রাসুলদের (আ.) মৌলিক চারটি কাজের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এ প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন, “তোমাদের মধ্যে একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদেরকে তাঁর আয়াতগুলো পড়ে শোনান, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন। অথচ এর আগে তারা সুস্পষ্ট গোমরাহিতে নিমজ্জিত ছিল।”

নবীগণের এ কাজ চলমান থাকবে। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ স. এর অবর্তমানে এ কাজ সম্পাদন করবেন হক্কানী উলামায়ে কেরাম।

আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী। নতুন কেহ নবুওয়াতের বা নবী হওয়ার দাবী করলে সে হবে ভন্ড, প্রতারক। বর্তমান সময়ে কাদিয়ানীরা মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে তাদের নবী বলে দাবী করে। তাকে তারা নবী। মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী কখনো নবী হতে পারে না। সে ছিলো ইংরেজদের দালাল। তাকে যারা নবী মানবে তারা নিঃসন্দেহে কাফের। কাদিয়ানীরা সন্দেহ ছাড়া কাফের। ৯০% মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে মুসলিম পরিচয়ে কাদিয়ানীরা থাকতে পারে না। কাদিয়ানীদেরকে রাষ্ট্রিয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে।

উলামায়ে কেরাম নবী-রাসুলের উত্তরসূরি হিসেবে দীপ্ত কণ্ঠে জাতির সামনে হক কথা বলবেন। হক ও ন্যায়ের কথা বলতে ওলামায়ে কেরাম কারো রক্তচক্ষুকে ভয় করেন না।

কওমী মাদরাসা ইতিহাস ঐতিহ্য ও অবদান তুলে ধরতে গিয়ে আল্লামা বাবুনগরী বলেন, সর্বপ্রথম মাদরাসা হলো মক্কার দারে আরকম আর মদীনার সুফফা মাদরাসা। সেই মাদরাসাদ্বয়ের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর ছাত্র ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। নবী-রাসুলদের (আ.) মৌলিক চারটি কাজের সংরক্ষণের জন্য দারে আরকম ও সুফফা মাদরাসার নমুনায় বহু মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তন্মধ্যে সুলতান মাহমুদ গজনভী রহ. এর মাদরাসা,নেজামুল মুলুক তুসির মাদরাসা,সুলতান সেকান্দর আওদুহির মাদরাসা,ভারতের গুজরাটের বাদশা মুহাম্মদ আদেল শাহের মাদরাসা এবং বাংলা বিজয়ী মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি সপ্তম হিজরীতে বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ বিভাগ রংপুরে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাদশা আলমগীর বড় বড় শহরে এমনকি গ্রামেও বহু মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তন্মধ্যে লৌখনোর ফারাঙ্গি মহল্লির দারুল উলুম মাদরাসা নেজামিয়া বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

সুফফা মাদরাসা এবং দারুল উলুম দেওবন্দের শাখা দারুল হাটহাজারী ১৯০১ সনে প্রতিষ্ঠালাভ করে। শায়খুল ইসলাম আল্লামা হাবীবুল্লাহ রহ. আল্লামা আব্দুল ওয়াহেদ রহ. আল্লামা সূফী আজিজুর রহমান রহ. আল্লামা আব্দুল হামীদ রহ. এই চারজন মনিষী এখলাছ ও নিষ্ঠার সাথে হাটহাজারী মাদরাসার ভিত্তি রাখেন। গংগুহি রহ. এর খলিফা আল্লামা শাহ জমির উদ্দিন রহ. ছিলেন অত্র মাদরাসার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসা দেশ ও বহির্বিশ্বে দ্বীনের বহুমুখী খেদমত আঞ্জাম দিয়েছে।

১৯০৭/৮ সনে হাটহাজারী মাদরাসায় দাওরায়ে হাদীস মাস্টার্স খোলার মাধ্যমে হাদীস শাস্ত্রে অসামান্য অবদান রাখা হয়। হাটহাজারী মাদরাসার প্রথম শায়খুল হাদীস ছিলেন,আল্লামা সাঈদ আহমদ রহ.,দ্বিতীয় শায়খুল হাদীস ছিলেন আল্লামা ইব্রাহিম বলিয়াবী রহ. (তিনি দারুল উলুম দেওবন্দেরও শায়খুল হাদীস ছিলেন)। আল্লামা ইয়াকুব রহ. আল্লামা আব্দুল কাইয়ুম রহ., মুফতীয়ে আজম আল্লামা ফয়জুল্লাহ রহ.আল্লামা আব্দুল ওয়াহহাব রহ. আল্লামা আব্দুল আজিজ রহ.,মেশকাত শরীফের বিশ্ববিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ তানজিমুল আশতাতের রচয়িতা আমার আব্বা আল্লামা আবুল হাসান রহ. হাদীসের বিশাল খেদমত করেছেন। তানজিমুল আশতাত বাংলাদেশ, ভারত,লন্ডন, ইংল্যান্ড, আফ্রিকা সহ বহির্বিশ্বে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। এ ব্যাখ্যাগ্রন্থ বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের সম্মান বৃদ্ধি করেছে। এছাড়াও আল্লামা মুফতী আহমাদুল হক রহ.,আল্লামা হামেদ সাহেব রহ,আল্লামা মুহাম্মদ আলী রহ. এবং সর্বশেষ অত্র মাদরাসার মোহতামীম ও শায়খুল হাদীস শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ. সহ বহু মুহাদ্দিস হাটহাজারী মাদরাসায় তাফসীর হাদীস,ফেকাহ সহ বহুমুখী খেদমত করেছেন।

আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলো মানুষ। আর মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো আলেম সম্প্রদায়। হক্কানি ওলামায়ে কেরামের শান ও মর্যাদা অনেক বেশি। পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ তায়া’লা বলেন, “আল্লাহকে তো কেবল তারাই ভয় করে, যারা জ্ঞানের অধিকারী” (সূরা ফাতির-28)

নায়েবে নবী ওলামায়ে কেরামের সাথে এদেশের জনসাধারণের আত্মার সম্পর্ক রয়েছে। এদেশের মানুষ ইসলাম প্রিয়,আলেম প্রিয়। গাছের নতুন ফল, গাভীর প্রথম দুধ তারা বরকতের জন্য ওলামায়ে কেরামের খেদমতে উপস্থিত করেন। ওলামায়ে কেরাম ও আমজনতার মধ্যকার এই সম্পর্ক নাস্তিক মুরতাদ আর রামবামরা সহ্য করতে পারে না। তাই তারা গুটিকয়েক মানুষকে ওলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে কটুক্তি ও বিষোদগারের জন্য লাগিয়ে দিয়েছে। যা বড়ই দুঃজনক।

 

সম্প্রতি করোনাকালীন সময়ে যখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা লাশ দাফনের জন্য কেহ এগিয়ে আসতো না,লাশ ফেলে রেখে স্বজনরা পালিয়ে যেতো তখন ওলামায়ে কেরাম করোনায় মৃতদের লাশ দাফন কাফনের মতো বিশাল সেবামূলক কাজ করেছেন। ওলামায়ে কেরাম না থাকলে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতদের লাশ কুকুর শেয়ালে ছিড়ে ফেরে খেতো। আল্লামা শাহ জমির উদ্দিন রহ. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউণ্ডেশন,আল মারকাজুল ইসলামি এবং তাকওয়া ফাউণ্ডেশন করোনাকালীন সময়ে সেবামূলক বহু কাজ করেছেন। সুতরাং ওলামায়ে কেরামকে নিয়ে বিষোদগার করলে এদেশের তৌহিদি জনতা বরদাশত করবে না।

এ ছাড়াও দেশবরেণ্য উলামায়ে কেরাম উক্ত সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পেশ করেন।

বার্ষিক এ মহতি সম্মেলনের সঞ্চালনায় ছিলেন জামিআর সিনিয়র মুহাদ্দিস ও সহযোগী পরিচালক আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, সিনিয়র মুহাদ্দিস মুফতী জসিমুদ্দীন, সহকারী শিক্ষাসচিব মাওলানা আনাস মাদানী ও মাওলানা নুরূল ইসলাম জাদীদ সাহেব।

দূর-দূরান্ত থেকে আগত ধর্মপ্রাণ মুসল্লীদের পদচারণায় কাল থেকে জামিআ প্রাঙ্গন ছিলো মুখরিত ও ধর্মীয় গাম্ভীর্যতায় পরিপূর্ণ। জুমার নামায আদায়ে তওহীদপ্রিয় জনতার ঢল পরিলক্ষিত হয়।

মাহফিলের শেষ অধিবেশন ছিলো সমাবর্তন তথা দাওরা হাদীস (মাস্টার্স) উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদেরকে সম্মাননা পাগড়ী প্রদান। শিক্ষার্থীরা আবেগঘন পরিবেশে পাগড়ী গ্রহণ করে। এ সময় মঞ্চে সিনিয়র শিক্ষক প্রায় সকলেই উপস্থিত ছিলেন। পাগড়ী প্রদান শেষে মজলিসে ইদারী’র প্রধান মুফতী আজম আল্লামা আব্দুচ্ছালাম চাটগামী দা.বা., মূল্যবান নসীহত করে মুনাজাতের মাধ্যমে মাহফিল সমাপ্তি করেন।

মাহফিলে অন্যান্যদের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন, হযরত মাওলানা আল্লামা শেখ আহমদ সাহেব দা.বা., মাওলানা ইয়াহইয়া দা.বা. মাওলানা সালাহ উদ্দীন দা.বা., মাওলানা নূরুল ইসলাম দা.বা., হযরত মাওলানা নোমান ফয়জী দা.বা., মুফতী জসীম উদ্দীন দা.বা., মুফতী কিফায়াতুল্লাহ দা.বা., মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী দা.বা., ড.আফম খালিদ হোসেন দা.বা., মাওলানা সাজেদুর রহমান দা.বা., মাওলানা মামুনুল হক দা.বা., মাওলানা জুনায়েদ আল-হাবীব দা.বা., মুফতী আব্দুল হালিম বোখারী দা.বা., মাওলানা লোকমান দা.বা., মাওলানা খোবাইব দা.বা., মুফতী হাবীবুর রহমান, মাওলানা মাহমুদুল হাসান দা.বা., মাওলানা আব্দুল বাসেত খান সিরাজী দা.বা., মাওলানা সাআদাত দা.বা., মাওলানা নূরুল আবছার দা.বা. মাওলানা আজীজুল হক আল-মাদানী দা.বা. , মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আয়ূবী দা.বা.প্রমূখ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ