Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

হুন্ডিতে টাকা পাচারে জড়িতরা নিরাপদে

বিশ্বের ১৫টি দেশে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারে জড়িত ১৫০ জনের তালিকা

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ৪ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

নানা কৌশলে বিশ্বের ১৫টি দেশে হুন্ডির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারে জড়িতরা নিরাপদেই রয়েছে। হুন্ডি চক্রের ১৫০ জন দেশে ও বিদেশে সক্রিয় থাকলেও এদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ-বিদেশি বিনিয়োগ উন্মুক্ত করে দেয়ায় পাচারকারীরা টাকা পাচারে ওইসব দেশকে বেছে নিচ্ছে। সেখানে আবাসিক ভবন, জমি কেনা, হোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসায় এসব টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এমনকি পাচারের টাকা যাচ্ছে বিদেশের নামি-দামি ক্যাসিনোতেও। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, রাজনীতিবিদ, বিভিন্ন সংস্থাসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছেন পাচারকারীর তালিকায়। হুন্ডি কারবারি হিসেবে চিহ্নিত এমন প্রায় ১৫০ জনের একটি তালিকা ধরে তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। শুধু তাই নয়, মায়ানমার ও ভারত থেকে যে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক আসছে এ ক্ষেত্রে টাকা লেনদেনের একটি বড় অংশ দেয়া হয় হুন্ডির মাধ্যমে। একটি সংস্থার সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, হুন্ডির মাধ্যমে ক্যাসিনো ব্যবসার হোতাদের বিদেশে অর্থ পাচারসহ সারা দেশের সকল হুন্ডি ব্যবসায়ীদের খোঁজে গোয়েন্দা মাঠে নেমেছে। দেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা হুন্ডি ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টদের খুঁজছে। তারপরও প্রকাশ্যেই হুন্ডি ব্যবসায়ীরা অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে আসছে। এক অদৃশ্য শক্তির জোরের কারণে এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়েছে।
র‌্যাবের মিডিয়া উইং প্রধান লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, হুন্ডি ব্যবসায় জড়িতরা ফৌজদারি অপরাধের সাথে জড়িত। এদের গ্রেফতার, শনাক্তকরণ এবং নেটওয়ার্ক নিয়ে র‌্যাব কাজ করছে। বিভিন্ন সময় হুন্ডি ব্যবসায় জড়িতদের গ্রেফতারও করেছে র‌্যাব।
তিনি আরো বলেন, হুন্ডি ব্যবসায় জড়িতরা বড় ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত থাকলেও এ ক্ষেত্রে দু’পক্ষ (যারা টাকা দেন এবং যারা টাকা পাঠান) সমঝোতার মাধ্যমে হয়ে থাকে। এ জন্য এ ধরনের অপরাধের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা কঠিন। র‌্যাব সারাদেশেই হুন্ডি ব্যবসায়ীদের নিয়ে কাজ করছে বলে লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ মন্তব্য করেন।
সম্প্রতি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো একটি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা অর্থে তিন হাজারের অধিক বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছেন। এছাড়া বিদেশ থেকে হুন্ডি হয়ে আসছে রেমিট্যান্সের বিপুল পরিমাণ অর্থ। একইভাবে রফতানি বাণিজ্যের আড়ালে প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এই অর্থ বৈধপথে রেমিট্যান্স হিসেবে এলে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেমন শক্তিশালী হতো। তেমনি এই অর্থকে বিনিয়োগে আনা সম্ভব হতো। হুন্ডি কিংবা মানি লন্ডারিং উভয়ই অপরাধ। হুন্ডি চক্র দেশে ও বিদেশে উভয় ক্ষেত্রেই সক্রিয়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, পণ্য আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে কারসাজি করে যে অর্থ পাচার হয়, সেই অর্থের অঙ্কটা উদ্বেগজনক। আর পাচার করা অর্থের বেশিরভাগই কানাডা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও দুবাই চলে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ-বিদেশি বিনিয়োগ উন্মুক্ত করে দেয়ায় পাচারকারীরা টাকা পাচারে ওইসব দেশকে বেছে নিচ্ছে। সেখানে আবাসিক ভবন, জমি কেনা, হোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসায় এসব টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এছাড়া যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মধ্যে ইংলিশ চ্যানেলের মতো ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতেও অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। পাচারের টাকা যাচ্ছে বিদেশের নামি-দামি ক্যাসিনোতেও। একশ্রেণির ব্যবসায়ী, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, আমদানিকারক ও মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারসহ ১৫০ ব্যবসায়ী হুন্ডি কারবারে জড়িত। এ কারণে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকেও সরকার বঞ্চিত।
অপরাধবিজ্ঞানীদের মতে, হুন্ডি টাকা পাচারের একটি ভয়ঙ্কর মাধ্যম। কেননা আমদানি বা রফতানির মাধ্যমে টাকা পাচার করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ডকুমেন্ট বা কাগজপত্র প্রদর্শন করতে হয়। এর ফলে অপরাধীর পরিচয় একসময় পাওয়া যায়। কিন্তু হুন্ডিতে মূলত এজেন্টের মাধ্যমে টাকা লেনদেন হয়। এটি পুরোপুরি চলে বিশ্বাসের ওপর। এখানে কোনো কাগজপত্রের লেনদেন হয় না। এ প্রক্রিয়ায় টাকা পাচার করা হলে পাচারকারীদের শনাক্ত করা খুবই কঠিন। এ ছাড়া হুন্ডির মাধ্যমে টাকা স্থানান্তরে খরচ কম। এ কারণেই পাচারকারীরা হুন্ডিকেই পছন্দ করে বেশি। শুধু বাংলাদেশ থেকে টাকা যায় না, টাকা আসেও হুন্ডির মাধ্যমে। বৈধপথে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা থাকায় প্রবাসী শ্রমিকরাও হুন্ডির আশ্রয় নিয়ে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক জরিপে দেখা যায়, প্রবাসীরা বিদেশ থেকে দেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠান তার ৪০ শতাংশ আসে ব্যাংকিং চ্যানেলে। ৩০ শতাংশ আসে সরাসরি প্রবাসী বা তাদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে নগদ আকারে এবং বাকি ৩০ শতাংশ আসে হুন্ডির মাধ্যমে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রতি মাসে উদ্ধার হওয়া ইয়াবার পরিসংখ্যান ব্যবহার করে পাশের দেশ ভারত ও মিয়ানমারে পাচার হওয়া টাকার অঙ্ক সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এতে দেখা গেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, র‌্যাব ও কোস্ট গার্ডের ধারাবাহিক অভিযানে প্রতি মাসে গড়ে ২৫ লাখ ইয়াবা উদ্ধার হয়। প্রতিটি ইয়াবা বড়ির দাম ৩০ টাকা করে হিসাব করলে মাসে সাড়ে ৭ কোটি টাকা পাচার হওয়ার তথ্য মেলে। বছর শেষে পাচার হওয়া টাকার অঙ্ক দাঁড়ায় ১০৫ কোটি টাকা। কিন্তু প্রকৃত টাকার অঙ্ক হাজার কোটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) এক কর্মকর্তা বলেন, উদ্ধার হওয়া ইয়াবার সংখ্যা বিচারে বছরে প্রায় শতকোটি টাকার তথ্য হিসাব করলেও মূলত তার ১০ গুণের বেশি টাকা পাচার হচ্ছে। পাচার হওয়া এসব টাকার অধিকাংশই হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে চলে যাচ্ছে। এ তো গেল আর্থিক ক্ষতির হিসাব। প্রকৃতপক্ষে ইয়াবা যুবসমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, যেই ক্ষতি টাকার মূল্যের কাছে কিছুই নয়। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, গত দুই বছর আগে সিআইডির অর্গানাইজ ক্রাইম বিভাগ বিকাশের মাধ্যমে হুন্ডির ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৮টি এজেন্টের ৮ জনকে আটক করে। তারা হলো- রাজশাহীর গোদাগাড়ীর মান্নান (৩০), পাবনার আমিনপুরের মনোয়ার হোসেন মিন্টু (২৯), মোজাম্মেল মোল্লা (৩৩), ডাঙ্গুরার সঙ্গীত কুমার পাল (৪৫), সাথিয়ার জামিনুল হক (৩৮), বেড়ার হোসেন আলী, চট্টগ্রামের লোহাগড়ার দিদারুল হক (৩১) ও ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুরের আবু বকর সিদ্দিক। এদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।



 

Show all comments
  • নিয়ামুল ৪ জানুয়ারি, ২০২১, ৫:৪১ এএম says : 0
    এক অদৃশ্য শক্তির জোরের কারণে এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না
    Total Reply(0) Reply
  • জুয়েল ৪ জানুয়ারি, ২০২১, ৫:৪২ এএম says : 0
    এ কারণে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকেও সরকার বঞ্চিত।
    Total Reply(0) Reply
  • গিয়াস উদ্দীন ফোরকান ৪ জানুয়ারি, ২০২১, ৫:৪৩ এএম says : 0
    বৈধপথে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা থাকায় প্রবাসী শ্রমিকরাও হুন্ডির আশ্রয় নিয়ে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।
    Total Reply(0) Reply
  • মেহেদী ৪ জানুয়ারি, ২০২১, ৭:৫৬ এএম says : 0
    ওদের শিকড় অনেক গভীরে..............................................
    Total Reply(0) Reply
  • জাবের পিনটু ৪ জানুয়ারি, ২০২১, ৭:৫৭ এএম says : 0
    কারণ নিরাপদ ‍যারা রেখেছে তারাও তো একটা অংশ পেয়েছে।
    Total Reply(0) Reply
  • রাগিনী মেয়ে ৪ জানুয়ারি, ২০২১, ৭:৫৭ এএম says : 0
    এটাই আমার বাংলাদেশ!!!
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ আশরাফুল হক ৪ জানুয়ারি, ২০২১, ১১:৫২ পিএম says : 0
    টাকা পাঠানোর জন্য ব্যাংকে গেলে ব্যাংক চার্জ ও অন্যান্য খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী টাকা হুন্ডিতে পাঠায় , ব্যাংক থেকে হুন্ডিতে টাকা বেশি রেটে পায় , আরো কিছু সমস্যা আছে একজন প্রবাসী মাসে ৫০০০ হাজার টাকা পাঠাতে পারবেন কিন্তু সে পাঁচ হাজারের বেশি টাকা পাঠায় তাকে সমস্যা মুখোমুখি হতে হবে , এমন কি তাকে জেল জরিমানা করা শেষে দেশে পাঠিয়ে দিবে (টাকা সংখ্যা ছিল উদাহরণ )
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হুন্ডি

১০ নভেম্বর, ২০১৭

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ