বড়কে সম্মান ছোটকে স্নেহ

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র সীরাত থেকে যে ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষা আমরা পাই তা হচ্ছে,
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক সময় নিতান্ত আক্ষেপে গেয়েছিলেন ‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান?’ তাঁর কণ্ঠ নিঃসৃত বাণীর প্রতি গভীর দৃষ্টিতে তাকালে অতি সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, তিনি আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ ঈমানদার একজন মুসলমানকে মনে-প্রাণে খুঁজছিলেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় সে মুসলমানের সন্ধান লাভ করেছিলেন কি-না, তা’ আমাদের জানা নেই। তবে, পরিপূর্ণ ঈমানদার ব্যক্তি বা সত্তার পরিচয় লাভের পূর্বে ঈমান কী এবং কেমন, তার পরিচয় লাভ করা একান্ত জরুরি বিধায়, আসুন আমরা সর্বাগ্রে ঈমানের অর্থ, মর্ম ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে অবহিত হই।
‘ঈমান’ শব্দটি আরবি। এর অভিধান গত অর্থ হলো- নিরাপত্তা দান করা, আস্থা স্থাপন করা, কাউকে অভয় দান করা, কাউকে সত্যবাদী জ্ঞান করতঃ তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করা। আর ঈমানের পরিভাষাগত বা ব্যবহারিক অর্থ হলো- দ্বীন ইসলামের যে সকল বিষয় রাসূলুল্লাহ (সা.) হতে অকাট্যরূপে বর্ণিত ও প্রমাণিত, তা’ মন-প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতঃ মান্য করা।
দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে প্রজ্ঞা ও মনীষার অধিকারী বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন যে, ঈমান শব্দটি বাবে ইফআলের মাছদার বা শব্দমূল। এ থেকেই গঠিত হয়েছে আমানা, ইউমিনু, ঈমানান, ক্রিয়া পদগুলো। সকল অভিধান বিশারদদের মতে, ঈমান অর্থ সত্যায়ন করা, সত্য বলে মেনে নেয়া, সত্য বলে বিশ্বাস করা। (লিসানুল আরব : ১৩/২৭)।
এতদ প্রসঙ্গে ঈমান ইবনু তাইমিয়্যাহ বলেন-ঈমান অর্থ মুখাতিবের উক্তি তার দ্বীনদারী ও আমানতদারীর ভিত্তিতে শ্রোতা কর্তৃক সত্যায়ন করা, ও আন্তরিক বিশ্বাস করা। (ফায়জুল বারী শরহে বুখারী : ১/৪৬)। আর শরীয়াতের পরিভাষায় বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.) কর্তৃক আনীত বিষয়াবলী যা জরুরিভাবে ও স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণিত রূপে পরিজ্ঞাত এবং বিস্তারিত বিষয়াবলি বিস্তারিতভাবে আর ইজমালীভাবে পরিজ্ঞাত বষয়াবলি ইজমালীভাবে আন্তরিক বিশ্বাস করাকে ঈমান বলে। (তাফসীরে রুহুল মায়ানী)।
যে সকল বিষয় বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.) হতে অকাট্যরূপে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত সেগুলোকে জরুরিয়াতে দ্বীন বা দ্বীনের অত্যাবশ্যকীয় চিরপরিচিত বিষয় বলে। কোনো ব্যক্তির মুমীন হওয়ার জন্য সকল জরুরিয়াতে দ্বীনের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন অত্যাবশ্যক। তার মধ্য হতে কোনো একটি বিষয়কে অস্বীকার করলেও সে ব্যক্তি বা সম্প্রদায়কে ইসলামের গন্ডি হতে খারিজ বলে সাব্যস্ত করা হবে।
প্রসঙ্গত : স্মর্তব্য যে, জরুরিয়াতে দ্বীন তথা দ্বীনের অত্যাবশ্যকীয় বিষয়াবলি অনেক। যেমন আল্লাহতায়ালার একত্ববাদ ও তাঁর গুণাবলির ওপর, ফিরিশতামন্ডলীর ওপর, আসমানী কিতাবসমূহের ওপর, আল্লাহর প্রেরীত রাসূলগণের ওপর, কিয়ামত দিবসের ওপর, তাকদীরের ওপর, মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা এবং সালাত, সাওম, যাকাত, জিহাদ, ইত্যাদি বিষয় ফরয হওয়ার ওপর এবং সুদ, ব্যভিচার মিথ্যা, ইসলামের ফরয কাজের প্রতি আলস্য প্রভৃতি হারাম হওয়ার প্রতি ঈমান আনয়ন করা।
শরীয়াতের ব্যবহারিক অর্থে-ঈমানকে দু’টি পর্যায়ে বিশ্লেষণ করা যায়। প্রথমত : আল্লাহর নিকট হতে মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) যে সকল বিষয় আনয়ন করেছেন, তা সত্য বলে মেনে নেয়াকে ঈমান বলে। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ(সা.)-এর মাধ্যমে জরুরিভাবে উপস্থাপিত বিষয়সমূহে তাঁকে অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা। দলিল প্রমাণ ও চিন্তা গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত বিষয়কে আরববিতে ‘ইস্তিদলালী’ বলে।
আর দলীয়-প্রমাণ চিন্তা গবেষণা ছাড়া পরিজ্ঞাত বিষয়কে ‘জরুরি’ বলে। যেমন সরাসরি রাসূলূল্লাহ (সা.)-এর মুখ হতে শ্রæত বিষয়, তাঁর থেকে অবিচ্ছিন্ন পদ্ধতিতে বর্ণিত বিষয় যথা কোরআনুম মাজীদ, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, রমজান মাসের সাওম পালন, মদ-ব্যভিচার হারাম হওয়া ইত্যাদি। (নিবরাস : ২৪৯)।
দ্বিতীয়ত : দলিল প্রমাণের গভীর তথ্য ছাড়াই যে সকল বিষয় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রচারিত দ্বীনের অঙ্গ হিসেবে পরিচিত এমনকি দলিল প্রমাণের গভীরতা সম্পর্কে অজ্ঞ জনসাধারণও তা জানে, তাকেই ‘জরুরি’ বলে। এর অর্থ এ নয় যে, সকল ব্যক্তিই তা জানে, যদিও দ্বীনি শিক্ষার সাথে তার দূরতম সম্পর্কও না থাকে।
সুতরাং দ্বীনি শিক্ষা সম্পর্কে উদাসীন কেউ যদি উক্ত বিষয় না জানে অথচ সাধারণ জনগণের তা জানা আছে, তবে তা-ই জরুরি বিষয়। উদাহরণস্বরূপ আল্লাহর একত্ববাদ, রিসালাত, খতমে নাবুওয়্যাত, হিসাব নিকাশ, পুনরুত্থান ইত্যাদি। (ফায়জুল বারী শরহে বুখারী : ১/৬৯)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।