Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিয়ন্ত্রণহীন কিশোর গ্যাং

দুই বছরে ৩৪ খুন : তালিকা তৈরি করে শিগগিরই বিশেষ অভিযান এ অপরাধ রোধে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে : র‌্যাব

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ১৪ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০০ এএম

বৃহস্পতিবার ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা। রাজধানীর খিলগাঁও পল্লিমা সংসদের দক্ষিণের রাস্তায় বসে আড্ডা দিচ্ছে ৫/৬জন কিশোর। আড্ডার মূল আকর্ষণ স্মার্ট মোবাইল ফোনে গেইমস ও ভিডিও দেখা। এ সময় কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক কিশোরী। হঠাৎ আড্ডা ভেঙ্গে এক কিশোর বাজে মন্তব্য করে ওই কিশোরীকে দেখে। কিশোরীটি পেছনে ফিরে কিশোরদের দেখে দ্রুত চলে যায়। এর দশ মিনিটের মধ্যেই আরো ৭/৮জন কিশোর ঘটনাস্থলে এসে জানতে চায় কেন ওই কিশোরীর সাথে বাজে আচরণ করা হয়েছে। এক পর্যায়ে দু’গ্রুপের ২৫ থেকে ৩০জন কিশোর জড়ো হয় এবং তাদের মধ্যে বেশ কিছু সময় বাকবিতান্ডা ও হাতাহাতি হয়। পরে এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।

করোনাভাইরাসের কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় বিকেল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আড্ডা মত্ত থাকে উঠতি বয়সের কিশোররা। রাজধানী জুড়ে রয়েছে এ ধরনের ৫০ কিশোর গ্রুপ। তারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে খুনাখুনিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মাদক ব্যবসা ও দখলবাজিতেও তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে।

পুলিশ ও র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, নানা অপরাধে জড়িয়ে কিশোররা ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। অধিকাংশ কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার পেছনে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা মদদ দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে ‘হিরোইজম’ প্রকাশ করতেও পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। গত ১৭ বছরে ঢাকায় কিশোর অপরাধীদের হাতে ১২০ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে গত ২০১৯ ও ২০২০ সালে ৩৪ জন খুন হয়েছেন। এসব ঘটনায় চার শতাধিক কিশোরকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে অর্ধশত কিশোরকে। কিশোর গ্যাং সদস্যদের তৎপরতা রোধে শিগগিরই বড় ধরনের অভিযান চালানো হবে বলে আইন-শৃংখলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে।

গত সোমবার র‌্যাবের এক অনুষ্ঠানে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, পরিবারকে জানতে হবে ছেলে বা মেয়ে কোথায় কার সাথে মিশে, কী করে, কখন কোথায় যায়। এটা প্যারেন্টাল কন্ট্রোল। সন্তান জন্ম দিলে দায়-দায়িত্ব পিতামাতাকে নিতে হবে। কিশোরদেরকে বিপথগামী হতে দেয়া যাবে না। কিশোর গ্যাং নামে কোনো দৌরাত্ম্য চলতে পারে না। আমাদেরকে এ ধরনের যে কোনো দৌরাত্ম্য মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের একটি প্রজন্ম নষ্ট হয়ে যাবে তা আমরা চাই না। আর এ জন্য দায়িত্ব নিতে হবে পিতা-মাতা, পরিবার ও সমাজকেও। দেশে বর্তমানে একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে কিশোর গ্যাং।

র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। অতীতে এ বিষয়ে অনেক অভিযান চালানো হয়েছে। সম্প্রতি র‌্যাবের পক্ষ থেকে অনেক কাজ করা হয়েছে। এলাকাভিত্তিক গ্যাং সদস্যদের সংখ্যা, নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা হয়েছে। হালনাগাদ তালিকা অনুযায়ী শিগগিরই বড় ধরনের অভিযান চালানো হবে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সম্প্রতি কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় ‘বড় ভাই’রা। ঢাকায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের খুনাখুনিতে কিশোর ও তরুণদের ব্যবহার করার ঘটনাও ঘটেছে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে নতুন বছরের শুরুতে মাঠে নামার পরিকল্পনা করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এরই মধ্যে ঢাকার পাড়ামহল্লার কিশোর গ্যাংয়ের নতুন করে তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম। ওই তালিকা অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, কিশোর গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা পর্যায়ক্রমে আলাদা আলাদা গ্রুপ তৈরি করে। তাদের ড্রেস কোড থাকে, আলাদা হেয়ার স্টাইল থাকে, তাদের চালচলনও ভিন্ন। তারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। তারা নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। নানাভাবে তারা অর্থ সংস্থানের চেষ্টা করে। এলাকার কোনো ‘বড় ভাই’র সহযোগী শক্তি হিসেবেও তারা কাজ করে।

তিনি আরো বলেন, কিশোরদের একত্রিত করে কতিপয় ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ত করছেন। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ও আছে। সহজ ও অল্প খরচে কিশোরদের দিয়ে তারা অপরাধ করানোর সুযোগ নিচ্ছে। অস্ত্রবাজি, মাদক ও হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে তারা কিশোরদের ব্যবহার করে। এছাড়া কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিশোর গ্যাং তৈরি করছে। এটি হল কিশোর গ্যাং তৈরির একটি দিক। অন্য আরেকটি দিক হল- আমাদের দেশে শিশুদের লালনপালন করার ক্ষেত্রে পরিবারগুলো শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য বিষয়ে যথাযথভাবে দায়িত্বপালন করছে না। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা অপরাধে জড়ায় এমন একটি কথা সমাজে প্রচলিত আছে। এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এখন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও অপরাধে জড়াচ্ছে। সঠিক ও সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বলে কিশোরদের মধ্যে ক্ষোভ-হতাশা তৈরি হচ্ছে। এগুলো প্রশমিত না হওয়ায় তারা নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। এসব কারণ বিশ্লেষণ করে সমাধানের কার্যকর উদ্যোগ না নিলে কিশোর অপরাধ কমানো সম্ভব নয়।
র‌্যাবের মিডিয়া ইউংয়ের প্রধান লে. কর্ণেল আশিক বিল্লাহ গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, কিশোর গ্যাং নিয়ে র‌্যাব সব সময় সক্রিয় রয়েছে। র‌্যাবের একটি বিশেষায়িত সাইবার টিম রয়েছে। রাজধানীসহ সারাদেশে কিশোর অপরাধীদের যে দৌরাত্ম্য বেড়েছে তা নিয়ন্ত্রণে র‌্যাব কাজ করছে। এ জন্য কিশোরদের পরিবার ও সমাজের সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সরেজমিনে গিয়ে গত বৃহস্পতিবার দেখা যায়, খিলগাঁও নয়াপাড়া এলাকায় অলিগলিতে সন্ধ্যা নামার পর থেকেই কিশোরদের অবস্থান বাড়তে থাকে। মেরাদিয়া মেইন রোড থেকে নয়াপাড়ার আলী মিয়ার মসজিদের গলিতে এক নারী গার্মেন্টকর্মীকে উদ্দেশ্য করে অশালীন নানা কথা বলছে কয়েকজন কিশোর। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতে রাহাত নামে এক কিশোর বলে, ভাই-বেরাদাররা একসঙ্গে হইলে একটু মজা করি আর কি। আমরা তো তেমন কিছু করি না! একই অবস্থা চৌধুরীপাড়ার বিভিন্ন রাস্তায়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এলাকাভিত্তিক ‘কিশোর গ্যাং’গুলো বিভিন্ন পার্ক, খোলা জায়গায়, ফুটপাতে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে একত্রিত হয়ে ভিডিও কন্টেন্ট তৈরির নামে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, ইভটিজিং, পথচারীদের গতিরোধ, বাইক মহড়াসহ বিভিন্ন অসৌজন্যমূলক আচরণ করে থাকে। এসব কন্টেন্ট তারা নিজেদের টিকটক ও লাইকি আইডিতে আপলোড দেওয়ার পর লাইক-কমেন্ট পেতে রীতিমত জোর-জবরদস্তি শুরু করে। গ্রুপগুলো একে অপরের ভিডিও কন্টেন্টে ‘লাইক’ ও ‘কমেন্ট’ করার আহ্বান জানায়। এক গ্রুপ লাইক বা কমেন্ট করার পর অপর গ্রুপটি যদি না করে এ নিয়েও গ্রুপের মধ্যে দ্ব›দ্ব শুরু হয়। যা হাতাহাতি, মারামারিতেও গড়ায়।

দুই বছরে ৩৪ খুন: কিশোর গ্যাংয়ের দ্ব›েদ্ব একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে। গত দুই বছরে ৩৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার কামরাঙ্গীরচরে সিফাত (১৪) নামে এক কিশোর নিহত হয়েছে। এছাড়াও এ বছর ৩০ আগস্ট ঢাকার ওয়ারীতে দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এক কিশোর মুন্নাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ৭ সেপ্টেম্বর সবুজবাগে সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›েদ্বর জেরে কিশোর জব্বারকে খুন করা হয়। ২০১৯ সালের ২১ মার্চ উত্তরখানে ‘বিগ বস’ এবং ‘কাশ্মীরি’ গ্রুপের সংঘর্ষে কামরুল হাসান হৃদয় খুন হয়। ওই কিশোর ‘বিগ বস’ গ্রুপের সদস্য ছিল। শুধু তিনটি ঘটনা নয়, দুই বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে ৩৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

র‌্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ৫০টি কিশোর গ্যাং সক্রিয়। এর মধ্যে উত্তরায় ১৫টি ও মিরপুরে ১০টি গ্যাং সক্রিয়। এছাড়া তেজগাঁও, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, মহাখালী, বংশাল, মুগদা, চকবাজার ও শ্যামপুরে একাধিক গ্যাং সক্রিয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা খুন, ছিনতাই-চাঁদাবাজি, শ্লীলতাহানি ও ইভটিজিং এবং মাদক ব্যবসার মতো অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের নিয়ন্ত্রক বা পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় সমাজের কিছু ‘বড় ভাই’ রয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ