Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

করোনাকালে কৃষিতে ব্যাপক সাফল্য

চাকরি হারিয়ে যুবকরা ঝুঁকছেন চাষাবাদে

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ২৫ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০০ এএম

ত্রিশালের আলিমুজ্জামান। ঢাকায় একটি গার্মেন্টসে অপারেটরের চাকরি করতেন। করোনা মহামারির শুরুর পর অনেকের সাথে তারও চাকরি চলে যায়। বেকার হয়ে গ্রামে ফিরে গিয়ে তিনি তার বাবার ৩০ শতক জমিতে করলার চাষ করেন। পাশাপাশি মুরগি পালন শুরু করেন। এ পর্যন্ত সংসার খরচ চালিয়ে এক বছরে ৫০ হাজার টাকা সঞ্চয় করেছেন। তার ইচ্ছা বড় করে মুরগির খামার গড়ে তুলবেন। পাশাপাশি সবজি চাষও অব্যাহত রাখবেন।

এভাবে তরুণদের অংশগ্রহণে কৃষিখাতে এসেছে ব্যাপক সাফল্য। করোনা মহামারিতে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি যেখানে বিপর্যস্ত সেখানে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটাই স্থিতিশীল। মূলত কৃষিখাতই করোনাকালে দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। করোনার কারণে পোশাক শিল্প ও অন্যান্য অনেক শিল্পকারখানার শ্রমিক চাকরি হারিয়ে বেকার হয়েছে। তারা এখন শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে কৃষি কাজে নিয়োজিত হয়েছে। কেউ মাছ চাষ করছেন, কেউবা পল্ট্রি খামার করেছেন, কেউবা লাউ, শসা, বেগুন, করলা ইত্যাদি সবজি চাষ করে সফল হয়েছে। বেকার তরুণরা নিজেদের কৃষি কাজে নিয়োজিত করায় এ খাতে ইতোমধ্যে ব্যাপক সাফল্য এসেছে।
চলতি বছরে দেশে ৩৮ দশমিক ৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছে। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ৩৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে এবছর ২ মিলিয়ন মেট্রিক টন বেশি উৎপাদন হয়েছে। শুধু ধান নয় অন্যান্য খাদ্যশস্য, সবজি ও ফল ইত্যাদিতে বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। চাল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে চতুর্থ। স্বাধীনতার পর দেশে যে চাল উৎপাদন হতো এখন তার চেয়ে তিনগুণ বেশি উৎপাদন হয়। ওই সময় যেখানে প্রতি হেক্টরে চালের উৎপাদন ছিল দেড় টন, তা এখন চার টনেরও বেশি। একইভাবে গমে উৎপাদন দ্বিগুণ আর ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ। ২০২০ সালে গম উৎপাদন হয়েছে ১২ লাখ ৫০ হাজার টন, যা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে পরিমাণে অর্ধেক ছিল। ভুট্টায় সর্বোচ্চ সফলতা এসেছে শেষ দশকে। ২০০৯ সালে ভুট্টার উৎপাদন ছিল সাড়ে সাত লাখ টন, যা ২০২০ সালে ৫৪ লাখ টন। আগামী ৫ বছরের মধ্যে শস্যটির উৎপাদন এক লাখ টনে উন্নীত করতে কাজ চলছে।

সব মিলিয়ে এই করোনাকালে দেশে কৃষিতে আশাতীত সাফল্য এসেছে। দেশে লোকসংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়লেও সে তুলনায় বাড়েনি কৃষিজমি বরং প্রতি বছর এক শতাংশ হারে কমেছে। এর পরও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। একই সঙ্গে বেড়েছে পুষ্টির নিরাপত্তাও। তাতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছে। বাংলাদেশের কৃষিকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করছে বিশ্ব।

জামালপুরের সাব্বির আহমদ ঢাকায় একটি ডেভেলাপার কোম্পানিতে চাকরি করতেন। করোনার কারণে কোম্পানি থেকে ছাঁটাই হয়ে তিনিও এখন গামে গিয়ে মাছ চাষ করছেন। বাপ দাদার পুরানো পুকুরে প্রথমে পাঙ্গাশ মাছের চাষ করে ছয় মাসের মধ্যে প্রায় দেড় লাখ টাকা লাভ করেছেন। এখন আরও দুটি পুকুর সংস্কার করে সেখানে শিং ও পাবদা মাছের চাষ করেছেন। একই সাথে পুকুর পাড়ে হাঁসের খামার ও পেঁপে চাষ করেছেন।
প্রধান খাদ্যশস্যের বাইরে নিবিড় চাষের মাধ্যমে দেশে সবজি উৎপাদনে নীরব বিপ্লব ঘটেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। স্বাধীনতার পর দেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (এফএও) জানিয়েছে শস্যের জমি কমলেও গত এক দশকে সবজির আবাদি জমির পরিমাণ ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে, আবাদি জমি বৃদ্ধির হার যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।

গত বছর সবজি উৎপাদন বেড়ে ১ কোটি ৭২ লাখ ৪৭ হাজার টনে পৌঁছেছে। এর মধ্যে আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত এবং বিশ্বে সপ্তম। দেশে এখন ৬০ ধরনের ও ২০০ জাতের সবজির মধ্যে বেশির ভাগের বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। কয়েক দশক আগেও হাতেগোনা কিছু সবজির বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হতো।
ফল উৎপাদনে বড় সফলতা এসছে। দেশ মোট ফল উৎপাদনে বিশ্বে ২৮তম। কিন্তু মৌসুমি ফল উৎপাদনে গত বছর বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। এফএওর হিসাবে, ১৮ বছর ধরে বাংলাদেশে সাড়ে ১১ শতাংশ হারে ফল উৎপাদন বাড়ছে। একই সঙ্গে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চারটি ফলের মোট উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয়, আমে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে বাংলাদেশ। অন্যদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, বছরে ১০ শতাংশ হারে ফল চাষের জমি বাড়ছে। এক দশকে দেশে আমের উৎপাদন দ্বিগুণ, পেয়ারা দ্বিগুণের বেশি, বড়ই দিগুণ, পেঁপে আড়াই গুণ এবং লিচু উৎপাদন ৫০ শতাংশ হারে বেড়েছে।

কৃষিখাতে অভূতপূর্ব সাফল্য সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফসল বলে দাবি করেন কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, সরকার প্রথম থেকেই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে আন্তরিক ছিল। যেভাবে সরকার কৃষিখাতে অর্থিক সমর্থন ও নীতিগত সহায়তা দিয়েছে তা অন্য যেকোনো সময়ের থেকে বেশি। কৃষিখাতে এ অভূতপূর্ব সাফল্য সরকারের সহায়তা ছাড়া সম্ভব ছিল না। এ সাফল্যের পেছনে উন্নত প্রযুক্তি, বীজ, সার ও যন্ত্রের ব্যবহার প্রধান উজ্জীবক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। এছাড়া বিশেষ অবদান রাখছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। দেশে বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় প্রচুর উচ্চ ফলনশীল, স্বল্পমেয়াদি ও পরিবেশসহিষ্ণু নতুন জাত উদ্ভাবন হয়েছে। এসব কারণে দেশের বড় সাফল্য এখন কৃষি। আমাদের চাল উদ্বৃত্ত, বেশকিছু খাদ্যে প্রথম সারির উৎপাদক। শস্যের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে বাংলাদেশ এখন শীর্ষে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, করোনাকালে কৃষিখাত দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। কৃষি নির্ভর দেশ হিসেবে এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত ভালো একটি বিষয়। করোনায় চাকরি হারিয়ে অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে কৃষি কাজে নিয়োজিত হয়েছেন। এ বিষয়টি দেশের কৃষি অর্থনীতিতে নতুন করে বিপ্লব ঘটাবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ